রচনা: রূপসী বাংলা/বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-Class 6,7,8,9,10

ভূমিকা : 

অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ বাংলাদেশ। সবুজ শ্যামল প্রকৃতির জন্য এর প্রশংসা যুগ যুগ ধরে কবি-সাহিত্যিকদের লেখনিতে প্রকাশিত হয়েছে। জালের মতো অসংখ্য নদনদী, কিছু অরণ্য আর শিলাময় উঁচু ভূমি নিয়ে আমাদের এই বাংলাদেশ। ছবির মতো সারি সারি গ্রাম, আঁকাবাঁকা নদী, দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের ক্ষেত; বন-বনানীতে পাখ-পাখালির মিষ্টি কলরবে মুখরিত এদেশ। এদেশের বনে বনে ফুলের সমারোহ, মাঠে মাঠে বিচিত্র ফসলের আগমনী গান। নদনদী, খালবিলে মাছের লুকোচুরি খেলা, এসব প্রাকৃতিক দৃশ্য দেশকে করেছে অনন্য সুন্দর। 

বাংলার ভূপ্রাকৃতিক সৌন্দর্য : 

এদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে রয়েছে পাহাড়িয়া বনভূমির বিচিত্র বিস্তার। চট্টগ্রামে একদিকে সমুন্নত পর্বতশীর্ষ, অন্যদিকে নীল সমুদ্রের বিস্তার। এদিকে ঢাকা ও ময়মনসিংহ এলাকাজুড়ে বিস্তৃত রয়েছে ঢেউ দোলানো মধুপুর আর ভাওয়ালের গড়। সিলেটের টিলায় টিলায় চা গাছের সাজানো বাগান অপরূপ ঐশ্বর্যে মহান আল্লাহ যেন সৃষ্টি করেছেন সবুজের পরিকল্পিত সিঁড়ি। উত্তরাঞ্চলে সমতল ভূমির ধু-ধু মাঠ শুকনো মৌসুমে আনে মরুভূমির আমেজ। দেশের দক্ষিণ পশ্চিম সমুদ্র সমতলে অবস্থিত খুলনার সুন্দরবন সৌন্দর্যের এক মোহনীয় লীলাভূমি। আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, যার বুকে জেগে আছে অপূর্ব সুষমায় মণ্ডিত অসংখ্য সবুজ দ্বীপ।

পল্লি প্রকৃতির দৃশ্য : 

বাংলাদেশের সবুজ পল্লি প্রকৃতির রূপ সত্যিই আকর্ষণীয়। দেখলে মনে হয় যেন সৌন্দর্যের হাট বসেছে আমাদের প্রিয় এই মাতৃভূমিতে। যেদিকেই তাকানো যায়, বিচিত্রবেশী প্রকৃতি হাতছানি দিয়ে ডাকে। কোথাও অন্তহীন সবুজের বিস্তার দিগন্তে বিলীন হয়েছে, আবার কোথাও বৃক্ষলতা বেষ্টিত ছায়াসিগ্ধ পল্লির কুটিরগুলো শান্তভাবে সবাইকে যেন বিশ্রামের জন্য আহ্বান করছে। বাংলার গ্রামের আম-জাম-কাঁঠালের ছায়া সুনিবিড় পথে বাউলমন উদাস হয়ে ফেরে। কোথাও স্তব্ধ দিঘির কালো জল ও নীল আকাশের মাঝে মিতালির সম্ভাবনা। কোথাও মৌন প্রান্তরের বুকে ঊর্ধ্ববাহু বটগাছ নির্বাক তপস্বীর ন্যায় দাঁড়িয়ে সবাইকে দিচ্ছে সুশীতল ছায়ার পরশ।

আরও পড়ুন : রচনা : বাংলাদেশের ষড়ঋতু - ক্লাস 6, 7, 8, 9, 10

সেখানে যেন চিরন্তন প্রশান্তির স্পর্শ মেলে। এখানের অবারিত প্রসন্ন আকাশ, দিগন্তবিস্তৃত শস্য-প্রান্তর, দোয়েল-খঞ্জনা-শালিক-বট কথা কও পাখির কলকাকলিতে যেন এক স্বপ্নের ইন্দ্রজাল রচনা করে দেয়। গ্রামের শাপলা ও পদ্মভরা দিঘিতে হাঁসের খেলায়, ফুটন্ত সজনে ডালে, বকের ধ্যানমগ্নতায়, হিজল-ডালে মাছরাঙার মৎস্য তপস্যায়, ঘুঘুর কান্নায়, শঙ্খচিলের মর্মবিদারী আর্তবিলাপে, ধীর প্রবাহিনী নদীর কল-গুঞ্জনে বাংলার চিরকালীন যাত্রা। কথকতা, বাউল কীর্তন, ভাসান, ভাটিয়ালির সুরে আর আজানের ধ্বনিতে আমাদের সৌন্দর্য-পিয়াসী মনটিও যেন চুরি হয়ে যায়। 

