রচনা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (২৫ পয়েন্ট)

Table of Contents

উপস্থাপনা : 

দীর্ঘদিনের সংগ্রাম ও লক্ষ জনতার জীবনদানের এক রক্তিম ইতিহাস বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। ইংরেজ শাসন অবসানের মধ্য দিয়ে স্বপ্নের পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও পাকিস্তানি শাসকগণ পরিণত হয় শোষকে। তাদের বৈষম্যমূলক আচরণ আর শোষণ নিষ্পেষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে আন্দোলনে গর্জে ওঠে বাংলার জনগণ । কালে তা রূপ নেয় স্বাধীনতা সংগ্রামে। অবশেষে নয় মাস সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের পর উদিত হয় স্বাধীন বাংলার নবীন সূর্য ।

ব্রিটিশ শাসন :

বাঙালির একেবারে প্রাচীন ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবময়। একদিন এদেশে ছিল গোয়াল ভরা গরু, গলা ভরা গান, পুকুর ভরা মাছ, গোলা ভরা ধান, আঙিনা ভরা গাছ। এদেশের ছিল উঁচুমানের মসলিন—যা বাগদাদ, রোম, চীন সমস্ত দেশে রাপ্তানি হতো। বাংলার সম্পদের লোভে ব্রিটিশ বেনিয়ারা এদেশে আস্তানা গড়ে । এক সময় তারা এদেশের ক্ষমতাও হস্তগত করে নেয়। তারপর চলে সুদীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস। তিতুমীর, হাজী শরিয়তউল্লাহ, ফকির মজনু শাহ, মাস্টারদা সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম— একে একে অনেকেই প্রাণ বিসর্জন দেন দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য।

পাকিস্তান আমল :

দু’শ বছর লুটেপুটে সবকিছু শেষ করে ব্রিটিশ সিংহ লেজ গুটিয়ে পালাল। রেখে গেল শুধু এক নগ্ন ধ্বংসস্তূপ। অতঃপর হিন্দু ও মুসলিমদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি হিসেবে ভারত ও পাকিস্তান বিভক্ত হলো। পাকিস্তানের একটি প্রদেশে পরিণত হলো বাংলাদেশ, যার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। দমননীতি, শাসন, ত্রাস, অত্যাচার আনাচার, পীড়ন-নিপীড়ন, লাঞ্ছনা যত ধরনের অত্যাচার ছিল, সবই তারা বাঙালির ওপর প্রয়োগ করেছে। এদেশের টাকা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে মিল ফ্যাক্টরী হয়েছে, অথচ এদেশ শূন্যই রয়েছে। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা একমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানীরাই ভোগ করত। ব্যবসায় বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি সর্বক্ষেত্রে ছিল তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য। এসব দেখে দেখে ক্ষুদ্ধ বাঙালি স্বাধিকারের স্বপ্ন দেখতে থাকে।

স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্বকথা : 

স্মরণাতীতকাল থেকেই বাংলাদেশ ছিল পরাধীন এবং বাঙালিরা ছিল শোষণ বঞ্চনার শিকার। প্রায় দুশ বছরের ইংরেজ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৪৭ সালে জন্ম নেয় স্বাধীন পাকিস্তান, কিন্তু পাকিস্তানি শাসকদের একরোখা শাসননীতির ফলে আমরা ছিলাম শোষিত। আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে তারা স্বীকৃতি দেয়নি। 

ফলে ১৯৫২ সালে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে।বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উত্থাপিত হয়। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারে আটক করলে জনগণের তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা : 

গণআন্দোলনের মুখে জেনারেল আয়ুব খানের পদত্যাগের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৬৯ সালে পুনরায় সামরিক শাসন জারি করেন। তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেই ঘোষণা করলেন, শীঘ্রই সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সামরিক বাহিনী ব্যারাকে ফিরে যাবে।

আরও পড়ুন :- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

১৯৭০-এর জাতীয় নির্বাচন : 

ইয়াহিয়া খানের ঘোষণানুযায়ী ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩৯০টি আসনের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পি.পি.পি) ৮৮টি আসনে আর আওয়ামী লীগ ২৯৮টি আসনে জয়ী হয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ।

ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি : 

নির্বাচনের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে ইয়াহিয়া খান গড়িমসি শুরু করেন। 

অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা : 

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর পরামর্শে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনের তারিখ ঘোষণা করেন। ইত্যবসরে জুলফিকার আলী ভুট্টো এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলাপ আলোচনা করে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যান, কিন্তু ইয়াহিয়া খান হঠাৎ ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন ।

অসহযোগ আন্দোলন : 

১ মার্চের ইয়াহিয়া খানের ঘোষণায় পূর্ব পাকিস্তানের জনতা হতবাক হয়ে আওয়ামী লীগের হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন :- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস – রচনা ২০পয়েন্ট | PDF

রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ : 

অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনার জন্য ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন-

* সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।

* অবিলম্বে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে।

* সামরিক বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করতে হবে।

* জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের পূর্বেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

এ আহ্বানে সকল অফিস আদালত, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় এবং স্বাধীনতা আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে।

আলোচনার প্রহসন : 

১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে ১৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বৈঠকে বসেন। তিনি ভুট্টো সাহেবকেও ঢাকায় ডেকে পাঠান। দীর্ঘ দশ দিন পর্যন্ত আলোচনা চলে। এ আলোচনা ছিল প্রহসন মাত্র।

ছয় দফা দাবি উত্থাপন :

এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে বাঙালির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন। বাংলার এই অবিসংবাদিত নেতা, প্রবাদ পুরুষকে দমন করার জন্য পাকিস্তানীরা নানা ষড়যন্ত্রে মেতে উঠল। তারা বুঝতে পেরেছিল, তাকে যদি দমন করা না যায়, তবে একদিন এর মাশুল দিতে হবে। তাই তারা মিথ্যা মামলায় ঝুলিয়ে দিল শেখ মুজিবকে। ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলার আসামী হিসেবে শেখ মুজিবকে যে লাঞ্ছনা দেয়া হয়েছিল, তাতে সমস্ত বাঙালি প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে, পরিস্থিতি অনিয়ন্ত্রিত হওয়ায় আইয়ুব খান শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এমনকি আন্দোলন ও চাপের মুখে সে অবশেষে পদত্যাগ করতেও বাধ্য হয়।

তীব্র আন্দোলন শুরু ও গণপ্রতিরোধ :

আলোচনার নামে এহেন প্রহসনের বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলন শুরু হলে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান এ আন্দোলন চিরতরে স্তব্ধ করার লক্ষ্যে ২৫ মার্চ গভীর রাতে জনগণের ওপর সেনাবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে পাড়ি জমান। শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘুমন্ত জনগণের ওপর সেনাবাহিনীর অতর্কিত হামলায় ঢাকা শহর ভয়াল মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়।

স্বাধীনতা ঘোষণা : 

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেন। এ ঘোষণার সাথে সাথেই সর্বত্র সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয়।

অস্থায়ী সরকার গঠন : 

১০ এপ্রিল পূর্ব বাংলার নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যরা মুজিবনগরে এক অধিবেশনে মিলিত হয়ে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র ঘোষণা দেয় এবং ১৭ এপ্রিল বহুসংখ্যক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক, গণপরিষদ সদস্য ও মুক্তিকামী জনতার উপস্থিতিতে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরে আম বাগানে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহণ করে এবং মেহেরপুরকেই মুজিবনগর নাম দিয়ে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করা হয় ।

আরও পড়ুন :- মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান- রচনা [Class – 6, 7, 8 ,9 ,10]এবং hsc

মুক্তিবাহিনী গঠন ও চূড়ান্ত বিজয় : 

অস্থায়ী সরকার গঠনের পর মুক্তিবাহিনী গঠিত হয় এবং কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক করা হয়। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। এ দেশের অগণিত ছাত্র-জনতা, পুলিশ, ই.পি.আর, আনসার ও সামরিক বেসামরিক লোকদের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়। তারা পাক-বাহিনীর মুখোমুখি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে পাকবাহিনীর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়ে। আর কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নিঃশর্তভাবে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রাপ্তি : 

