উপস্থাপনা :
বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত বিশ্বের অযাচিত কাজের ফসল জলবায়ু পরিবর্তন, যার কারণে আজ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। পৃথিবীর তাপমাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর এই তাপমাত্রা বৃদ্ধিই জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। আর বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ একটি সময়ের দাবি। কেননা সুন্দরবনসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে ।
জলবায়ু :
কোনো অঞ্চলের বায়ুর চাপ, বায়ুর তাপ, বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ ইত্যাদির দীর্ঘদিনের কমপক্ষে ৩০-৩৫ বছরের অবস্থাকে উক্ত অঞ্চলের জলবায়ু বলা হয়। এটি কোনো অঞ্চলের আবহাওয়ার উপাদানগুলোর কমপক্ষে ৩০ থেকে ৩৫ বছরের গড় অবস্থানকে বোঝায়। কোনো স্থানের আবহাওয়ার অবস্থান অস্থায়ী কিন্তু জলবায়ুর অবস্থান স্থায়ী। কোনো দেশ বা অঞ্চলের আবহাওয়ার উপাদানসমূহ যেমন : উত্তাপ, বায়ুচাপ, বায়ুর আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত ইত্যাদি উপাদানের তারতম্যের ভিত্তিতে পৃথিবীকে বিভিন্ন জলবায়ু অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। সেগুলো হলো- উষ্ণমণ্ডল, উষ্ণ নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডল, মৃদু শীতল নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল, মেরুদেশীয় এবং উচ্চ পার্বত্য ভূমি।
জলবায়ু পরিবর্তনের স্বরূপ ও কারণ :
বিশ্বে প্রতিনিয়ত বৃক্ষনিধন, শিল্প-কারখানা স্থাপন, দূষণ ও নগরায়ণ ঘটছে। ফলে বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, ক্লোরোফ্লোরো কার্বনসহ মারাত্মক গ্যাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব গ্যাসের প্রভাবে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরের অবরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে প্রভাব বিস্তার করে। এভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি, ওজোন আবরণের ক্ষয়বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়ছে। ফলে বদলে যাচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য।
আরও পড়ুন : রচনা : বাংলাদেশের পোশাক শিল্প ( ২০ পয়েন্ট ) – PDF
জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক চিত্র :
২০০৭ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত পরিবেশ বিষয়ক সম্মেলনে জাতিসংঘের শতাধিক সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সামনে যে প্রতিবেদন পেশ করা হয় সেখানে উল্লেখ রয়েছে, বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ দূষণের ফলে বর্তমানে যে প্রক্রিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে তাতে আগামী ২০৮০ সালের মধ্যে আফ্রিকা ও এশিয়ার ৩০০ কোটি মানুষ ভয়াবহ পানি ও খাদ্য সংকটে পড়বে। এছাড়া ২০ থেকে ৩০ শতাংশ গাছপালা ও প্রাণী রয়েছে সর্বোচ্চ হুমকির মুখে, যারা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি বলা হয়েছে, বিশ্বের তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ থেকে ২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে, তাতে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ গাছপালা ও পশুপাখির জীবনের ওপর ভয়াবহ ঝুঁকির আশঙ্কা বিদ্যমান।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব :
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পাহাড়ের ওপরের বরফ ও মেরু অঞ্চলের হিমবাহ গলে যাচ্ছে । এতে সমুদ্রের পানির স্তর ওপরে উঠে আসছে। এ রকম চলতে থাকলে জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ বাড়বে, প্লাবিত হতে থাকবে বিস্তীর্ণ অঞ্চল। সমুদ্রে তলিয়ে যাবে কোটি কোটি মানুষ এবং জীবজন্তুর আবাসভূমি ও বনাঞ্চল। ১° সেলসিয়াস উত্তাপ বাড়লেই বাংলাদেশের প্রায় ১৭% ভূমি সমুদ্রে তলিয়ে যাবে বলে অনেক গবেষক আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ :
