উপস্থাপনা : ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসসমূহ যেমন- আল্লাহর একত্ববাদ, তাঁর গুণাবলি, রিসালাত ইত্যাদি বিষয়ে যারা ভ্রান্তি ছড়াতে চায়, তাদের গোঁড়ালি ও ভ্রান্ত যুক্তির মোকাবেলায় তাওহীদের বলিষ্ঠ যুক্তি প্রমাণ দ্বারা মুসলিম উম্মাহর নির্ভেজাল ও নিষ্কলুষ আকিদা সংরক্ষণ পূর্বক ইহ ও পরকালীন সাফল্য অর্জন করার নিমিত্ত উদ্ভব হয়েছিল আকাইদশাস্ত্রের।
নিম্নে আকাইদশাস্ত্রের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস আলোচনা করা হলো ।
আকাইদশাস্ত্রের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস :
আকাইদশাস্ত্রের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতা নিম্নরূপ-
১. খোলাফায়ে রাশেদার অবসান :
খোলাফায়ে রাশেদার অবসানের ফলে মুসলিম মিল্লাতের অভ্যন্তরে প্রবল ধর্মীয় মতবিরোধের সৃষ্টি হয়। অতঃপর যথার্থভাবে খেলাফত এবং ধর্মীয় নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় এ সকল মতবিরোধ শিকড় গেড়ে বসে এবং তাদেরকে বিভিন্নমুখী স্বতন্ত্র দলের ভিত্তি স্থাপনের সুযোগ করে দেয়।
আরও পড়ুন : আকাইদ শব্দের অর্থ কি? কাকে বলে। এর উদ্দেশ্য ও বিষয়বস্তু
কারণ যথাসময়ে যথাযথভাবে এসব মতবিরোধ দূর করার মতো নির্ভরযোগ্য ও ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব রাজতন্ত্রে আদৌ বর্তমান ছিলো না ।
2. অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব :
হযরত ওসমান (রা)-এর শাসনামলের শেষ দিকে কতিপয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অভিযোগের সূত্র ধরে মুসলিম উম্মাহর মাঝে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। পর্যায়ক্রমে হযরত ওসমান (রা)-এর শাহাদাত, হযরত আলী (রা)-এর খেলাফতকালে উষ্ট্রীর যুদ্ধ, সিফফীনের যুদ্ধ, সালিসের ঘটনা এবং নাহরাওয়ানের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
এ সময় মুসলিম উম্মাহর মাঝে প্রশ্ন দেখা দিতে থাকে যে, এসব যুদ্ধে কে হক এবং কে বাতিলের পথে আছে, এসব প্রশ্নের সূত্র ধরে কয়েকটি মতবাদের উদ্ভব ঘটে। পরবর্তী সময়ে কারবালার যুদ্ধ এসব মতবাদের বিকাশ লাভে সহায়তা করে।
৩. অসংখ্য ফেরকার উদ্ভব :
উল্লিখিত ঘটনাবলির প্রেক্ষাপটে মুসলমানদের ধর্মীয় ঐক্যে বিশাল ফাটলের সৃষ্টি হয়। এর ফলে অসংখ্য ছোট ছোট ফেরকার উদ্ভব হতে থাকে। ইরাকের কুফা এসব ফেরকাবাজদের একটি বড় কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। অনৈক্য, বিচ্ছিন্নতা ও মতবিরোধের কারণে যেসব ফেরকার উদ্ভব হয়, সেসবের মূলে ছিল ৪টি বড় ফেরকা । যথা- শিয়া, খারেজী, মুরজিয়া এবং মুতাযিলা ।
আরও পড়ুন : আকাইদের মৌলিক বিষয়, মূলনীতি বা উৎস কয়টি ও কি কি ব্যাখ্যা সহ
৪. বিজাতীয় দর্শনের প্রভাব :
উমাইয়া এবং আব্বাসীয় শাসনামলে ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটে। বিভিন্ন দেশ ও জাতি মুসলমানদের সাথে মিলিত হলে তাদের ধর্ম, সংস্কৃতি এবং দর্শনের সাথে মুসলমানদের পরিচয় ঘটে। ফলে মুসলিম চিন্তাবিদগণ বিজাতীয় দর্শনে প্রভাবিত হন। তারা দার্শনিক যুক্তি তর্কের মাধ্যমে ইসলামের আকিদা বিশ্বাসের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন নতুন মতবাদের উদ্ভব ঘটান ।
৫. আব্বাসীয়দের পৃষ্ঠপোষকতা :
খলিফা মামুন ছিলেন গ্রিক দর্শন এবং যুক্তিবাদে প্রভাবান্বিত। তিনি মুতাযিলা ধর্ম দর্শনের সহযোগিতা করেন। তার মৃত্যুর পর খলিফা মুতাসিম এবং ওয়াসিক বিল্লাহও মুতাযিলাদের পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। তাদের এরূপ রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় মুতাযিলা সম্প্রদায় গ্রিক দর্শনের ভিত্তিতে আল্লাহ, কুরআনসহ ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলির ব্যাপারে অবাঞ্ছিত যুক্তিতর্কের অবতারণা করে ।
আরও পড়ুন :- আকাইদ বলতে কি বুঝায় | এর আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ কি
৬. আকাইদশাস্ত্রের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ :
উপরোল্লিখিত ঘটনাবলি এবং বাতিল ফেরকাসমূহ কর্তৃক ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলি নিয়ে বাড়াবাড়ির প্রেক্ষিতে রাসূল (স) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের বাস্তব অনুসরণীয় কতিপয় আলেম চিন্তাভাবনা শুরু করেন। তারা বাতিলদের কাজসমূহের সৃষ্ট যুক্তিতর্কের বিপরীতে- ইসলাম ও এর মৌলিক বিষয়াবলির যথার্থ দলীল প্রমাণ উপস্থাপন শুরু করেন।
এ পর্যায়ে ইমাম আবু হানীফা (র) রচনা করেন “আল ফিকহুল আকবার”। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (র) কুরআন সৃষ্ট কিনা এ বিতর্কের বলিষ্ঠ জবাব প্রদান শুরু করলে মুতাযিলা সমর্থক আব্বাসীয় খলিফা ওয়াসিক বিল্লাহর নির্যাতনের শিকার হন। এভাবে, আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মধ্যে ইসলামের মৌলিক আকিদা বিষয়ে বাতিলপন্থিদের জবাব প্রদানে এগিয়ে আসেন একদল ইসলামী চিন্তাবিদ ।
ইমাম আবু হানীফা ও আহমদ বিন হাম্বল (র)-এর পর আকাইদশাস্ত্রে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব করেন।আবুল হাসান আল আশয়ারী (র)। এ গবেষক ও চিন্তাবিদ অনুভব করেন যে, ইসলামের মূলভিত্তি সেটিই যার ওপর সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে সালেহীন প্রতিষ্ঠিত ।
তারা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকাইদ শাস্ত্রকে যুগোপযোগী ও শ্রেষ্ঠত্বের পর্যায়ে উন্নীত করেন। এভাবে ইসলামের মৌলিক আকিদা বিষয়ক শাস্ত্র আকাইদশাস্ত্রের উৎপত্তি ও বিকাশ সাধিত হয়।