বিজয় দিবস - রচনা [ class 6, 7, 8, 9 ] এবং HSC

উপস্থাপনা : 

পৃথিবীর প্রত্যেক দেশের মানুষের জাতীয় জীবনে বিশেষ কতকগুলো গৌরবময় দিন রয়েছে, যা অমলিন তাৎপর্যে । রাষ্ট্রীয় এমনি একটি মর্যাদাপূর্ণ দিবস। বাংলাদেশের বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর। গর্ব ও আনন্দের সাথে এ দিনটিকে আমরা প্রতিবছর গভীর শ্রদ্ধার সাথে উদযাপন করি। তবে স্বাধীনতার চার দশকের অধিক সময় অতিক্রমকালে আজ আমাদের সময় এসেছে এ দিবসটির তাৎপর্য পুনর্মূল্যায়নের ।

বিজয়ের প্রকৃত অর্থ : 

প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর আমাদের জীবনে নিয়ে আসে সংগ্রামী বিজয়ের স্মৃতি । জীবনকে গৌরবান্বিত করে গড়ে তোলার শপথ এ পবিত্র দিনটি থেকেই আমাদেরকে গ্রহণ করতে হবে। বিজয় অর্জন বড় কথা নয়, তার সুফলকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়াই বড় কথা। ‘স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন'- এ আপ্তবাক্যটিকে আমাদের ভুলে গেলে বিজয় দিবসের তাৎপর্য অর্থহীন হয়ে পড়ে।

বিজয় দিবস উদযাপন : 

বাঙালি জাতি এদিনই স্বাধীন জাতি হিসেবে দীর্ঘদিনের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে সগৌরবে জয়যাত্রা শুরু করেছে। তাই প্রতিবছর যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বিজয় দিবস উদযাপিত হচ্ছে। এ দিনে সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ দিনটি সরকারি ছুটির দিন। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন শোভাযাত্রা, র‍্যালি, আলোচনা সভা, সেমিনার, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা প্রভৃতির মাধ্যমে দিবসটিকে উদযাপন করে থাকে ।

আরও পড়ুন :- স্বাধীনতা দিবস রচনা ১০০ শব্দ , ২০০ শব্দ এবং ৫০০ শব্দ

বিজয় দিবসের তাৎপর্য : 

আমাদের জাতীয় জীবনে ১৬ ডিসেম্বর তথা বিজয় দিবসের তাৎপর্য অপরিসীম। ১৯৭১ সালের এই দিনে আমরা অর্জন করেছিলাম আমাদের প্রাণের স্বাধীনতা, আমাদের স্বপ্নের স্বাধীনতা। লাখো প্রাণের রক্তঋণে অর্জিত এই ১৬ ডিসেম্বরের স্বাধীনতা অনাগত বাঙালির হৃদয়পটে অম্লান, অমলিন, অক্ষয় হয়ে থাকবে। 

বিজয় লাভের ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে আত্মদানের এক সুমহান ঐতিহ্য। মধ্যযুগে মুঘল ও নবাবি আমলে ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামে বাংলার মানুষ অনেক রক্ত ঝরিয়েছিল। সর্বশেষ আমরা রক্ত ঝরিয়েছি পাকিস্তানি শাসকচক্রের ঔপনিবেশিক শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে। বাঙালির আন্দোলন সর্বদাই রক্ত আখরে লেখা। 

এদেশের মানুষ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত করেছিল আওয়ামী লীগকে। কিন্তু পাক শাসকরা গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল না। তারা বাঙালিদের স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য লেলিয়ে দিয়েছিল রক্তলোলুপ বর্বর বাহিনী । কিন্তু কোনোভাবেই দাবিয়ে রাখতে পারেনি বীর বাঙালি জাতিকে। 

আরও পড়ুন :- একুশে ফেব্রুয়ারী  - বাংলা প্রবন্ধ রচনা

অবশেষে দীর্ঘ ৯ মাসের সংগ্রামে ৩০ লাখ জীবনের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা তথা জাতীয় বিজয়। বাঙালির ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তাই এক অবিস্মরণীয় দিন। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি ১৯৭১ সালে- আজ থেকে প্রায় চার যুগেরও বেশি সময় আগে। প্রতিবছর এই দিনে আমরা আনন্দে উদ্বেলিত হই, বিজয়ের উচ্ছ্বাসে মেতে উঠি ।