পৃথিবীতে একদিকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গমন ক্রমাগত বাড়ছে, অন্যদিকে ‘উন্নয়নের’ নামে বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলে পৃথিবীতে বায়ুমণ্ডলে আরো বেশি পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, ক্লোরোফ্লোরো কার্বনসহ আরো কিছু মারাত্মক ক্ষতিকর গ্যাস মজুত হয়ে গ্রীন হাউজ প্রভাব সৃষ্টি করছে। ফলে সূর্যের তাপ যে পরিমাণে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করছে, তার সবটা বের হতে পারছে না। তাছাড়া এসব গ্যাসের প্রভাবে বায়ুমণ্ডলের বাইরের দিকে যে ওজন গ্যাসের আবরণ আছে, তা ক্রমেই ক্ষয় হচ্ছে। উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরুর উপরিভাগের ওজন আবরণে ইতোমধ্যে বড় ফাটল সৃষ্টি হয়ে তা ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। একইসাথে এই বৃদ্ধির গতিও বাড়ছে। ফলে পরিবর্তন হচ্ছে বৈশ্বিক জলবায়ুর ।
আরও পড়ুন : দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও তার প্রতিকার : রচনা (২০ পয়েন্ট)
জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক ক্রমধারা :
১৭১২ সালে প্রথম বাষ্পচালিত ইঞ্জিন (স্টিম ইঞ্জিন) আবিষ্কার হয়। এর ফলে শিল্প বিপ্লবের পথ সুগম হয়। এতে কয়লা পোড়ানোর মধ্য দিয়ে প্রকৃতিতে গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ শুরু হয়। বিগত শতাব্দী হতে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কিছু তথ্য নিম্নে উপস্থাপন করা হলো—
১৯০০ : সুইডেনের এক রসায়নবিদ আবিষ্কার করেন, আবহাওয়ামণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড অবলোহিত বর্ণচ্ছটার কিছু অংশ জোরালোভাবে শোষণ করে নেয়। তবে এ গ্যাস বিশ্বকে উষ্ণ করে দিচ্ছে বলে তিনি বুঝতে পারেননি।
১৯৩৮ : বিশ্বের ১৪৭টি আবহাওয়া কেন্দ্রের রেকর্ড থেকে দেখা যায়, বিশ্বের তাপমাত্রা আগের শতাব্দী থেকে বেড়েছে।
১৯৫৭ : মার্কিন বিশেষজ্ঞরা দেখতে পান, বায়ুমণ্ডলের অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড সাগরের পানি শোষণ করতে পারছে না।
১৯৭২ : স্টকহোমে প্রথম জাতিসংঘ পরিবেশ বিষয়ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৮৮ : জলবায়ু পরিবর্তন মূল্যায়ন করতে ইন্টার-গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) গঠিত হয়।
১৯৯০ : আইপিসিসি প্রথম রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বের তাপমাত্রা গত শতকের তুলনায় দশমিক তিন থেকে বেড়ে দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়েছে।
১৯৯৭ : কিয়োটো প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। এতে উন্নত দেশগুলো ২০০৮-২০১২ সালের মধ্যে গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ ৫ শতাংশ কমাতে সম্মত হয়।
২০০১ : কিয়োটো চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে যায়।
২০০৭ : আইপিসিসির চতুর্থ রিপোর্টে দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ৯০ শতাংশেরও বেশি মানবসৃষ্ট গ্রীন হাউজ গ্যাস দায়ী।
২০০৯ : যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে চীন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ করে। এ প্রেক্ষিতে কোপেনহেগেনে বিশ্বের ১৯২টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং প্রতিনিধিরা জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে বসেন ।
জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে কর্মসূচি :
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে বিশ্ব নেতারাও উদ্বিগ্ন। এ কারণে ১৯৭২ সালে স্টকহোমে প্রথম জাতিসংঘ পরিবেশবিষয়ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে আমাদের করণীয় বিষয়ে একাধিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ ২০২১ সালে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জাতিসংঘের আয়োজনে কপ-২৬ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এসব সম্মেলনে কার্বন নিঃসরণ কমাতে সম্মত হয়েছে বিভিন্ন দেশের নেতারা।
জলবায়ু বিষয়ক সম্মেলন :
গত ৭ ডিসেম্বর ২০০৯ তারিখে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে শুরু হয় জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলন। ১৮ ডিসেম্বর ২০০৯ তারিখে সম্মেলন সমাপ্তির কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ে মতৈক্যে পৌঁছাতে রাষ্ট্রসমূহ ব্যর্থ হয়। তাই সম্মেলন শেষ হয় ১৯ ডিসেম্বর। সম্মেলনে ১৯৩টি দেশ থেকে ১০,০০০ প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। শুরুতে সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন কুনি হেডেগার্ড।
