উপস্থাপনা :
ভাল লাগা ও মন্দ লাগার বিচারে কাজী নজরুল ইসলামই আমার প্রিয় কবি। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তিনি অবাধে বিচরণ করলেও মূলত বিদ্রোহী কবি হিসেবেই তিনি আমাদের কাছে এবং বিদেশেও পরিচিত। কাজী নজরুল ইসলামের লেখনীতে আমি আমার চিন্তা-চেতনার প্রকাশ দেখতে পাই, এজন্যই তিনি আমার প্রিয় কবি।
প্রিয় হওয়ার কারণ :
আমি অন্যায় পছন্দ করি না। অন্যায়কে প্রশ্রয়ও দিতে চাই না। সাধ্যানুযায়ী অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চেষ্টা করি। আমার প্রিয় কবি, একজন বিদ্রোহী কবি। তিনি তাঁর ভাষা ও শক্তি দিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে গেছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি কবিতা লিখেছেন। একমাত্র নজরুলই নির্ভয়ে বলতে পেরেছেন-
“কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট”, লাথি মারি ভাংরে তালা, যত সব বন্দিশালা আগুন জ্বালা' এসব জ্বালাময়ী কবিতা। তিনি শুধু কবিতাই লেখেননি; বরং বাঙালি পল্টনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে সৈনিক জীবন বরণ করেন। এজন্য তিনি আমার প্রিয় কবি।
আরও পড়ুন :- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর - রচনা [ Class - 6, 7, 8 ,9 ,10] | PDF
নিম্নে তাঁর জীবনকাল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
জন্ম ও বংশ পরিচয় :
কবি কাজী নজরুল ইসলাম ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে) এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ ও মাতার নাম জাহেদা খাতুন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, কবির পূর্বপুরুষ চুরুলিয়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। আট বছর বয়সে তিনি পিতাকে হারান। নজরুলের জীবনে তাঁর চাচা ফজলে করিমের প্রভাব অপরিসীম। তাঁর বাল্যশিক্ষা অসমাপ্ত থেকে যেত যদি তিনি চাচার সহায়তা না পেতেন ।
বাল্যকাল :
বাল্যকালে তিনি খুব ডানপিটে ও স্বাধীনচেতা ছিলেন। কোনো বাঁধাধরা নিয়ম-কানুন তিনি পছন্দ করতেন না। এজন্য নিয়মিত স্কুলেও যেতেন না। পিতৃহীন হওয়ার কারণে কবি পরিবারে আয়-রোজগারের কেউ ছিল না। ফলে তাঁদের দৈনন্দিন জীবন খুব কষ্টে কাটত । সাংসারিক খরচ মেটাতে তাকে বাল্য বয়সেই বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হতে হয়েছে।
শিক্ষাজীবন :
প্রথমে তিনি গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করেন। বাংলাভাষা ছাড়া তিনি আরবি এবং ফারসি ভাষাও শিক্ষা করেন। তিনি অত্যন্ত সুন্দর করে কুরআন পড়তে পারতেন। নজরুল ১০ বছর বয়সে ঐ মক্তব থেকে নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষায় পাস করেন। তারপর তিনি রাণীগঞ্জের নিকটবর্তী শিয়ারশোল রাজস্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু স্বাধীনচেতা নজরুলের স্কুলের নিয়মকানুন পছন্দ হলো না। তাই সেখান থেকে তিনি আসানসোলে পালিয়ে যান এবং একটি রুটির দোকানে মাসিক ৫ টাকা বেতনে কাজ করতে থাকেন।
এ সময় ময়মনসিংহ জেলার কাজী রফিক উদ্দীন আসানসোলের দারোগা ছিলেন। তিনি নজরুলের চোখেমুখে বুদ্ধির দীপ্তি দেখে তাঁকে স্বগ্রামে নিয়ে যান এবং ময়মনসিংহ জেলাধীন ত্রিশালের দরিরামপুর হাই স্কুলে ভর্তি করান। তিন বছর পর নজরুল সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে সিয়ারসোল স্কুলে ভর্তি হন ।
ছন্নছাড়া জীবন :
সংসারে অভাব-অনটনের কারণে কবিকে অনেক কাজ করতে হয়েছিল। অর্থ উপার্জনের জন্য তিনি লেটোর দলে যোগ দেন। এসব করেও সংসারের অভাব মিটছিল না বলে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। আরম্ভ হয় তাঁর সৈনিক জীবন ।
সৈনিক জীবন :
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। কবি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। লেখাপড়া ছেড়ে ১৪নং বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে তিনি করাচি চলে যান। সৈন্য বিভাগে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি হাবিলদার কোয়ার্টার মাস্টার পদে উন্নীত হন। সেখানেও তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি বিয়ে করেন প্রমীলা দেবীকে। কিন্তু ঘরের মোহ তাঁর সদাচঞ্চল জীবনকে কোনোভাবেই রুদ্ধ করতে পারেনি।
আরও পড়ুন :- আমার প্রিয় শখ - বাংলা রচনা |Sikkhagar
জাতীয় আন্দোলন :
বাংলা সাহিত্যে তিনি সংযোজিত করেছেন এক নতুন মাত্রা- বিদ্রোহ। নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষকে তিনি বিদ্রোহের মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী শাসকের যুগেই তাঁর আবির্ভাব। তিনি সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তিমূলে চপেটাঘাত করেন। তাঁর কাব্যিক শক্তি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে এক নতুন আবহ যোগ করেছিল।
কবি প্রতিভা :
১৯১৮ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা 'মুক্তি' ছাপা হয়। এ কবিতা রচনা করে নজরুল অশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর 'বিদ্রোহী' কবিতাটি ১৯২০ সালে 'মোসলেম ভারত' পত্রিকায় ছাপা হয়। এরপর তিনি অজস্র রচনার মাধ্যমে পাঠকদেরকে বিস্ময়াভিভূত করে দেন । অসংখ্য কবিতা ও ইসলামী সংগীত রচনা করে তিনি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তোলেন।
কাব্য সাধনা :
তিনি আজীবন কাব্য সাধনা করে গেছেন। বিদ্রোহী, কামাল পাশা, সর্বহারা, ফণিমনসা, জিঞ্জির প্রভৃতি নজরুলের জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ। তাছাড়া ‘আলেয়া', 'ঝিলিমিলি' প্রভৃতি নাটকও তিনি রচনা করেন। ব্যথার দান, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা প্রভৃতি উপন্যাস তাঁর অপূর্ব সৃষ্টি ।
বহুমুখী প্রতিভা :
কবি নজরুল ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, কুরআনের অনুবাদ, ইসলামী সাহিত্য, শ্যামা সংগীত, ইসলামী সংগীত ইত্যাদি সবকিছুতেই তাঁর দখল ছিল। তিনি ভালো গায়কও ছিলেন। তাঁর বহু গানের রেকর্ড আছে। তাঁর গজল আজও বাংলার মুসলমানদেরকে আলোড়িত করে।
মৃত্যু :
এ মহৎ কবির সুস্থ আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র তেতাল্লিশ বছর। মৃত্যুর পূর্বে তিনি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন এবং এতে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার পিজি হাসপাতালে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় ।
উপসংহার :
কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্বল্পকালের মধ্যে আমাদের জন্য রেখে যান গৌরবময় সাহিত্যকর্ম। আমরা তাঁকে মর্যাদার সাথে স্মরণ করি। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘ডক্টর অব লিটারেচার' উপাধিতে ভূষিত করে ।
আপনার পছন্দ হতে পারে এমন আরও পোস্টের তালিকা