উপস্থাপনা :
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম হলেও তৎকালীন পূর্ব বাংলার (বর্তমানে বাংলাদেশ) মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগণ পূর্ব বাংলাকে অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করে তাদের একটি স্থায়ী কলোনিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। আর এ মানসিকতা থেকে তারা ব্রিটিশ শাসকদের মতোই বাংলার সংস্কৃতি ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাংলার জনগণ তাদের পরিকল্পনা সফল হতে দেয়নি। তাদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়ে বাংলা ভাষার অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।
ভাষা আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস :
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। সংখ্যাগরিষ্ঠের দাবি উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ১৯৪৮ সালের একুশে মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করলেন, Urdu and only Urdu will be the State Language of Pakistan. “উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।”
দেখুন এটি : প্রবন্ধ রচনা : সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার
পরবর্তীতে ১৯৫২ সালের ২৭শে জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকার পল্টন ময়দানে মুসলিম লীগ আয়োজিত এক জনসভায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করে বলেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” এতে সমগ্র ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ছাত্ররা দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দেয়।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন চূড়ান্তরূপ পরিগ্রহ করে। ছাত্রসমাজ ১৪৪ ধারা আইন ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে পড়ে। রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করে সেদিন এদেশের দামাল ছেলেরা বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করে।
স্বাধীনতা সংগ্রামে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা :
ভাষা আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামের দুর্দমনীয় সংকল্পের গভীরে প্রোথিত শিকড়ে রস সংগ্রহ করে দেশকে তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে নিয়ে গেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন একটি সফল আন্দোলন। পরবর্তীতে এ আন্দোলন বাঙালি জাতিকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে সালাম, রফিকের বুকের রক্ত বৃথা যায়নি। ইতিহাস তার মূল্য দিয়েছে। শুধু বাংলা ভাষাকেই আমরা মাতৃভাষা হিসেবে পাইনি, বরং একুশের চেতনার যে বীজ সেদিন বপন করা হয়েছিল, তার বিশাল মহিরুহ পরবর্তীতে অমূল্য স্বাধীনতার স্নিগ্ধ ছায়ায় বেড়ে উঠেছে।
দেখুন এটি : একুশে ফেব্রুয়ারি/আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রচনা- ৫০০, ১০০০ শব্দ
জাতীয় চেতনার উন্মেষ :
কবি আল মাহমুদের ভাষায়-
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়
বরকতের রক্ত।
হাজার যুগের সূর্যতাপে
জ্বলবে এমন লাল যে,
সেই লোহিতেই লাল হয়েছে
কৃষ্ণচূড়ার ঢাল যে ।
একুশের মহান চেতনা আমাদের জাতীয়তাবোধের জন্ম দিয়েছে। একুশ দিয়েছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। একুশ দিয়েছে আমাদের জাতিগত স্বাতন্ত্র্যের মর্যাদা। প্রতিবছর একুশ আসে। ফুলের অজস্র সম্ভার নিয়ে অশ্রুবিগলিত চিত্তে আমরা শহিদ মিনারে হাজির হই। দেশগড়ার দৃপ্ত শপথে ঐক্যবদ্ধ হই সবাই ।
মুক্তিযুদ্ধে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব :
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। ভাষা আন্দোলনই বাঙালি জাতিকে অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে । এর ফলেই বাঙালি জাতি স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে স্বৈরাচারী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কবল থেকে নিজেদের মাতৃভূমিকে মুক্ত ও স্বাধীন করতে সক্ষম হয়। ১৯৫২ সাল হতে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তি আন্দোলনের প্রতিটি স্তরে প্রেরণা যুগিয়েছে এই ভাষা আন্দোলনের রক্তমাখা ইতিহাস। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে তাই ভাষা আন্দোলনের ফল বলা যায়।
দেখুন এটি : আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রচনা ( ২০পয়েন্ট )- PDF
ভাষা আন্দোলন ও বাংলা সাহিত্য :
জাতীয় জীবনের যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা দেশের সাহিত্য, শিল্পকলা, সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর প্রভাব ফেলে। ভাষা আন্দোলন আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জোয়ার এনেছে; আমাদের কবি, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবীগণকে দিয়েছে লেখার ও ভাবনার নতুন উপকরণ।
৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি এক ঐতিহাসিক উত্তরণ :
বিশ্বসভা কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’রূপে ঘোষণা বাংলা ভাষার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । বিগত সহস্রাব্দে সংস্কৃত, ফারসি, ইংরেজি ও উর্দু-হিন্দির আগ্রাসনে ক্ষত-বিক্ষত বাংলা ভাষা; এ ঘোষণার ফলে আশা করা যায়, তার প্রাপ্য মর্যাদা পাবে। আমাদের সহস্র বছরের কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি উপেক্ষা করে বিজাতীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দেওয়ার যে অনমনীয় মানসিকতা তদানীন্তন শাসকগোষ্ঠীর মাঝে মূর্ত হয়ে উঠেছিল তারই গৌরবদীপ্ত প্রতিবাদের ফসল এ আন্দোলন; অতঃপর কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও আমাদের প্রত্যাশা :
একুশ আমাদের চেতনা। রক্তমাখা, স্মৃতিঘেরা ‘৫২ থেকে ২০১৬ দীর্ঘ ৬৪ বছর একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের দুয়ারে দুয়ারে, অন্তরে, সত্তায় অনুভবের অগ্নিগিরির মতো আসে আর যায়। একুশ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় নব জীবনের নকশাকে, পথকে, স্থাপত্যকে, ভালোবাসার গানকে, আর জীবনের উন্মেষকে; বলে— “জাগো অনশন বন্দী ওঠরে যতো।” কিন্তু আমরা এসব ভুলে অন্ধ-কুটিল আর্তনাদে কণ্ঠ মিলিয়ে দিই। বর্তমানে আমাদের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক অন্যায়- অবিচার ও বৈষম্য বিরাজমান। অথচ একুশ অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এবং তার প্রতিকারের এক দৃপ্ত প্রত্যয়।
উপসংহার :
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলে রয়েছে একুশের চেতনা। ভাষার দাবির সূত্র ধরেই স্বাধিকার আন্দোলন শুরু হয়। ফলে আমরা আজ স্বাধীন। স্বাধীন বাংলাদেশ ভাষা আন্দোলনেরই উত্তরাধিকার।