রচনা : বাংলাদেশের পোশাক শিল্প ( ২০ পয়েন্ট ) - PDF

(toc) Table Of Contens

উপস্থাপনা  

বিশ্বায়নের ফলে আধুনিক বিশ্বে শিল্পায়ন সম্পর্কিত ধারণার যথেষ্ট প্রসার ঘটেছে। বর্তমানে অনেক দেশে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক শিল্প এক নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। এ সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে আমাদের বাংলাদেশেও। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের মান বিশ্বমানের। পোশাক শিল্পের একশ ভাগই রপ্তানিমুখী। বিশ্ববাজারে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ শিল্পের অবদান উৎসাহব্যঞ্জক।

পোশাক শিল্পের অতীত অবস্থা  

অতীতকাল থেকেই বিশ্ববাজারে বাংলার বস্ত্রশিল্পের ব্যাপক চাহিদা ছিল। তৎকালে বাংলার মসলিন ও জামদানি ছিল পৃথিবী বিখ্যাত। পরে ব্রিটিশ বেনিয়াদের দ্বারা এর ধ্বংস সাধিত হয়। প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পাকিস্তান আমলেও বাংলাদেশে পোশাক শিল্প সম্প্রসারিত হয়নি। 

দেশ বিভাগের সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে কাপড়ের কল ছিল ১৪টি। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে তা ১৪০টিতে উন্নীত হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তান) ছিল মাত্র ৪৩টি বাংলাদেশ সাফল্যজনকভাবে কাপড় তৈরি করাতে এ সময় চরম বৈষম্যের শিকার হয় ।

পোশাক শিল্পের বর্তমান অবস্থা  

তৈরি পোশাক শিল্পে হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের ইতিহাস অবশ্য বেশিদিনের কথা নয়। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে বেসরকারি শিল্প উদ্যোক্তাদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় পোশাক তৈরির শিল্প গড়ে ওঠে। তখন হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল। 

বর্তমানে পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা চার হাজারেরও অধিক। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২০ লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, যার মধ্যে মহিলার সংখ্যা ৮৫%। এছাড়া তাঁত শিল্প তো রয়েছেই। বাংলাদেশের অনেক স্থানেই বেশ উন্নতমানের তাঁতের কাপড় তৈরি হয়।

তৈরি পোশাক শিল্পের প্রয়োজনীয়তা  

মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে বস্ত্রের চাহিদা অন্যতম। আমাদের দেশে বছরে প্রায় ৯০০ মিলিয়ন মিটার কাপড়ের প্রয়োজন হয়। এছাড়া বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের সিংহভাগই আসে তৈরি পোশাক শিল্প থেকে। যদিও পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের দ্বারা এক শ্রেণির জনগণ শোষিতও হচ্ছে তবু সামগ্রিক বিচারে এ শিল্প আমাদের দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেকখানি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারছে।

আরও পড়ুন বাংলাদেশের লোকশিল্প : প্রবন্ধ রচনা

দেশের অর্থনীতিতে তৈরি পোশাক খাত  

১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানি করে আয় করেছিল মাত্র ১৩ লাখ ডলার । আর ২০০৩-০৪ অর্থ বছরে বাংলাদেশে মোট রপ্তানি আয় ৭৬০ কোটি ডলারের মধ্যে পোশাক খাতের অংশ ৫৬৯ কোটি ডলার, যা মোট রপ্তানি আয়ের ৭৬ শতাংশ। জিডিপিতে তৈরি পোশাক খাতের সরাসরি অবদান ৫ শতাংশ ।

পোশাকের বাজার  

যে কোনো শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে উৎপাদিত পণ্যের বাজার সৃষ্টি করা। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প যথেষ্ট চাহিদা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের তৈরি পোশাকের প্রধান বাজার হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। 

বর্তমানে আমেরিকায় পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের স্থান সপ্তম এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে পঞ্চম। এছাড়াও জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ ২৩টিরও অধিক দেশে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। বিশ্বের প্রায় ৩০টি দেশে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়ে থাকে ।

তৈরি পোশাকের ধরন  

বাংলাদেশের তৈরি পোশাকগুলো সাধারণত শার্ট, পায়জামা, জিন্স প্যান্ট, জ্যাকেট, ল্যাবরেটরি কোট, গেঞ্জি, সোয়েটার, পুল ওভার, খেলাধুলার পোশাক, নাইট ড্রেস ইত্যাদি।

বেকার সমস্যা সমাধানে অবদান  

পোশাক শিল্প বাংলাদেশের বেকার সমস্যার সমাধানে কার্যকর ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশেষ করে এ শিল্প নারীদের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। বিত্তহীন, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা নারীরা তাদের শ্রম বিনিয়োগ করে এ শিল্পের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখছে ।

আরও পড়ুন :- বাংলা প্রবন্ধ রচনা : বাংলাদেশের কৃষক - ১৫ প্যারা

অন্যান্য অবদান  

এ শিল্পের আমদানি রপ্তানি কাজে ব্যবহারের জন্য পরিবহন খাত তার কার্যক্ষমতা প্রসারের সুযোগ লাভ করেছে। এ শিল্পে বিনিয়োগ করে ব্যাংকগুলো লাভবান হচ্ছে এবং বীমা কোম্পানির প্রিমিয়াম বাড়ছে।

