উপস্থাপনা:
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। ছাত্ররাই জাতির ভবিষ্যৎ। এ ভবিষ্যৎ নাগরিকদেরকে গড়ে তোলার প্রধান কেন্দ্র শিক্ষাঙ্গন। আজকে আমাদের শিক্ষাঙ্গন নানা সমস্যায় জর্জরিত। এর মধ্যে সন্ত্রাস অন্যতম। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি।
সন্ত্রাস:
বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তারের সহজ পন্থার নাম সন্ত্রাস। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভের উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসীরা পেশীশক্তি, বলপ্রয়োগ ও অস্ত্রের জোরে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। সন্ত্রাসীদের মূলমন্ত্র হলো Might is right অর্থাৎ, জোর যার মুল্লুক তার।
শিক্ষাঙ্গনের বর্তমান অবস্থা:
সন্ত্রাস শিক্ষাঙ্গনকে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও বড় বড় কলেজগুলোকে রাহুর মতো গ্রাস করেছে। এখনো অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখা যায়। সন্ত্রাসকবলিত শিক্ষাঙ্গনগুলোতে অস্ত্রের মওজুদ দেখলে সেগুলোকে ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া কিছু বলা যাবে না। ফলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা নিরাপত্তাহীন, অভিভাবকরা আতঙ্কগ্রস্ত আর দিন দিন শিক্ষা কার্যক্রম অচল হওয়ার পথে।
আরো পড়ুন : বাংলা প্রবন্ধ রচনা – সন্ত্রাস
শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের কারণ
অসুস্থ রাজনীতি : বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির এক গৌরবময় ঐতিহ্য ছিল। কিন্তু আজ তারা লেজুড়বৃত্তিক সংগঠনে পরিণত হওয়ায় ছাত্রসমাজ তাদের সে গৌরবময় ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে। মুষ্টিমেয় কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলের খপ্পরে পড়ে তারা ছাত্র নামে নানা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। সৃষ্টি হয়েছে প্রতিহিংসার রাজনীতি। এদেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ রাজনৈতিক মাঠের বিরাট খেলোয়াড়। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলেরই রয়েছে ছাত্র সংগঠন। ফলে তারা ক্ষমতায় আরোহণ অথবা অধিষ্ঠিত থাকার জন্য নির্লজ্জভাবে ছাত্রসমাজকে ব্যবহার করছে।
অর্থনৈতিক দৈন্যদশা: এ দেশের অধিকাংশ পিতার পক্ষে তাদের সন্তানদেরকে উচ্চশিক্ষার ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে সাময়িক সুবিধায় থাকার জন্য ছাত্ররা রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি গ্রহণ করে। শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাসী হয়ে দেশের সর্বনাশ করে অথবা লাশ হয়ে দরিদ্র পিতার কোলে ফিরে আসে।
আইন-শৃঙ্খলার অবনতি : সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্ম হয় একমাত্র আইন-শৃঙ্খলার অবনতির কারণেই । কোনো অজানা স্বার্থে অনেকসময় প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। যার ফলে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। সন্ত্রাসীরা সুযোগ নেয়, আর জনসাধারণ তাদের জানমালের নিরাপত্তা হারায়।
আরো পড়ুন : রচনা : যুব সমাজের অবক্ষয় ও তার প্রতিকার
নৈতিক শিক্ষার অভাব: দেশে বর্তমানে প্রচলিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার কোনো বালাই নেই। ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে মানবতাবোধ, মনুষ্যত্ববোধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস থেকে বিদায় নেয়। সে স্থান দখল করে সন্ত্রাস। সহযোগিতা, সহমর্মিতা, দয়া-মায়া এসব সুকুমার বৃত্তির অপমৃত্যু ঘটে।
আধিপত্যবাদী শক্তির ইন্ধন: এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বারবার হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। আর তা রক্ষায় ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। দেশের ছাত্রসমাজকে জ্ঞানবিজ্ঞানে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য আধিপত্যবাদী শক্তি গোপনে কাজ করে যাচ্ছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আছে, কিন্তু শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস নেই।
প্রভাব বিস্তার: একে অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করা এটি মানুষের স্বভাব। মানুষ যখন অনুকূল পরিবেশ পায়, তখন অস্ত্রশক্তি দিয়ে আধিপত্য বিস্তারের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ফলে দেখা দেয় সন্ত্রাস।
কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা: মাঝে মাঝে কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনাও তরুণ ছাত্রসমাজকে অসহিষ্ণু করে তোলে। যখন তিন বছরের কোর্স সমাপন করতে পাঁচ সাত বছর লাগে, তখন ছাত্ররা পড়াশোনায় মনোযোগ হারিয়ে অনৈতিক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে।