তবে বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে আরো কার্যকর আলোচনার জন্য তিনি সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী লার্স লোকে রাসমুসেন-এর হাতে সভাপতির দায়িত্ব অর্পণ করেন। রাসমুসেনের সভাপতিত্বে সম্মেলনের শেষের দিকে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। কার্যকর কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সকলেই ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার প্রচেষ্টায় UNFCCC একটি সমঝোতাকে ‘নোট’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এ সমঝোতা স্মারকে বাধ্যতামূলক আইন চুক্তি, দরিদ্র দেশগুলোর জন্য অর্থ সংস্থান, বন সংরক্ষণ, বিশ্বব্যাপী কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনা ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন : রচনা : ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য (২০ পয়েন্ট)-pdf
জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের অবস্থা :
জলবায়ু পরিবর্তনের খারাপ প্রভাব আমাদের দেশে পড়তে শুরু করেছে। কেননা বাংলাদেশের ভৌগোলিক ভূ-খণ্ডের তুলনায় বনভূমি নিতান্তই অপ্রতুল। এখানে ৫৬,৯৭৭ বর্গমাইল এলাকার মাত্র ১০,০০০ বর্গমাইল বনভূমি রয়েছে। এককালে এখানে ছিল ফলবান বৃক্ষের বাগান, অরণ্যে ছিল বিপুল বৃক্ষরাজি। কিন্তু আধুনিক জীবন ও সভ্যতার গ্রাসে সবুজবাংলার সেই শ্যামল সুন্দর রূপ আজ তিরোহিত। যার কারণে দেখা দিচ্ছে এখন জলবায়ু পরিবর্তন।
ফলে প্রতি বছরই বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগে কবলিত হয়। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, কালবৈশাখী, বন্যা, সিডর, নারগিস, আইলা, শিলাবৃষ্টি ইত্যাদি দুর্যোগ এ জনপদে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। অনেক গবেষক আশঙ্কা করেছেন১ ডিগ্রি সেলসিয়াস উত্তাপ বাড়লেই প্রায় ১৭% বাংলাদেশের ভূমি সমুদ্রে তলিয়ে যাবে বলে ।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় জাতীয় আইন :
১৯৯২ সালে বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য কনভেনশনে স্বাক্ষর করার পর জাতীয় সংরক্ষণ কৌশল (NCS ) এবং জাতীয় পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কর্ম পরিকল্পনা (NEMAP ) তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং ইউএনডিপির সহায়তায় টেকসই পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (SEMP) এর অধীনে বেশকিছু জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
জলবায়ুর নিয়ন্ত্রণকারী উপাদান :
মূলত জলবায়ু হলো কোনো অঞ্চলের আবহাওয়ার দীর্ঘকালীন ও স্থায়ী রূপ। অর্থাৎ আবহাওয়ার উপাদানগুলোর দীর্ঘকালের গড় অবস্থানই কোনো অঞ্চলের জলবায়ু হিসেবে পরিগণিত। জলবায়ুর উপাদানগুলো আবার কতকগুলো প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রকের দ্বারা প্রভাবিত। এ নিয়ন্ত্রকগুলোকে জলবায়ুর নিয়ন্ত্রক বলা হয়। জলবায়ুর নিয়ন্ত্রক জলবায়ুর উপাদানগুলাকে প্রভাবিত করে একটি অঞ্চলের জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। জলবায়ুর নিয়ন্ত্রণকারী উপাদানগুলো হলো; অক্ষাংশ, উচ্চতা, সমুদ্র স্রোত, সমুদ্র হতে দূরত্ব, বায়ু প্রবাহ বা বায়ুর গতি, বনভূমি, ভূমির ঢাল, ভূপ্রকৃতি, মৃত্তিকার প্রকৃতি ইত্যাদি।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফল ও বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি :
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সমস্যাগুলোর মধ্যে বন্যা, দুর্ভিক্ষ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, সাইক্লোন এবং ঝড় অন্যতম। এসব সমস্যার কারণে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে আরও বেশ কিছু বিষয় জড়িত। এগুলো হচ্ছে কৃষি, খাদ্যের উৎপাদন, ওয়াটার, এনার্জি সিকিউরিটি ইত্যাদি। এসব সেক্টরের ক্ষতির কারণে মানুষের জীবন ও জীবিকা মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়াতে মেরু অঞ্চলের বরফ স্তূপ ক্রমান্বয়ে গলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এভাবে বরফ গলতে থাকলে আগামী ২০৮০ সালের মধ্যে পৃথিবীর একটি বিশাল অংশ পানিতে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
আরও পড়ুন : রচনা : বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ রচনা ( ২০ পয়েন্ট ) – pdf