পোশাক শিল্পের সমস্যা  

বাংলাদেশের পোশাক শিল্প যথেষ্ট সম্ভাবনা সৃষ্টি করলেও এ শিল্পকে কিছু সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়। এ শিল্পের জন্য বড় বাধাগুলো নিম্নরূপ-

অস্থিতিশীল রাজনীতি  

দেশের অস্থিতিশীল রাজনীতি তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। হরতাল ও অন্যান্য ধ্বংসাত্মক কার্যাবলির জন্য চুক্তি অনুযায়ী কাজ না করতে পারায় অর্ডার বাতিল হয়ে যায়। ফলে অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় পড়তে হয় ।

দক্ষ শ্রমিকের অভাব  

তৈরি পোশাক শিল্পের সিংহভাগই নারী শ্রমিক। নারী শ্রমিকের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব এবং পুরুষ শ্রমিকদের স্বল্পতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় পোশাক শিল্পের যথাযথ উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে না।

আরও পড়ুন :বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ - রচনা ( ২০ পয়েন্ট )

কাঁচামালের অভাব  

অধিকাংশ ক্ষেত্রে পোশাকের কাঁচামাল বিদেশ থেকে কিনতে হয়। এতে বিরাট অঙ্কের অর্থ খরচ হয়ে যায়। অনেক সময় নিম্নমানের কাঁচামাল আমদানির ফলে তৈরি পোশাক বিক্রয়ে সমস্যা দেখা দেয়। এতে বাজারের ক্ষতি হয়।

কোটা আরোপ  

বিদেশি আমদানিকারকরা অনেক সময় আমদানির ওপর কোটা আরোপ করায় তৈরি পোশাক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সর্বোপরি হরতাল, ধর্মঘট, মিটিং মিছিল, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্বল শিল্পনীতি ইত্যাদি কারণেও তৈরি পোশাক শিল্পের উন্নয়ন ব্যাহত হয়।

সমস্যা সমাধানের উপায়  

নানা প্রকার সমস্যা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ যথেষ্ট সম্ভাবনাময় । পোশাক শিল্পের সমস্যা সমাধানে নিম্নলিখিত উপায়গুলো বিবেচ্য হতে পারে। যেমন-

ক. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ।

খ. নিয়মিত কাঁচামাল সরবরাহ করা। 

গ. কাঁচামালের গুণগত মান সঠিক হওয়া ।

ঘ. নিয়মিত বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা।

ঙ. দ্রুত আমদানি ও রপ্তানির জন্য পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন করা । 

চ. ইপিজেড-এর মতো সুযোগ সুবিধা প্রদান করা ।

ছ. দেশেই কাঁচামাল উৎপাদনের ব্যবস্থা করা।

তৈরি পোশাকের গুণগত মান : 

বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সংখ্যা বৃদ্ধি আশানুরূপ হলেও গুণগত মানের দিক দিয়ে এখনো অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। আগামীতে তৈরি পোশাক শিল্পকে বিশ্ব বাজারে তার উৎপাদনের গুণের মাধ্যমে টিকে থাকতে হবে। যেসব সমস্যা এ শিল্পকে বাধাগ্রস্ত করে তা নিম্নরূপ :

ক. আমদানিনির্ভর বস্ত্র ও অন্যান্য উপকরণ :

খ. অনিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ;

গ. প্রশাসনিক জটিলতা; 

ঘ. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা;

ঙ. আর্থিক ঋণ সুবিধার অনুপস্থিতি;

চ. দক্ষ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব ইত্যাদি।

প্রতিযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক মন্দাবস্থা : 

আমাদের মোট পোশাক রপ্তানির সিংহভাগ বাজার দখল করে আছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা বদ্ধ করায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প হঠাৎ করেই এক সংকটময় পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মন্দার কারণে আজ দেখা দিয়েছে আমাদের এই শিল্পের অস্তিত্বের সংকট।

বিশ্ববাজারে এদেশের পোশাকের স্থান ও মান : 

বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। উৎপাদন ব্যয় কম হওয়ায় এদেশের তৈরি পোশাক দ্রুত বাজার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের আসে পোশাক শিল্প থেকে। এদেশের সবচেয়ে বড় ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম ও মধ্যপ্রাচ্যের ২৩টি দেশে বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানি করা হয়।

পোশাক শিল্পের মাধ্যমে আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি : 

সমাজের অবহেলিত নারীসমাজ তাদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সমাজ, সংসার, জীবিকা প্রভৃতি ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। সমাজে এখন এসব নারীরা অবহেলিত নয়, বরং সমাদৃত। কারণ, জাতীয় উৎপাদন ও জাতীয় রপ্তানিতে তাদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।

উপসংহার  

পোশাক শিল্প আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। বিশ্ববাজারে আমাদের তৈরি পোশাকের চাহিদা যথেষ্ট হারে বাড়ছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বিশ্বে প্রচুর খ্যাতি ও প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছে। সুতরাং সকল ক্ষেত্রে আনুকূল্য পেলে এ তৈরি পোশাক শিল্প আরো সমৃদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের জন্য অনন্ত সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে সক্ষম হবে- একথা নিঃসন্দেহে উচ্চারণ করা যায়।



Post a Comment

0 Comments