ভূমিকা :
মানুষের কাছে যা কিছু প্রাণের মতো প্রিয় তার একটি হচ্ছে মাতৃভাষা, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের সকল মানুষের একটি মৌলিক সম্পদ মাতৃভাষা। এই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করতেই ১৯৫২ সালে বাংলার দামাল ছেলেরা অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল । তাঁদের স্মৃতিতে নির্মিত হয়েছে শহিদ মিনার।
শহিদ মিনার সৃষ্টির পটভূমি :
১৯৫২ সালে পাকিস্তান মুসলিম লীগের ডাকা অধিবেশনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ঘোষণা দেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা'। এ ঘোষণার প্রতিবাদে সারা বাংলা মুখর হয়ে ওঠে। ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ প্রতিবাদ দিবস, ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস পালিত হয়। এবং ২১ ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে শাষক গোষ্ঠী ২১শে ফেব্রুয়ারিতে সকল সভা, মিছিল, মিটিং ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করার জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ছাত্রজনতা এই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে আসলে পুলিশ মিছিলে গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, জব্বার, রফিকসহ আরও অনেকে শহিদ হন । এই ভাষাশহিদের স্মৃতি রক্ষার্থেই নির্মিত হয় শহিদ মিনার।
আরও পড়ুন :- বিজয় দিবস - রচনা [ class 6, 7, 8, 9 ] এবং HSC
প্রথম শহিদ মিনার :
ভাষাশহিদদের এই আত্মত্যাগকে অম্লান করে রাখার জন্যে ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি অক্লান্ত পরিশ্রম করে ছাত্রজনতা একটা শহিদ মিনার নির্মাণ করে। দুজন রাজমিস্ত্রিসহ প্রায় তিনশ ছাত্র এ কাজে অংশ নেয়। এই শহিদ মিনারটি নির্মাণের জন্য সাইদ হায়দার ৯ ফুট উচ্চতার মিনারের নকশা করলেও তৈরির পর এটির উচ্চতা হয় ১১ ফুট।
২৪শে ফেব্রুয়ারি শহিদ শফিউরের পিতা এটি উদ্বোধন করেন। কিছু দিনের মধ্যেই পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী এই শহিদ মিনারটি ভেঙে ফেলে। কিন্তু তাদের সে উদ্দেশ্য বিফলে যায়। কেননা বাঙালির হৃদয়ে এ মিনারের আবেদন চিরঅম্লান হিসেবে রয়ে যায়।
আজকের শহিদ মিনার :
স্থপতি হামিদুর রহমান বর্তমান শহিদ মিনারটির নকশা করেন। পরবর্তীতে শহিদ মিনারটির আরও সংস্কার করা হয়। বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে আমরা যে শহিদ মিনারটি দেখতে পাই সেটিই হামিদুর রহমানকৃত চূড়ান্ত নকশার পরিপূর্ণ রূপ। প্রত্যেক বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি জনসাধারণ এ মিনারের সামনে ভাষা শহিদদের উদ্দেশে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। এই শহিদ মিনারের আদলেই বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে।
শহিদ মিনারের তাৎপর্য :
হামিদুর রহমানের নকশাকৃত শহিদ মিনারের মিনার ও তার স্তম্ভগুলো মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার তথা মা ও তাঁর শহিদ সন্তানদের প্রতীক। শহিদ মিনারের মাঝের সবচেয়ে উঁচু স্তম্ভটি মায়ের প্রতীক। চারপাশের ছোট চারটি স্তম্ভ সন্তানের প্রতীক, যাদের বুকের রক্তে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আমাদের সমস্ত প্রেরণার প্রতীক শহিদ মিনার।
আরও পড়ুন :- একুশে ফেব্রুয়ারী - বাংলা প্রবন্ধ রচনা
ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সমস্ত আন্দোলন- সংগ্রামে বাঙালির প্রেরণাস্থল এই শহিদ মিনার। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের অন্যতম প্রেরণা একুশে ফেব্রুয়ারি । যখনই বাঙালি কোনো অন্যায়ের শিকার হয় তখনি সেই অন্যায়ের প্রতিবাদে শহিদ মিনারে গিয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে।
শহিদ মিনার ও আমাদের সংস্কৃতি :
শহিদ মিনারের সাথে বাঙালির আত্মিক সম্পর্ক বিদ্যমান। দেশে সংঘটিত সমস্ত অন্যায়ের প্রতিবাদের সূচনা ঘটে এই শহিদ মিনার থেকেই। বিভিন্ন জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠান হয় শহিদ মিনার প্রাঙ্গনে। এমনকি দেশ বরেণ্য কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করার জন্য মৃতদেহ শহিদ মিনারে রাখা হয় ।
উপসংহার :
শহিদ মিনার আমাদের সংগ্রাম এবং অন্যায়ের প্রতিবাদের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়। ২১শে ফেব্রুয়ারির জন্য আমরা নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারছি। ভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গের এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
বাঙালির এই আত্মত্যাগের ইতিহাস আজ সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। ২১শে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পেয়েছে। শুধু বাঙালি নয় বাঙালির সাথে আজ সারা বিশ্বের মানুষ শহিদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষাশহিদদের আত্মত্যাগের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে ।
আপনার পছন্দ হতে পারে এমন আরও পোস্টের তালিকা