প্রবন্ধ রচনা : সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার

উপস্থাপনা : 

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এ ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি এ দেশের সন্তান' সালাম, জব্বার, রফিক, বরকতসহ আরও অনেকে প্রাণ দিয়েছিল। তাই বাংলা ভাষার গুরুত্ব আমাদের কাছে অনেক। এজন্য আমাদের আশা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন ঘটবে। 

বাংলা ভাষার ইতিহাস : 

বাংলা ভাষার জন্ম হয় আজ থেকে প্রায় এগারোশ বছর আগে। বৌদ্ধ ধর্মের নিগূঢ় বাণী প্রচারের জন্য এ ভাষার জন্ম হয় কবিতা হিসেবে। হিন্দু আমলে সংস্কৃত এবং মুসলমান আমলে ফারসি রাজভাষা থাকায় বাংলা ভাষা মর্যাদা পায়নি। সময়ের আবর্তে একসময় মুসলিম রাজদরবারে বাংলা ভাষা পৃষ্ঠপোষকতা পায় । শুরু হয় সাহিত্যের যুগ। বিংশ শতাব্দীতে রবীন্দ্রনাথের রচিত কাব্যগ্রন্থ 'গীতাঞ্জলি' নোবেল পুরস্কার পেলে বাংলা ভাষা বিশ্বসাহিত্য দরবারে মর্যাদার আসন লাভ করে।

বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম : 

১৯৪০ সালের পর বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালু হয়। যদিও সে সময়ে দেশের সর্বত্র ইংরেজির দাপট ছিল। দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা পায়। এরপর থেকে দেশের স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষা স্বীকৃতি লাভ করে ।

আরও পড়ুন : রচনা : জাতীয় জীবনে দেশপ্রেমের গুরুত্ব

বাংলা ভাষার জয়যাত্রা : 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। ফলে বাংলা ভাষা স্বমহিমায় ভাষর হয়ে ওঠে। বিভিন্নমুখী সমস্যা থাকা সত্ত্বেও জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিগন্তে সর্বক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার শুরু হয় ।

জাতীয় জীবনে বাংলা : 

পৃথিবীর বড় বড় জাতি নিজেদের মাতৃভাষাকে অনুশীলনের মাধ্যমেই উন্নতি করেছে। আমরা বাংলা ভাষার মাধ্যমে জীবনের সকল প্রয়োজন মেটাই। ভাবের আদান-প্রদান করি, প্রাণের কথা বলতে পারি। জাতীয় জীবনের প্রতিটি স্তরে এ ভাষার সহজ অধিকার । তাই মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইংরেজি ভাষা চর্চা করেও শেষ পর্যন্ত বাংলা ভাষাতেই অমরত্ব লাভ করেন।

মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান : 

মাতৃদুগ্ধ শিশুর পক্ষে যেমন পুষ্টিকর, বিদ্যাশিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষা তেমন সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। কাজেই বিদেশি ভাষা মাতৃভাষার ন্যায় কখনো সফলতা দান করতে পারে না। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা যথার্থ শিক্ষা হতে পারে ।

শিক্ষায় বিদেশি ভাষার অসুবিধা : 

মাতৃভাষার কলকাকলিতে প্রথম কণ্ঠে যে শব্দ উচ্চারিত হয়, পরবর্তীকালে প্রয়োজনে অন্য ভাষায় তা সম্ভব নয় । 

আরও পড়ুন : জাতীয় দিবস : বাংলা প্রবন্ধ রচনা 

বাংলা ভাষার প্রয়োজনীয়তা : 

অনেকেই মনে করেন, বাংলা ভাষায় অর্থনীতি, বিজ্ঞান, দর্শন, ভূ-তত্ত্ব প্রভৃতি বিষয় শিক্ষা দেওয়া যায় না। এ কথার পেছনে কিছু যুক্তিও কাজ করেছে। বাংলা ভাষা বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষাদানের পক্ষে হয়তো এ মুহূর্তে যথেষ্ট উপযোগী নাও হতে পারে এক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে উচ্চতর শিক্ষাদানের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারলে তা সম্ভব হবে। কারণ বাংলা ভাষার শব্দ-সম্পদ ও ধারণ ক্ষমতা বিশ্বের অন্য যে-কোনো শক্তিশালী ভাষার সমপর্যায়ের

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা : 

বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞান অর্জনের সুযোগ থেকে দূরে রাখা হয়েছে। মূলত বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা শুরু হলে বিভিন্ন গ্রন্থ রচিত হবে, পরিভাষা সৃষ্টি হবে। অক্সিজেন, হাইড্রোজেন ইত্যাদি শব্দ যেখানে গ্রহণযোগ্য হয়েছে, সেখানে অন্যান্য শব্দ বাংলা ভাষায় গ্রহণ করলে ভাষার ধারণ ক্ষমতা প্রকাশ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এভাবে বাংলা ভাষায়ও বিজ্ঞানচর্চার পথ সুগম হবে। 

বিভিন্ন ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় বই রূপান্তর : 

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার বিভিন্ন উন্নতমানের বই বাংলাভাষায় অনুবাদ করে বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাকে সর্বজনীন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে আমাদের দেশের গবেষকগণ সহজেই তাদের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে সৃজনশীলতার পরিচয় দিতে পারেন।

অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা : 

আমাদের দেশে সরকারিভাবে অফিস-আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলন শুরু হয়েছে। সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলা ব্যবহারের যে আইন পাস করেছে, তার ফলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যাপক ব্যবহার ত্বরান্বিত হচ্ছে।

বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি : 

বাংলা ভাষার রয়েছে এক রক্তাক্ত ইতিহাস। আর এই বিবেচনায় বাংলা ভাষার ইতিহাসে সমুজ্জ্বল ২১শে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে পালনের জন্য ইউনেস্কো সাধারণ পরিষদ তাদের ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃতি

উপসংহার : 

পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার দাবিতে আত্মবিসর্জনের ঘটনা শুধু ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতেই ঘটেছিল। বাংলা ভাষার জন্য আত্মত্যাগের সে ঘটনা আজ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলা ভাষায় কথা বলা বাঙালিদের জন্য একটি গৌরবের বিষয়। আজ তাই সকল ক্ষেত্রে বাংলা প্রচলনের জন্য নতুন করে শপথ গ্রহণের সময় এসেছে। 

Post a Comment

0 Comments