উপস্থাপনা :
“শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড।” শিক্ষা মানুষকে জ্ঞানের আলো দান করে, সমাজ থেকে কু-সংস্কার দূর করে, মানুষে মানুষে সম্প্রীতি বাড়ায় এবং সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে করে সমৃদ্ধ। তাই শিক্ষা জীবনের সাথে সম্পৃক্ত। জীবনের সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষাই কর্মমুখী শিক্ষা। আজ পৃথিবী দ্রুতবেগে এগিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ শিক্ষার সাথে কর্মমুখী শিক্ষার অগ্রযাত্রার ফলেই তা সম্ভব হচ্ছে। কর্মের জন্যই আজ বিশ্বে কর্মমুখী শিক্ষা অতীব প্রয়োজনীয় ।
কর্মমুখী শিক্ষা :
যে শিক্ষা ব্যবস্থায় মানুষ কোন একটা বিষয়ে হাতে-কলমে শিক্ষা লাভ করে জীবিকার্জনের যোগ্যতা অর্জন করে, তাই কর্মমুখী শিক্ষা। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের দেশে বেকার সমস্যার সমাধান দিতে পারছে না। তাই দিন দিন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে । এ সমস্যার মোকাবেলা করতে হলে কর্মমুখী শিক্ষা চালু করা অতীব প্রয়োজন ।
কর্মমুখী শিক্ষার প্রকারভেদ :
কর্মমুখী শিক্ষা দুই প্রকার। এদের একটি হল-ডাক্তার, প্রকৌশলী এবং কৃষিবিদ যারা বিভিন্ন কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রশিক্ষণ নিয়ে উচ্চ ডিগ্রী লাভ করে। তারা ইচ্ছেমত স্বাধীন পেশায় নিয়োজিত হতে পারে। চাকরির আশায় তাদেরকে বসে থাকতে হয় না। অপরটি প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক শিক্ষা।
এ শিক্ষায় শিক্ষিত হলে কারোরই খাওয়া-পরার ব্যাপারে ভাবতে হয় না । এ জাতীয় শিক্ষার মধ্যে-ধাত্রী বিদ্যা, সেলাই কাজ, কাঠমিস্ত্রীর কাজ, দর্জির কাজ, ছাপাখানার কাজ, বই বাঁধাই, বিদ্যুতের কাজ, টেলিভিশন-বেতার-মোটর মেরামতের কাজ, ওয়েল্ডিং এর কাজ, কারখানায় শ্রমিকের কাজ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ।
আরও পড়ুন :- মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান- রচনা [Class - 6, 7, 8 ,9 ,10]এবং hsc
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা :
আধুনিক দুনিয়ায় বেঁচে থাকার জন্য নানা কলাকৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে অথচ ব্যবসায়-বাণিজ্য, সভ্যতা- সংস্কৃতিতে, জীবনযাত্রায় আমরা ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছি। কারণ, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো পরাধীন যুগের। এখনো ব্রিটিশদের কেরানী বানাবার শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের দেশে প্রচলিত ।
গতানুগতিক গ্রন্থগত শিক্ষা ব্যবস্থা ডিগ্রীধারী শিক্ষিত ব্যক্তি তৈরি করছে বটে, তা কর্মভিত্তিক না হওয়াতে ফলপ্রসূ হয়ে উঠছে না। ফলে দেশ আজ ধীরে ধীরে অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে। এ অবস্থার পরিবর্তন আনতে হলে কর্মমুখী শিক্ষা প্রবর্তন অত্যাবশ্যক ।
কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা :
কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বহুবিধ। এ শিক্ষা গ্রহণের পর একজন শিক্ষার্থীকে চাকরির জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। এ শিক্ষা বেকারত্বের নিদারুণ অভিশাপ থেকে দেশকে মুক্ত করে। দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দারিদ্র্য বিমোচনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এ শিক্ষা।
এ শিক্ষা রুজি-রোজগারের পথ খুলে দেয় এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দেয় । কর্মমুখী শিক্ষায় দক্ষ জনশক্তিকে আমরা বিদেশে পাটিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি। তাই কর্মমুখী শিক্ষা আরো ব্যাপক হওয়া প্রয়োজন ।
কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার :
দেশের ও জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার ঘটানো প্রয়োজন। এ উদ্দেশ্যে সরকার ও জনগণের প্রচেষ্টায় অধিক পরিমাণ কর্মমুখী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন। বিশেষ করে কৃষিকার্যে সহায়ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ওপর অধিক জোর দিতে হবে। বিভিন্ন কুটির শিল্প, বয়ন শিল্প, ডেইরী শিল্প ইত্যাদি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন ।
আরও পড়ুন :- বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা - বাংলা প্রবন্ধ রচনা
বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থা :
বিশ্বের উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যায় যে, তাদের পরিকল্পিত এবং কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষার বাস্তব কর্মকাণ্ড। উন্নত বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থায় কেরানি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আছে বিজ্ঞানী হওয়ার এবং কর্মের মন্ত্রে দীক্ষা নেওয়ার। ব্রিটেন, আমেরিকা, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশ উৎপাদনমুখী বা কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্যকে প্রসন্ন করেছে। বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মমুখী শিক্ষা চালু করে তারা আজ উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করেছে।
কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্ব :
যে শিক্ষা অর্জন করে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা যায় এবং যার মাধ্যমে সহজে জীবিকা নির্বাহ করা যায় তাই হলো কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা। কর্মমুখী শিক্ষা লাভ করলে পরমুখাপেক্ষী হতে হয় না, বেকার থাকতে হয় না; বরং এ ধরনের শিক্ষা কর্মপ্রেরণা যোগায় এবং নিজের অবস্থার উন্নতির সাথে সাথে দেশ ও জনগণের সেবা করা যায়।
একথা ঠিক যে, অদক্ষ শ্রমিক ক্রমে দক্ষ হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা পেলে তারা রাষ্ট্রের এবং সমাজের অধিকতর প্রয়োজন সুসম্পন্ন করতে পারে। এ জন্যই সকল প্রকার বৃত্তি গ্রহণের জন্য উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন করা দরকার।
আমাদের দেশে কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থার সম্ভাবনা :
কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষায় যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে আমাদের দেশে। কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণে কৃষিকাজে, কলকারখানায় কাজ পেতে সুবিধা হয় এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করা যায়। উচ্চতর প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষা অর্থাৎ, ভাষা, গণিত, সমাজ ও সাধারণ বিজ্ঞান শিক্ষা প্রচলিত থাকবে এবং তারপর উপযুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা উচ্চতর শিক্ষার উপযুক্ত ছাত্রদের বাছাই করে নিতে হবে। অবশিষ্টরা নিজ নিজ প্রবণতা ও অন্তর্নিহিত গুণানুযায়ী বিভিন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষায় নিযুক্ত হবে।
এভাবে মাধ্যমিক স্তর ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শেষেও বাছাই এবং অবশিষ্টদের গুণ ও প্রয়োজন অনুসারে বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের চাহিদা অনুযায়ী এভাবে সকল ক্ষেত্রের উপযুক্ত দক্ষ কর্মী পাওয়া যাবে। এতে কর্মমুখী শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করতে পারে।
আরও পড়ুন :- বৃত্তিমূলক শিক্ষা : বাংলা রচনা । Sikkhagar
কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি :
আমাদের দেশ বিভিন্ন দিক থেকে অনগ্রসর এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন। কর্মমুখী শিক্ষাকে আমাদের দেশে কোনোরকম গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এ শিক্ষাকে তুচ্ছ বলে মনে করা হয়। সাধারণত অভিজাত শ্রেণি বা উচ্চ শ্রেণির অনেকে এমনকি মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরাও এ শিক্ষার প্রতি তেমন আগ্রহ দেখায় না। এ ধরনের মানসিকতা আমাদের সমাজ থেকে দূর করে কর্মমুখী শিক্ষায় মানুষের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে।
সাধারণ শিক্ষার চেয়ে বৃত্তিমূলক কর্মমুখী শিক্ষা যে বেশি উপকারী এই চেতনা সৃষ্টি করতে না পারলে আমাদের ব্যক্তি বা জাতীয় জীবনে উন্নতি ও অগ্রগতি সম্ভব নয় । রেডিও, টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা বা অন্যান্য প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে মানুষের মধ্যে এই চেতনাবোধ সৃষ্টি করতে হবে।
কর্মমুখী শিক্ষার উপকারিতা :
কর্মমুখী শিক্ষাকে ব্যাপকভাবে প্রবর্তনের ক্ষেত্রে নানারকম সমস্যা থাকলেও এর উপকারিতাকে অস্বীকার করা যায় না। কর্মমুখী শিক্ষার নানারকম উপকারিতা রয়েছে; যেমন : (ক) এ শিক্ষা অর্জন করলে বেকারত্বের অভিশাপ হ্রাস পাবে, (খ) সহজে কাজ পাওয়া যায়, (গ)উপার্জনশীল হওয়া যায়, (ঘ) ব্যক্তিস্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকে, (ঙ) সাধারণ শিক্ষার ওপর চাপ কমে আসবে, (চ) স্বাবলম্বী বা স্বনির্ভর হওয়া যায়, (ছ) জীবনের হতাশা, শূন্যতাবোধ এবং ব্যর্থতাজনিত গ্লানি থেকে মুক্ত হওয়া যায়, (জ) নতুন নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায় ইত্যাদি ।
উপসংহার :
বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ, প্রতিযোগিতার যুগ। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এখন নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার সময়। তাই আমাদের উচিত আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণ করে, নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের সাথে সাথে জাতীয় জীবনেও অবদান রাখার সংকল্প করা। শুধুমাত্র স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে এ যুগে লাভ নেই ।
এখন নানানপ্রকার বৃত্তিতে আত্মনির্ভরতার চাবিকাঠি লুকানো আছে। সুতরাং কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে আমাদের উচিত সাধারণ শিক্ষার দিকে ঝাঁপিয়ে না পড়ে বৃত্তিমূলক শিক্ষায় নিজেদেরকে শিক্ষিত করে তোলা । তাহলে একদিকে যেমন নিজের উন্নতি নিশ্চিত হতে পারে, তেমনি হতে পারে দেশের কল্যাণ ।
আপনার পছন্দ হতে পারে এমন আরও পোস্টের তালিকা