পাকিস্তানি শোষকদের শোষণ-বঞ্চনা ও ভেদ-বৈষম্যের অবসান, অর্থনৈতিক মুক্তি, সর্বোপরি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হলো স্বাধীনতার চার দশক পরও মুক্তিযুদ্ধের এ চেতনা অদ্যাবধি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পাকিস্তানের গোলামি হতে মুক্তি পেলেও বর্তমানে এ দেশ প্রতিবেশী আধিপত্যবাদী ভারতের আগ্রাসনের নিগড়ে আবদ্ধ।

স্বাধীনতার পরপরই ভারত বাংলাদেশের কল-কারখানা লুট করে নিয়ে এর শিল্প ধ্বংস করে বাংলাদেশকে ভারতের বাজারে পরিণত করে। ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে সুজলা-সুফলা এ দেশকে মরুভূমিতে পরিণত করে। এছাড়া সাংস্কৃতিক আগ্রাসনসহ স্বাধীনতার পূর্বে যা করার সুযোগ পায়নি তার সবই এখন করতে ব্যস্ত রয়েছে তারা। 

বর্তমানেও সীমান্তে মানুষ হত্যাসহ করিডোর ব্যবহার, ট্রানজিট সুবিধা ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। এখনো এ দেশের মানুষ ঘুমায় পথের ধারে, এখনো মানুষ মরে অনাহারে, এখনো মসজিদের ইমামকে গুম হত্যা করা হয়, মন্দিরের জমি জায়গা দখল করা হয়। এখনো মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে মানুষ বঞ্চিত হয়। আর এসবই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি।

মুক্তিযুদ্ধের ডাক : 

চক্রান্তকারী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী একদিকে আলোচনার নামে প্রহসন, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিপুল সংখ্যক সৈন্য ও অস্ত্র এদেশে পাঠাতে থাকে । অসহযোগ আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে তদানীন্তন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ২৫ মার্চ মধ্য রাতে পূর্ববাংলার ঘুমন্ত নিরীহ মানুষের ওপর আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে। তারা নির্মমভাবে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।

ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে বাঙালির অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে ওয়্যারলেস বার্তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন ।
 

২৬ মার্চ চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হান্নান বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন। এ দেশের আপামর মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ই.পি.আর, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ছুটি ভোগরত সৈনিক, অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক, সশস্ত্র পুলিশ, আনসার, ছাত্র-যুবকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রতিরোধ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।

আরও পড়ুন :- একুশে ফেব্রুয়ারী  – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

২৫ শে মার্চ এক কালো রাত :

এ দিকে ২৫ শে মার্চের কাল রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। “মাটি চাই মানুষ চাই না” এ দমননীতির ক্রোধে উত্তেজিত হানাদার বাহিনী এক পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। শহরে-নগরে, গ্রাম-গঞ্জে তারা আক্রমণ চালায়, ধর্ষণ করে, পুড়তে থাকে দোকান পাট। প্রাণের ভয়ে প্রায় দু’কোটি বাঙালি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। তবে বীর বাঙালিও এদিকে চুপ করে বসে থাকেনি। আন্দোলনে নেমে পড়ে। এদেশের আবাল-বৃদ্ধ সকলে এ স্বাধিকার সংগ্রামে শরীক হয়।

সুরক্ষিত, সুশিক্ষিত, সুসজ্জিত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে গড়ে তোলে এক অপ্রতিরোধ্য প্রতিরোধ।৭ মার্চ রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দিয়েছিলেন, এ বারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তিনি আরো বলেছিলেন, ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়। তার এ ডাকে সমগ্র বাঙালি সাড়া দিল। দলে দলে তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। অতঃপর সীমান্তে সীমান্তে, দেশের অভ্যন্তরে সমস্ত জায়গায় খণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

এভাবেই শুরু হলো বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলন। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের ওপর আক্রমণ করে বসল। তখন ভারত ও বাংলাদেশ একত্রে যুদ্ধ শুরু করল। মিত্র বাহিনীর সাথে না পেরে অবশেষে পাকিস্তানি বাহিনী নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চেতনার রঙে রাঙানো একটি মানচিত্র ‘বাংলাদেশ’ লাভ করল।