যার ফলে পৃথিবীতে মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে। এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্ব পরিমণ্ডলের তাপমাত্রা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় সৃষ্টি হচ্ছে দাবানলের। আর এ দাবানলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে সবুজ বৃক্ষরাজি, যা কিনা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য অন্যতম উপাদান। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেখা দিচ্ছে নানা প্রকার নতুন নতুন রোগ ব্যাধির প্রকোপ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বন্যা ও সাইক্লোনে সরাসরি মানুষ মরতে পারে। পরোক্ষভাবে এর ফলে পানিবাহিত জীবাণুর বিস্তার ঘটবে এবং নানা রকম সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটবে। পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাবে। ফসলহানির ফলে খাদ্যাভাব ও অপুষ্টি দেখা দিবে।
২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে যা ঘটতে পারে :
১৯৮০ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে শুধু বাংলাদেশেই গড় তাপমাত্রা দশমিক ২ ডিগ্রি থেকে ১ ডিগ্রি বেড়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এ তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে দেশের নদীগুলোর পানির প্রবাহ ও পরিমাণ ১০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়ে যাবে। চলতি শতকেই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার পর্যন্ত বাড়বে এবং এর ফলে বাংলাদেশের ১৬ ভাগ অঞ্চল ডুবে যাবে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা ।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দেশে ২০৫০ সালের মধ্যে যেসব সমস্যার আধিক্য দেখা দিতে পারে সেগুলো হচ্ছে :
- প্রতিবছর দেশের ৭০ মিলিয়ন লোক বন্যায় আক্রান্ত হতে পারে।
- দেশে বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হতে পারে ।
- সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় দেশের উপকূলবর্তী এবং নিচু এলাকাগুলোর প্রায় ৮ ভাগ স্থায়ীভাবে পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে।
- জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হলে ২০৫০ সালের মধ্যে দেশে ধান ও গমের উৎপাদন ৮ থেকে ৩২ ভাগ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। ফলে তীব্র খাদ্য সংকটের সৃষ্টি হতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের উপায় :
বর্তমান বিশ্বপ্রেক্ষাপট অনেক গতিশীল আর এ জন্যই জলবায়ু পরিবর্তনকে আমরা দমিয়ে রাখতে পারব না। তৎসত্ত্বেও বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনে ধীরগতি আনয়ন সম্ভবপর। জলবায়ুর পরিবর্তনঘটিত বিভিন্ন প্রকার সমস্যা সমাধানের অন্যতম উপায় হচ্ছে সবুজ বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পৃথিবীকে সবুজ সমারোহে ভরে দিতে হবে। পরিবেশের সমস্যা সৃষ্টিকারী বিভিন্ন প্রকার ইলেকট্রনিকস্ যন্ত্রপাতির ব্যবহার কমাতে হবে।
সঠিক নিয়মনীতিমালার মাধ্যমে কলকারখানা পরিচালিত করতে হবে, যাতে বিষাক্ত গ্যাসের নির্গমন কম হয়। বৃক্ষনিধন থেকে বিরত থাকতে হবে। পরিবেশকে রক্ষা করতে হলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রকার আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ দেশের সরকারি-বেসরকারি সকল সংস্থাকে সচেতন হতে হবে। পরিবেশের বিভিন্ন প্রকার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে হবে। এছাড়াও গণমাধ্যমের মাধ্যমে জনগণকে ব্যাপক সচেতন করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা যেতে পারে। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত এসব বিপদ থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে।
আরও পড়ুন : বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প রচনা (২০ পয়েন্ট) SSC, HSC- pdf
ডিএফআইডির কার্যক্রম :
যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ডিএফআইডি জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত নতুন কিছু কার্যক্রম চালু করতে যাচ্ছে। এ কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ সহায়তা প্রদান করা। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলায় ইতোমধ্যে ডিএফআইডির বেশ কয়েকটি ফান্ডিং কার্যক্রম চালু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কম্প্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম এবং পাইলট কমিউনিটি বেইজড অ্যাডাপশন। এছাড়া পলিসি প্রণয়ন এবং রিসার্চের ক্ষেত্রেও ফান্ডিং কার্যক্রম চালাচ্ছে সংস্থাটি।
