আকাইদের মৌলিক বিষয়, মূলনীতি বা উৎস সমূহ :
ইসলামী আকিদার তথা আকাইদের মৌলিক বিষয়, মূলনীতি বা উৎসসমূহ হলো ছয়টি। ইসলামী চিন্তাবিদগণের কারো কারো বর্ণনায় ইসলামী আকিদার আরো দুটি বিষয় এর অঙ্গ বলে বিবৃত হয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা উপস্থাপন করা হলো-
১। আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস : মহান আল্লাহকে – একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, প্রতিপালক, রিজিকদাতা ও প্রভু হিসেবে দৃঢ়বিশ্বাস স্থাপন করা ইসলামী আকিদার মুখ্য স্তম্ভ। মহান আল্লাহর একত্ববাদে সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত বিশ্বাস স্থাপন ঈমানের দাবি। আল্লাহর সাথে বা তাঁর গুণাবলির ব্যাপারে কোনো শরীক করা সর্বতোভাবে বর্জনীয়। মহান আল্লাহর একত্ববাদকে আকাইদুশাস্ত্রবিদগণ মূলত তিন শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। যথা-
ক. প্রভুত্বের ব্যাপারে একত্ববাদ : সমগ্র সৃষ্টি জগতের একমাত্র প্রভু, সৃষ্টিকারী, নিয়ন্ত্রণকারী ও মালিক হিসেবে আল্লাহকে বিশ্বাস ও স্বীকার করে নেয়ার নাম প্রভুত্বের ব্যাপারে একত্ববাদ। এ সম্পর্কে আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
١ – ٱلْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ ٱلْعَالَمِينَ
٢ – قُلْ أَغَيْرَ ٱللَّهِ أَبْغِي رَبًّا وَهُوَ رَبُّ كُلِّ شَيْء
আরও পড়ুন : আকাইদ শব্দের অর্থ কি? কাকে বলে। এর উদ্দেশ্য ও বিষয়বস্তু
খ. উপাস্যের ব্যাপারে একত্ববাদ : এমর্মে বিশ্বাস ও স্বীকার করা যে, আল্লাহ তায়ালাই ইবাদত বন্দেগির একমাত্র সত্তা। যেমন কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِلَـٰهُكُمْ إِلَـٰهٌ وَاحِدٌ ۖ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلرَّحْمَـٰنُ ٱلرَّحِيمُ
গ. নাম ও গুণাবলিতে একত্ববাদ : মহান আল্লাহর সত্তাগত গুণাবলি প্রকাশক অনেক নাম রয়েছে। এসব গুণ প্রকাশক নামের ব্যাপারেও মহান আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বলা হয়েছে-
قُلِ ٱدْعُوا ٱللَّهَ أَوِ ٱدْعُوا ٱلرَّحْمَـٰنَ ۖ أَيًّا مَّا تَدْعُوا فَلَهُ ٱلْأَسْمَآءُ ٱلْحُسْنَىٰ
উপরিউক্ত তিনটি ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর একত্ব ও বিশ্বাস স্থাপন করা ইসলামী আকিদার মূল উৎস।
২। ফেরেশতাগণের ওপর বিশ্বাস : ফেরেশতাগণের প্রতি ঈমানের চারটি দিক রয়েছে।
ক. ফেরেশতাগণের অস্তিত্বে বিশ্বাস, খ. তাঁদের নামে বিশ্বাস, গ. তাঁদের আকৃতি-প্রকৃতিতে বিশ্বাস এবং ঘ. তাঁদের কর্মে বিশ্বাস ।
শরহে ফিকহুল আকবর’ গ্রন্থকার মোল্লা আলী কারী (র) ফেরেশতার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, ফেরেশতাগণ মহান আল্লাহর সম্মানিত এক বিশেষ সৃষ্টি। আল্লাহ তাদেরকে নূর দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। তারা জ্যোতিময় সূক্ষ্মদেহের অধিকারী। তাদের রয়েছে নিজস্ব আকৃতি।
আরও পড়ুন : বিশুদ্ধ আকিদা কি ? এবং বিশুদ্ধ আকীদার গুরুত্ব
তবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করার ক্ষমতাও আল্লাহ তাদেরকে দিয়েছেন। তারা পুরুষ বা মহিলা নন। তাদের কোনো সন্তানসন্ততি নেই। তারা অদৃশ্য এবং পানাহার ও নিদ্রাযুক্ত। আল কুরআনে ফেরেশতাগণের বিভিন্ন গুণ বর্ণিত হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন-
وَٱلْمَلَائِكَةُ وَهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ ۩ يَخَافُونَ رَبَّهُم مِّن فَوْقِهِمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ
অর্থাৎ, আর ফেরেশতাগণ, তারা তো অহংকার বা বিদ্রোহ করে না। তারা তাদের মহান প্রভুকে ভয় করে চলে এবং তাদেরকে যে নির্দেশ দেয়া হয়, তা প্রতিপালন করে ।
ফেরেশতাদের সংখ্যা অগণিত। হাদীসে এসেছে, সাত আসমান ও যমীনের এক গজ বা এক কদম পরিমাণ স্থানও এমন নেই, যেখানে কোনো ফেরেশতা ইবাদতে রত না আছেন। প্রধান ফেরেশতার সংখ্যা চার। যথা- ১. হযরত জিবরাঈল, ২. হযরত ইসরাফিল, ৩. হযরত মিকাইল, ৪. হযরত আজরাইল (আ)। ফেরেশতাগণের ওপর ঈমান আনা ফরয। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَمَن يَكْفُرْ بِٱللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَٱلْيَوْمِ ٱلْآخِرِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا
৩। কিতাব সমূহের উপর বিশ্বাস : আসমানী কিতাবসমূহের উপর বিশ্বাস স্থাপন ইসলামী আকিদার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
বস্তুত মহান আল্লাহ মানবজাতির হেদায়াতের জন্য অসংখ্য নবী রাসূলের মাধ্যমে যুগে যুগে তাঁর বাণী বা বিধিবিধান অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহ তায়ালার এসব বাণী বা এর লিখিত সংকলনই আসমানী কিতাব।
আরও পড়ুন : আকাইদ শাস্ত্রের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
‘শরহে ওমদাতুল কারী’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, আসমানী কিতাবের সংখ্যা ১০৪ খানা। এ সকল কিতাবের মধ্যে সহীফা (র) তথা ছোট আকারের কিতাব ১০০ খানা এবং বাকি চারখানা হলো প্রধান ও প্রসিদ্ধ আসমানী কিতাব এগুলো হলো- ১. তাওরাত, ২. যাবুর, ৩. ইঞ্জিল এবং ৪. আল কুরআন । আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনা ইসলামী আকিদার মৌলিক অংশ মহান আল্লাহ যথার্থ ঈমানদারগণের পরিচয় তুলে ধরে বলেন-
ٱلَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنزِلَ مِن قَبْلِكَ وَبِٱلْآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ
৪। রাসূলগণের ওপর বিশ্বাস : ইসলামী আকিদা তথা ঈমানের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হলো, রাসূল ও নবীগণের ওপর ঈমান। নবী রাসূলগণ মহান আল্লাহর বাণী দুনিয়াবাসীর নিকট পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে তাদের দায়িত্ব পালন করেন।
তাঁরা মানুষ, তবে মহান আল্লাহ তাঁর বার্তাবাহক ফেরেশতা কর্তৃক তাদের নিকট অহী বা প্রত্যাদেশ নাযিল করেন। তাঁরা মানবজাতিকে আল্লাহর সে বাণী প্রচার করে হেদায়াতের পথে আহ্বান জানান। নবী রাসূলগণের ওপর ঈমান আনা ঈমানের অন্যতম শর্ত।
মহান আল্লাহ যুগে যুগে অসংখ্য নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন। বিভিন্ন বর্ণনায় তাঁদের সংখ্যা সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। মতান্তরে তাদের সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার বা আট হাজার বা দু’লক্ষাধিক বা ২ লাখ ২৪ হাজার ।
ইমাম শাওকানীর মতে, নবী রাসূলদের সংখ্যা ৪ লাখ ২৪ হাজার ।
৫। আখেরাতের ওপর বিশ্বাস : ইসলামী আকিদার অন্যতম ভিত্তি হলো, আখেরাত তথা পরকালের প্রতি বিশ্বাস। ইসলামী জীবনদর্শনের বৈশিষ্ট্য হলো, ইহকালীন সাফল্যের পাশাপাশি পরকালীন মুক্তি অর্জনে ব্রতী থাকা। মানুষের মৃত্যুর পর পরকালীন জীবনের সূচনা হয় অতঃপর কেয়ামত সংঘটিত হবে।
আরও পড়ুন : কুরআন সুন্নাহর আলোকে – ইসলামী আকীদার গুরুত্ব
হাশর ময়দানে পাপপুণ্যের বিচারে মানুষ পুরস্কার বা শাস্তি ভোগ করবে। মানুষ সেখানে পরম সুখের স্থান জান্নাত কিংবা শাস্তিময় জাহান্নাম অর্জন করবে। পরকালের প্রতি ঈমান আনা অপরিহার্য। কেননা পরকাল অস্বীকারকারীগণ মুসলিম দাবি করতে পারে না।
মানুষের আখেরাত তথা পরকালীন জীবনের কয়েকটি পর্যায় রয়েছে। যেমন-
ক. কেয়ামত সংঘটন। এ পর্যায়ে কেয়ামতের ছোট ও বড় লক্ষণসমূহের প্রকাশ ঘটবে। অতঃপর হযরত ইসরাফীল (আ) কর্তৃক শিঙ্গায় ফুৎকারের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে, কেয়ামত সংঘটিত হয়ে, পৃথিবী ধ্বংস হবে। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন –
كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ وَيَبْقَىٰ وَجْهُ رَبِّكَ ذُو ٱلْجَلَالِ وَٱلْإِكْرَامِ
খ. আখেরাতের সূচনা হবে। এ পর্যায়ে হাশর তথা মানবমণ্ডলী এক স্থানে একত্র হবে। তাদের পাপপুণ্যের বিচার হবে। পুরস্কার অথবা শাস্তি প্রাপ্য হবে। এসব বিষয়ে আল কুরআনে বিভিন্ন আয়াত বিদ্যমান। যেমন-
وَنُفِخَ فِي ٱلصُّورِ فَإِذَا هُم مِّنَ ٱلْأَجْدَاثِ إِلَىٰ رَبِّهِمْ يَنسِلُونَ
৬। তাকদীরের ওপর বিশ্বাস : ইসলামী আকিদার এ বিষয়টিও মৌলিক বিশ্বাসের অন্যতম। মহান আল্লাহ মানব ও জিনসহ অন্যান্য প্রাণীদেরকে জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত সে যা করবে, যা আহার করবে, কিভাবে জীবনধারণ করবে ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় পূর্বেই নির্ধারণ করে রেখেছেন।
এমনকি মানুষের পারলৌকিক পরিণতিও এভাবে পূর্বে নির্ধারিত রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন- অর্থাৎ, সে মহান সত্তা প্রতিটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন এবং তার একটি, তাকদীর নির্ধারণ করে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ আরো বলেন-
إِنَّ كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ – বাকি দুইটি হলো –
৭। মুজিযার ওপর বিশ্বাস : মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবী রাসূলগণকে এমন এক ক্ষমতা প্রদান করেন, যার মাধ্যমে তাঁরা বিভিন্ন অলৌকিক ক্রিয়াকর্ম বা নিদর্শন উপস্থাপন করতে পারেন, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। এসব অলৌকিক ক্রিয়াকর্ম বা নিদর্শনকে মুজিয়া বলে।
شَرْحُ الْعَقَائِدِ النَّسْفِيَّةِ গ্রন্থকারের মতে, নবুয়ত অস্বীকার ও বিরোধিতাকারীদের মোকাবেলায় নবুয়তের দাবিদারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত কোনো অস্বাভাবিক তথা প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ কাজকে মুজিযা বলে। তার প্রকাশ এমন পন্থায় হয়ে থাকে যে, বিরুদ্ধবাদীগণ অনুরূপ কার্য ঘটাতে অক্ষম হয়ে পড়ে।
হযরত মুসা (আ)-এর লাঠি, রাসূল (স)-এর চন্দ্র দ্বিখণ্ডিতকরণ এবং আল কুরআন মুজিযার অন্তর্গত। আল কুরআন কেয়ামত পর্যন্ত এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী মুজিযা হিসেবে বিদ্যমান। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা-
قُلْ إِنَّ الْإِنسَ وَالْجِنَّ اجْتَمَعُوا أَنْ يَأْتُوا بِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآنِ لَا يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا
রাসূলগণের মুজিযার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এর অস্বীকারকারী মুসলমান থাকতে পারে না।
৮। মিরাজের ওপর বিশ্বাস : মহান আল্লাহর প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাপনায় মহানবী (স) ‘বুরাক’-এ আরোহণ করে মক্কা হতে প্রথমে বায়তুল মুকাদ্দাস অতঃপর সপ্তাকাশ ভ্রমণ, জান্নাত-জাহান্নাম প্রত্যক্ষকরণ; সর্বোপরি মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করেন। হিজরতের এক বছর পূর্বে মতান্তরে ১৬, ১৭ বা ১৮ মাস পূর্বে সংঘটিত এ ঐতিহাসিক ঘটনাকে মিরাজ বলে। আল কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে মিরাজের বিবরণ এসেছে। এছাড়া হাদীসে এর বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়।
মিরাজ সশরীরে নাকি স্বপ্নযোগে হয়েছিল, সে বিষয়ে দার্শনিকগণ মতভেদ করেছেন। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদা হলো, মিরাজ সশরীরে সংঘটিত হয়েছিল। এরই ওপর ঈমান আনয়ন ইসলামী আকিদার অন্যতম মৌলিক উপাদান।