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও শরণার্থী শিবির : 

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের কারণে এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নেয়। তাদের ঠাঁই হয় শরণার্থী শিবিরে। সেখান থেকে আগ্রহী ও উপযুক্ত লোকদের বাছাই করে তাদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

সেক্টর কমান্ডারদের অধীনে তারা গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত ও হীনবল করে ফেলে । গ্রাম ও শহরের মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসাসেবাসহ নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে মুক্তিযুদ্ধকে বিজয়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় ।

মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন : 

ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার জনগণ ও সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সরাসরি সমর্থন করে । এছাড়া যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি প্রভৃতি দেশের অসংখ্য বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, শিল্পী-সাহিত্যিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে নানাভাবে অকুণ্ঠ সাহায্য-সহযোগিতা করেন। ফলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নাজুক অবস্থায় পড়ে মনোবল হারিয়ে ফেলে।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয় :

মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে ভীত-সন্ত্রস্ত হানাদার বাহিনী গ্রামাঞ্চল ছেড়ে শহরে পালাতে থাকে । ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে বিমান হামলা চালায়। এ সময় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী চারদিক থেকে যৌথ অভিযান শুরু করে এগুতে থাকে ঢাকার দিকে। যৌথবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণ ও বোমাবর্ষণের মুখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। 

১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা ১ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হানাদার বাহিনী বিনা শর্তে যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। জেনারেল নিয়াজী, তাঁর নিজ পোশাক থেকে সামরিক ব্যাজগুলো খুলে অবনত মস্তকে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ জাতীয় পতাকা উন্নত শিরে তার বিজয় গৌরব ঘোষণা করে। 

মুক্তিযুদ্ধের খেতাব : 

মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষের জীবনদান, আড়াই লাখ নারীর সম্ভ্রম ও কোটি কোটি টাকার সম্পদের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। যারা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য অকুতোভয় সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করতে করতে জীবনদান করেছেন, তাঁদের সর্বোচ্চ ত্যাগের প্রতি সম্মানস্বরূপ দেওয়া হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ’, ‘বীরউত্তম’, ‘বীরবিক্রম’ ও ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব। 

বীর শহিদদের মধ্যে সাতজন পেয়েছেন ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাব, এঁরা হলেন- সিপাহি মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল, ন্যান্সনায়েক মুন্সী আবদুল রউফ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান, ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ, সিপাহি হামিদুর রহমান, স্কোয়াড্রন ইঞ্জিনিয়ার রুহুল আমিন ও ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর আমাদের সামনে এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে তাঁদের মৃত্যুঞ্জয় স্মৃতি ।

ভারতের সহযোগিতা ও স্বীকৃতি প্রদান :

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। ভারত অস্ত্র, সেনাবাহিনী ও কূটনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে অনেক দূর এগিয়ে দেয়। যুদ্ধে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী বুঝতে পেরে পাকিস্তান এ যুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধ আখ্যায়িত করে আন্তর্জাতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা চালায়। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়া এতে ভেটো প্রয়োগ করায় জাতিসংঘ যুদ্ধ থামানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়। ৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমানহামলা করার পর ঐদিনই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন ।

উপসংহার : 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির ইতিহাসে এক সোনালি অধ্যায়। এ অধ্যায় বড় উজ্জ্বল, অত্যন্ত বেদনা ও আনন্দের। মুক্তিযুদ্ধ থেকেই বাঙালির সত্তায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনের চেতনা জন্ম নেয়। তবে স্বাধীনতার চার দশক পরেও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সাংস্কৃতিক আযাদির জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য দল-মত-জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে নতুন করে শপথ নিতে হবে।

আমার মূল লক্ষ্য একটাই (Sikkhagar-শিক্ষাগার) ওয়েবসাইটের হাত ধরে “শিক্ষা হবে উন্মুক্ত ও বাণিজ্যমুক্ত”। এই প্লাটফর্মে থাকবে একাডেমিক প্রস্তুতি, ভর্তি প্রস্তুতি, চাকরি প্রস্তুতি, স্পেশাল স্কিল এবং ধর্মীয় শিক্ষাসহ নানাবিধ বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!