আধুনিককালে স্বাধীনতার সংজ্ঞার্থ ব্যাপকতা পেয়েছে। এখন স্বাধীনতা মানে পৃথক পতাকা আর ভূখণ্ডগত অধিকার নয়। এ স্বাধীনতা তখনই অর্থবহ হয়ে উঠবে যখন একটি জাতি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নতির পাশাপাশি গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে। অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া স্বাধীনতার মূল্য নিতান্তই তুচ্ছ। 

বর্তমান বিশ্বে দরিদ্র দেশগুলো উন্নত বিশ্বের প্রতি সর্বতোভাবে নির্ভরশীল। ধনী দেশগুলোর খবরদারি আচরণও স্বাধীন দেশের জন্য অপমানজনক । অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে এসব দেশে গণতান্ত্রিক কাঠামোও দৃঢ়ভিত্তি পায়নি। সামাজিক প্রগতি ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা এখানে পদে পদে বাধাগ্রস্ত । তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। 

স্বাধীনতা লাভের চার দশক পরেও আমাদের সমাজ শিক্ষাদীক্ষায় পশ্চাৎপদ । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দেশের অগ্রগতি হতাশাব্যঞ্জক। দেশের ৩০% লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে । অপুষ্টি, রোগ, জরা মানুষের নিত্যসঙ্গী। সাহায্যনির্ভর অর্থনৈতিক ভিত্তির কারণে বিদেশি সংস্থা ও ধনী দেশগুলো আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়েও হস্তক্ষেপ করছে। বেকারত্ব, সামাজিক অবক্ষয় ও দুর্নীতি সমাজকে কুরে কুরে খাচ্ছে। 

আরও পড়ুন :- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস - রচনা [ Class- 6, 7, 8 ,9 ,10, HSC ]

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব ও সন্ত্রাস জাতিকে ভাবিয়ে তুলেছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁরা একটি অসাম্প্রদায়িক, মুক্ত ও গণতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁরা তাঁদের বুকের রক্তে যে বাংলাদেশের নাম লিখেছিলেন তা যে আজকের বাংলাদেশ নয়, একথা জোর দিয়েই বলা যায় ।

আজ আমরা যে বিজয় দিবস উদযাপন করছি তা কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে এ দিনে আমাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে একটি সুখী, সমৃদ্ধিশালী ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার। অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্য সুশাসন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা ও বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরতা থেকে আমাদের মুক্ত থাকতে হবে।

১৯৭১ সালে আমরা বিজয়ী হয়েছি অস্ত্রধারী শত্রুদের বিরুদ্ধে। আজ আমাদের লড়াই দুর্নীতি, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, রোগশোক, অশিক্ষা ও অজ্ঞতার মতো কঠিন ব্যাধির বিরুদ্ধে। এসবের বিরুদ্ধে আমরা যেদিন বিজয়ী হব সেদিনই আমাদের প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জিত হবে, সেদিনই বিজয় হয়ে উঠবে অর্থবহ। আল্লাহ আমাদের সোনার বাংলাদেশ গড়বার শক্তি দিন।

বিজয় দিবস ও আমাদের প্রত্যাশা : 

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যকে সামনে রেখেই সূচিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। রাজনৈতিক মুক্তি অর্জিত হলেও দেশের আপামর জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি আজো অর্জিত হয়নি। প্রতিবছর বিজয় দিবসের আদর্শ আমাদের কর্ণকুহরে যে বার্তা শোনায়, বাস্তব জীবনে আমরা তা ভুলে যাই বার বার। 

তবু বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অদম্য প্রতিজ্ঞায় ঋদ্ধ হয়ে উঠি আমরা। আমরা বিজয়ের তাৎপর্যকে যথার্থতা দানে সফল হলেই এ দিবস উদযাপনের সার্থকতা ফুটে উঠবে।

উপসংহার : 

একজন মানুষের কাছে স্বাধীনতার চেয়ে প্রিয় আর কিছু নেই। পরাধীনতা আর দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়। কেননা, স্বাধীনতা ব্যতীত কোনো জাতিই বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে সকলকে একযোগে দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করে যেতে হবে।

Post a Comment

0 Comments