নদীভাঙন বা বন্যার কারণে গৃহহারা মানুষদের জীবিকার ব্যবস্থা করতে ডিএআইডি ইতোমধ্যে ৫০ মিলিয়ন পাউন্ডের প্রকল্প চালু করেছে। এছাড়া পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলায় ইউনাইটেড কিংডম ৮০০ মিলিয়ন পাউন্ড দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
প্রতিকার :
জলবায়ু পরিবর্তনের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলো টিকে থাকার চেষ্টা করছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রয়োজন জরুরি কর্মপরিকল্পনা । পরিবেশের সুস্থির অবস্থা ফিরিয়ে আনতে বৈশ্বিক লক্ষ্য ও নীতি সহায়ক হবে । বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে লম্বা মেয়াদি সুস্থিত অবস্থার জন্য গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাস করতে হবে এবং low carbon’ উন্নয়ন কৌশল অনুসরণ করতে হবে ।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমনের প্রায় ৮০ শতাংশ অবদান এনার্জি সেক্টরের । বিশ্বব্যাংকের ধারণানুযায়ী, ২০৩০- এর মধ্যে কার্বন নির্গমন ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এজন্য পরিবেশবান্ধব দূষণহীন প্রযুক্তি দরকার । স্থানান্তরযোগ্য ও নবায়নযোগ্য এনার্জি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এ প্রযুক্তি অনেক বেশি সহায়তা করতে পারবে ।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর ভূমিকা :
টেকসই উন্নয়ন কাঠামোর মধ্য থেকেই উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করতে হবে । এসব দেশের জাতীয় নীতির সঙ্গে উপশম কৌশলকে সমন্বয় করে পরিবেশ উপযোগী উপশম কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে । কিছু কিছু উপশম কার্যক্রমে শিল্পোন্নত দেশগুলো যাতে সহায়তা করে সে ব্যাপারে তাদের সঙ্গে আলাপ- আলোচনা করে সমাধানের পথকে প্রশস্ত করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন রোধে করণীয় :
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনরোধে যুগোপযোগী কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেমন-
১. অধিক পরিমাণে বৃক্ষরোপণ ও দেশের আয়তনের ভারসাম্য রক্ষা করে বনভূমি সংরক্ষণ।
২. দেশের জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বাধ্যতামূলক আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন ।
৩. কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ ।
৪. সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি মোকাবেলা করার জন্য বাঁধ নির্মাণ।
৫. তেল, কয়লা ও গ্যাস জাতীয় জ্বালানি ব্যবহার হ্রাস।
৬. গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনা যা Clean Development Mechanism (CDM) এর মাধ্যমে অর্জিত হয়।
৭. বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। ভবিষ্যতে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি খুব বেশি হলে ১ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখা নিশ্চিত করতে হবে।
৮. ওজন আবরণে যে ক্ষয় হয়েছে তার বৃদ্ধি রোধ করতে হবে।
৯. পরিবেশ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন কাজ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন দেশের বিশেষত বাংলাদেশের মতো সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়া।
১০. সর্বোপরি পার্শ্ববর্তি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ দেশসমূহের সাথে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি পরিহার করে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করে সুষ্ঠু সমাধানের চেষ্টা করা।
উপসংহার :
উপরিউক্ত আলোচনার দ্বারা বোঝা যায়, জলবায়ু পরিবর্তন রোধ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের বুঝতে হবে যে, জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষার জন্য আমাদের সকলকে বিপজ্জনক জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করতে হবে । আর জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করতে হলে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে হবে।