ইলমে দীন ও আহকামে শরীয়ার গবেষণায় যারা নিজেদের আরাম-আয়েশ ও ভোগবিলাস ত্যাগ করে প্রদীপ্ত বাতি আর জ্ঞানের মশাল বিতরণ করে গেছেন, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) তাঁদের অন্যতম। হাদীসের সাথে ইসলামী শরীয়ার সমন্বয়সাধন করে তিনি একটি মাযহাব প্রবর্তন করেন। ফিকহুশাস্ত্রে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। নিম্নে এ ক্ষণজন্মা মনীষীর সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং ফিকহশাস্ত্রে তাঁর অবদান আলোকপাত করা হলো।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এর জীবনী:
পরিচিতি : তাঁর নাম আহমদ, কুনিয়াত বা উপনাম আবু আবদুল্লাহ, পিতার নাম মুহাম্মল, দাদার নাম হাইল, দাদার নামের দিকে নিসবত করে তাঁর মাযহাবকে হাম্বলী মাযহাব বলা হয়। পূর্ণনাম আবু আবদুল্লাহ আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাম্বল ইবনে হিলাল যিহলী আল মারবী আশ শায়বানী (র)।
২. জন্ম : ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) বর্তমান ইরাকের বাগদাদ নগরীর এক ধর্মভীরু বিখ্যাত পরিবারে ১৬৪ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন।
৩. শৈশবকাল: জন্মের মাত্র দু’বছরের মধ্যে ইমাম আহমদ পিতাকে হারান। ফলে এতিম অবস্থায় মায়ের আদর যত্নে তাঁর শৈশবকাল অতিবাহিত হয়।
৪. প্রাথমিক শিক্ষা : পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী মক্তবে কুরআন ও আরবি ভাষার প্রাথমিক পাঠ দিয়েই তাঁর শিক্ষাজীবনের সূচনা হয় ।
আরো পড়ুন : ইমাম শাফেয়ী রহঃ এর জীবনী ও ফিকহে শাফেয়ীর বৈশিষ্ট্যাবলি-pdf
৫. ফিকহ শিক্ষা : মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ইমাম আবু হানীফা (র)-এর সুযোগ্য শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফ (র)-এর দরবারে হাজির হন। তাঁর নিকট তিনি ফিকহশাস্ত্রের ওপর অধ্যয়ন করেন এবং অল্পসময়ের মধ্যে এ বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন ।
৬. হাদীস অধ্যয়ন : তাঁর বয়স যখন ১৬ বছর তখন তিনি তৎকালীন বাগদাদের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হোসাইন ইবনে বশীর ও ওমায়ের ইবনে আবদুল্লাহর নিকট হাদীস অধ্যয়ন শুরু করেন। তাঁর হাদীসের প্রখ্যাত উস্তাদগণের মধ্যে হাশেম (র) ও সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (র)-এর নাম উল্লেখযোগ্য।
৭. মক্কাগমন : ২৩ বছর বয়সে ১৮৭ হিজরীতে তিনি প্রথমবারের মতো মক্কা নগরীতে গমন করেন। মক্কার প্রখ্যাত মুহাদ্দিসগণ থেকে তিনি হাদীস অন্বেষণ করেন। মাঝে তিনি একবার দেশে গিয়ে ১৯০ হিজরীতে আবার মক্কা গমন করে তিন বছর অবস্থান করেন।
৮. ইয়েমেন সফর : মক্কা হতে প্রত্যাবর্তন করে প্রথমে বসরা, পরে হেজায, কুফা ও ইয়েমেন গমন করেন। ইয়েমেনের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আবদুর রাযযাকের নিকট হাদীসের দারস গ্রহণ করেন।
৯. ইরাকে পুনর্গমন ও শাফেয়ীর শিষ্যত্ব গ্রহণ : ইয়েমেন হতে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল স্বদেশে ফিরে আসেন। ১৯৫ হিজরীতে ইমাম শাফেয়ী (র) হজ্জ শেষে ইরাক আগমন করলে ইমাম আহমদ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং ইলমে ফিকহের ওপর ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। মূলত ইমাম শাফেয়ী (র)-এর সংস্পর্শে আসার পর থেকেই তিনি ফিকহশাস্ত্র গবেষণায় নিজস্ব ধারা প্রবর্তনের প্রয়াস পান।
১০. অধ্যাপনা : শিক্ষাজীবনের ইতি টেনে ইমাম আহমদ (র) জ্ঞান বিতরণের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর দরবারে দিবারাত্র জ্ঞানচর্চা হতো। দূরদূরান্ত হতে হাজার হাজার জ্ঞানপিপাসু এসে তাঁর থেকে ফিকহ ও হাদীসের দারস নিতেন এবং পাশাপাশি তিনি বড় বড় জলসা ও মাহফিলের মাধ্যমে ইলমে দীন বিতরণে মশগুল থাকতেন।
আরো পড়ুন : ইমাম মালেক রহঃ এর জীবনী – pdf
১১. গ্রন্থ প্রণয়ন : ২১৪ হিজরীতে বাগদাদে خلق قران এর ফেতনার সূচনা হয়। তখন তিনি একটি সহীহ হাদীসগ্রন্থ প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং প্রায় ৪২ হাজার সহীহ হাদীস দ্বারা একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন ।