সন্ত্রাস প্রতিরোধের উপায়
রাজনৈতিক সদিচ্ছা: সন্ত্রাস প্রতিরোধের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার পরিচয় দিতে হবে। প্রশাসন কোনো সন্ত্রাসীকে পাকড়াও করলে তার পক্ষে সুপারিশ করা যাবে না। অপরদিকে সরকারি দল প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে ঘায়েল করার জন্য জেল-নির্যাতনের পথ বেছে নিলেও সন্ত্রাস দূর হবে না।
আরো পড়ুন : প্রবন্ধ রচনা : শিক্ষা ব্যবস্থা ও নৈতিকতা
লেখাপড়ার বাধ্যবাধকতা : নির্ধারিত সময়ে কোর্স সমাপ্ত ও পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা থাকলে ছাত্ররা লেখাপড়ায় ফিরে আসতে বাধ্য হবে। নিয়মিত অধ্যয়নকারী কোনো ছাত্র সন্ত্রাস করতে পারে না। এক্ষেত্রে শিক্ষকদেরকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
প্রশাসনের নিরপেক্ষতা: সন্ত্রাস দমনে প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। কোনো প্রভাবশালী মহলের বা সরকারি দলের নির্দেশে প্রতিপক্ষের ওপর নির্যাতন করা যাবে না। এক্ষেত্রে প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ থাকে, তাহলে সন্ত্রাস দমন করা সম্ভব।’
সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি: সাধারণ ছাত্রদেরকে সচেতন করে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সন্ত্রাসীদের একঘরে করে শিক্ষাঙ্গন থেকে সন্ত্রাস নির্মূল করতে হবে।
সন্ত্রাসের কুফল:
সন্ত্রাসের কুফল বলে শেষ করা যাবে না। দিন দিন সন্ত্রাস সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে জিম্মি করে তুলছে। শিক্ষার মানের অবনতি ঘটছে। সুস্থ শিক্ষার পরিবেশ না থাকায় দেশের ছাত্রসমাজ বিদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার বহির্গমন হচ্ছে। সন্ত্রাসের শিকার হয়ে মেধাবী ছাত্রদেরকে লাশ হয়ে ঘরে ফিরতে হচ্ছে। এতে দেশে মেধাশূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে।
সন্ত্রাস দমনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা:
জাতির শিক্ষার স্বার্থে সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গণ অবশ্যই কাম্য। নিজেদের শিক্ষা ও জীবন গঠনের স্বার্থে সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গণ গড়ে তুলতে ছাত্ররা অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। অধিকাংশ ছাত্র দরিদ্র পরিবার থেকে খুব কষ্ট করে শিক্ষাঙ্গণে পা রাখে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে নিজেকে গড়ে তোলার প্রত্যাশায়। কিন্তু অনেকেই রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সাথে জড়িয়ে পড়ে। রাজনৈতিক দলের কৌশলের চাপে পড়ে তারা সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয়।
রচনা : বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ
শিক্ষাঙ্গণে সন্ত্রাসীর সংখ্যা সীমিত। এদের চিহ্নিত করে ছাত্ররা তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে। সকল ছাত্র ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক দলের হাতের ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হবে। রাজনীতি আমাদের সমস্যা নয় বরং রাজনীতির নামে অনাচারই সমস্যা। তাই ছাত্ররা রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন হবে কিন্তু রাজনীতির হাতিয়ার হবে না। ছাত্র সমাজ জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না হয়ে পড়ালেখার প্রতি অধিক মনোনিবেশ করে শিক্ষার সমস্যাবলি জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরতে পারে।
সচেতন মহল সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষার পরিবেশ গঠনে মতামত ব্যক্ত করে আসছেন যে, কোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। ছাত্রদেরকেও মনে রাখতে হবে, তারাই দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের পরিবারের প্রতি দায়িত্ব রয়েছে, যারা তাদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য শিক্ষাঙ্গণে পাঠিয়েছে। অতএব ছাত্রদেরকে সন্ত্রাসের পথ পরিহার করে জীবনের সঠিক পথ বেছে নিতে হবে।
উপসংহার :
আমাদের শিক্ষার মানোন্নয়ন ও জাতির ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য শিক্ষাঙ্গনকে সন্ত্রাসমুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন। ছাত্ররা সঠিক পথে পরিচালিত হলে তা জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। সকল পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের পাশাপাশি ছাত্রদেরকেই এ ব্যাপারে বেশি তৎপর হতে হবে। কেননা, তাদের হাতেই জাতির ভবিষ্যৎ।