নদনদীর শোভা : 

বাংলাদেশের প্রকৃতির অন্যতম আকর্ষণ হলো অসংখ্য নদনদী ও খালবিল। বিশ্বের আর কোথাও এত বেশি নদনদী নেই। উত্তরের অসংখ্য পাহাড়ের বরফগলা পানিতে নদনদীগুলো পুরো বছর নাব্য থাকে। বর্ষায় মেঘরূপী বারি হিমালয় বক্ষে বাধা পেয়ে এসব নদী প্লাবিত করে দক্ষিণ সাগরের পানে উত্তাল, উন্মাদ ও উল্কার গতিতে ছুটে চলে। বর্ষার নদী শুরু করে ভাঙা আর গড়ার খেলা। এসব নদীবক্ষে চলে অসংখ্য ট্রলার, লঞ্চ আর স্টিমার। নদীর বুকে পালতোলা নৌকা নদীর সৌন্দর্যকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। 

মাঝির কণ্ঠে উচ্চারিত এসব জারিগান, সারিগান, ভাটিয়ালি, পল্লি গীতি আমাদের হৃদয়কে প্রফুল্প করে। শুধু তাই নয়, শোভাময় নদী তীরে সূর্যাস্তের দৃশ্যও প্রকৃতির সৌন্দর্যভাণ্ডারে একটি অনন্য উপাদান। দিবসের অবসানে এ যেন বিদায় বেলার অনন্য উপহার। 

আরও পড়ুন : রচনা : এই দেশ এই মানুষ / প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ

ঋতুবৈচিত্র্য : 

প্রকৃতির ঋতু রঙ্গশালায় বৈচিত্র্যের এমন অনুপম প্রকাশ বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও চোখে পড়ে না। প্রতিটি ঋতু এখানে তার আপন রূপের ডালি নিয়ে আসে, প্রকৃতিকে সাজায় অপরূপ সজ্জায়, তারপর তার রূপ-বিস্তারের সর্বশেষ স্মৃতিচিহ্নটুকু নিঃশেষে মুছে নিয়ে চলে যায়। নৃত্যচঞ্চল নটরাজের হাতের রুদ্রাক্ষের মালা ঘুরে চলে। ‘রূপসী বাংলার রূপ সাগরে ওঠে ঋতুচক্রের নতুন ঢেউ।

গ্রীষ্মের দারুণ অগ্নিবাণে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে প্রকৃতি। কালবৈশাখী আসে রুদ্ররূপ ধারণ করে। এরপর আসে বর্ষা। সে চারদিক ভরে দিয়ে যায় পানিতে। পথঘাট ডুবে যায়। নদীনালা ভেসে যায়। শরৎকালে শিউলি ফুলের মন উদাস করা ঘ্রাণ, নদীতীরে কাশফুলের সমারোহ আর প্রভাতে তৃণ-পল্লবে নব শিশিরের সৌন্দর্য হৃদয়-মন ছুঁয়ে যায়। 

হেমন্তে রৌদ্রে এবং ধানের ক্ষেতে লাগে সোনার রং। মাঠে ক্ষেত, খামারে সোনালি পাকা ধানের প্রাচুর্য। এরপর শীত আসে গৈরিক উত্তরীয় নিয়ে। কাঠ-শূন্য গাছের পাতা ঝরে যায়। আর এ শূন্যতা কাটিয়ে ঋতুরাজ বসন্ত আসে তার বিপুল সৌন্দর্যের পশরা সাজিয়ে। তখন গাছে গাছে নতুন পাতা গজায়। কোকিলের কুহুকুহু তান সত্যিই মধুর লাগে। মোটকথা বসন্তে প্রকৃতি নতুন সাজে সেজে ওঠে। 

উপসংহার : 

প্রকৃতির লীলাভূমি বাংলাদেশ। একদিকে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য মানুষকে করেছে কোমল এবং অনুভূতিপ্রবণ; অন্যদিকে ঝড় বৃষ্টি প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের করেছে সাহসী ও সংগ্রামী। এদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বিভিন্ন কবি একে বিভিন্ন নামে অভিহিত করেছেন। যেমন: বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দ দাশের রূপসি বাংলা ইত্যাদি। মূলত বাংলাদেশের সৌন্দর্যের কোনো খাদ নেই, যেন কোনো শিল্পী তার স্বপ্নিল দৃষ্টির অনুভূতিতে একান্ত আপন করে বাংলাদেশকে এঁকেছেন তার সুবিন্যস্ত রং ও তুলির আঁচড়ে।

Post a Comment

0 Comments