১২. মাযহাব প্রতিষ্ঠা : এ সময় তিনি ইলমে হাদীস, ইসলামী শরীয়াহ, ফিকহে হানাফী ও ফিকহে শাফেয়ীর সাথে সমন্বয়সাধন করে ফিকহী মাসয়ালা উদ্ভাবন করতে থাকেন। আর এর ভিত্তিতেই হাম্বলী মাযহাব প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৩. কারাবরণ : মুতাযিলা মতবাদের এবং আব্বাসীয় খলিফা মুতাসিম বিল্লাহর নির্দেশের বিরোধিতা করায় খলিফা ইমামকে কারাগারে বন্দি রাখেন।
১৪. মুক্তিলাভ : ২৩২ হিজরীতে মুতাওয়াক্কিল আব্বাসীয় খলিফা মনোনীত হন। মুতাযিলাবিরোধী এ খলিফা ইমাম আহমদকে কারাগার হতে মুক্তি দেন।
১৫. শিক্ষকমণ্ডলী : ইমাম আহমদ (র) অসংখ্য শিক্ষকের নিকট থেকে জ্ঞানার্জন করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন- ইয়াযীদ ইবনে হারুন, ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আল কাত্তান, সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা, মুহাম্মদ ইবনে ইদরীস আশ শাফেয়ী ও আবদুর রাযযাক প্রমুখ ।
১৬. শিষ্যবৃন্দ : তাঁর শিষ্যবৃন্দের সংখ্যা অগণিত। তাঁর প্রসিদ্ধ ছাত্রগণ হলেন তাঁরই দু’পুত্র সালেহ এবং আবদুল্লাহ। অন্যান্যদের মধ্যে হাম্বল ইবনে ইসহাক, মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী, মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ নিশাপুরী, আবু দাউদ আস সিজিস্তানী উল্লেখযোগ্য ।
১৭. দাম্পত্য জীবন : তাঁর বয়স যখন ৪০ বছর তখন তিনি প্রথম বিয়ে করেন এবং পরবর্তীতে আরো একটি বিয়ে করেন। তাঁর দু’স্ত্রীর গর্ভে সালেহ ও আবদুল্লাহ নামে দু’সন্তান জন্মগ্রহণ করে।
১৮. ইন্তেকাল : দীর্ঘজীবন জ্ঞানসাধনা ও ইসলাম প্রচার শেষে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) ২৪১ হিজরীর ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিতে পরপারে পাড়ি জমান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। তাঁর জানাযায় প্রায় ১০ লাখ লোক সমবেত হয়েছিল। বাগদাদেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।
আরো পড়ুন : কুদুরী গ্রন্থ প্রণেতার জীবনী ও কুদুরী গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য
১৯. ফাযায়েল ও মাহাত্ম্য : তিনি একাধারে সুবিজ্ঞ মুহাদ্দিস, ফকীহ ও মুজতাহিদ ছিলেন। তাঁর মতামত এবং মাযহাব সমগ্র বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। ইমাম ইসহাক ইবনে রাহওয়াই তাঁর মর্যাদার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন- আহমদ ইবনে হাম্বল আল্লাহর যমীনে আল্লাহ এবং তাঁর বান্দার সাথে যোগসূত্র স্থাপনকারী প্রকাশ্য দলীল । ইমাম শাফেয়ী (র) যখন ইরাক থেকে প্রত্যাবর্তন করেন তখন তাঁর সম্পর্কে বলেন- আমি বাগদাদ থেকে চলে এসেছি; কিন্তু সেখানে আমি আহমদ ইবনে হাম্বল অপেক্ষা অধিকতর ফিকহ বিশেষজ্ঞ, খোদাভীতি সম্পন্ন, দুনিয়া বিরাগী এবং ইলমের অধিকারী অন্য কাউকে রেখে আসিনি।
ইমাম আহমদের ফিকহের বৈশিষ্ট্যাবলি :
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র)-এর ফিকহের অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নিম্নে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পেশ করা হলো-
- ইমাম আহমদ (র)-এর ফিকহে আল কুরআনে ظاهر معنى -এর ওপর ভিত্তি করে হুকুম গ্রহণ করা হয়।
- হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে সনদের বিশুদ্ধতার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেয়া হয়।
- এ ফিকহে مرفوع এবং موقوف হাদীসকে সমান মূল্য দেয়া হয়।
- ইমাম মালেক (র)-এর ন্যায় মদিনাবাসীদের আমল দ্বারা দলীল গ্রহণ করা হয়।
- ইমাম আহমদ (র) স্বাধীন চিন্তার বিরোধী ছিলেন আর সেভাবেই তাঁর এ মাযহাব তৈরি ।
- এ মাযহাব ছিল খুবই সহজ ও সরল।
- এ মাযহাবে কেয়াস যথাসম্ভব বর্জন করা হয়েছে।
- ইমাম আহমদ (র)-এর মাযহাবে বুদ্ধি ও যুক্তিতর্কের স্থান ছিল অতি নগণ্য। উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যে তাঁর মাযহাব যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী ও স্বতন্ত্র ।
উপসংহার : ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) ইসলামী শরীয়তের এক আলোকোজ্জ্বল প্রতিভা। ইলমে ফিকহ সংকলনে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। তিনি চার ইমামের অন্তর্ভুক্ত চিরস্মরণীয় প্রাণপুরুষ। যিনি ত্যাগী মানসিকতা, অফুরন্ত প্রতিভা আর অসামান্য ব্যক্তিত্বের জন্য ফিকহের ইতিহাসে কালজয়ী মহাপুরুষ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন ।
আরো পড়ুন : ফিকহ শব্দের অর্থ কি?কাকে বলে। গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা