প্রিয় শিক্ষার্থীবৃন্দ আজকে যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে তা হলো শৈবাল ও ছত্রাক সম্পর্কে। এখানে বিস্তারিত মূল বিষয় গুলো আলোকপাত করা হয়েছে।আশা করি তোমাদের অনেক উপকারে আসবে। চলো শুরু করা যাক –
শৈবাল কি ?
শৈবাল হলো থ্যালোফাইটার অন্তর্গত সবুজ বর্ণের নিম্নস্তরের উদ্ভিদ। এরা সমাঙ্গদেহাঁ এককোষী বা বহুকোষী ক্লোরোফিল সমৃদ্ধ উদ্ভিদ। ক্লোরোফিল থাকায় এরা নিজের খাদ্য নিজেই তৈরি করতে পারে। সাধারণত জলজ পরিবেশে শৈবাল (Algae) জন্মে। স্পাইরোগাইরা, কারা, ভলভক্স, ক্লোরেলা প্রভৃতি শৈবালের উদাহরণ।
শৈবাল কাকে বলে ?
থ্যালোফাইটা বর্গের যে সকল উদ্ভিদ ক্লোরোফিলযুক্ত এবং সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য প্রস্তুত করতে পারে, তাদেরকে শৈবাল বলা হয়। যেমন – Chlorella, Spirogyra প্রভৃতি।
উপকারী হতে পারে : এগারিকাস কি? এর বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব, উপকারিতা ও অপকারিতা
শৈবালের বৈশিষ্ট্য সমূহ (Properties of Algae) :
- এরা ‘থালাস’ বা সমাঙ্গ জাতীয় ৷
- দেহ মূল, কাণ্ড ও পাতায় বিভক্ত নয় ৷
- ক্লোরোফিল আছে ।
- ক্লোরোফিল থাকার ফলে সমস্ত শৈবাল সালোকসংশ্লেষণ করতে পারে।
- সাধারণত জলজ উদ্ভিদ, কিন্তু অন্যান্য পরিবেশেও থাকতে পারে।
- দেহ এককোষী বা বহুকোষী হতে পারে ।
- এদের কোষপ্রাচীর সেলুলোজ, পেকটিন, মিউসিলেজ প্রভৃতি দ্বারা গঠিত।
- অধিকাংশ শৈবালের নিউক্লিয়াস সুসংগঠিত ।
- অধিকাংশ শৈবালের সঞ্চিত খাদ্য শর্করা।
- জননাঙ্গ কোন বন্ধ্যা আবরণী দ্বারা আবৃত থাকে না।
- জীবন চক্রের কোথাও ভ্রুণ উৎপন্ন হয় না ।
- শৈবালের জনন তিন প্রকার – ১। অঙ্গজ, ২। অযৌন, এবং ৩ । যৌন ।
শৈবাল এর গঠন :
নিচে শৈবালের বিভিন্ন প্রকারের দৈহিক গঠন ব্যাখ্যা করা হলো :
শৈবাল এককোষী বা বহুকোষী হতে পারে। এককোষী শৈবাল সচল (ফ্ল্যাজেলা থাকায়, যেমন- Chlamydomonas) বা নিশ্চল (ফ্ল্যাজেলাবিহীন, যেমন- Chlorella) হতে পারে। অনেক প্রজাতি আছে যাদের অনেকগুলো কোষ একসাথে কলোনি হিসেবে অবস্থান করে (যেমন- Volvox). অনেক শৈবাল প্রজাতি এমন আছে যাদের দেহ ফিলামেন্টাস। ফিলামেন্ট শাখান্বিত হতে পারে (যেমন- Chaetophora) আবার অশাখ হতে পারে (যেমন-Ulothrix, Spirogyra ) ।
বিশেষ জননাঙ্গ সৃষ্টি হয় কোনো কোনো শৈবালে। অনেক সামুদ্রিক শৈবালের দেহকে বাহ্যিকভাবে মূল, কাণ্ড ও পাতার ন্যায় অংশে বিভক্ত করা চলে। যেমন- Sargassum. সমুদ্রে কতক শৈবাল এতো লম্বা হয় যা মূলভাগের কোনো কোনো উঁচুবৃক্ষের সমান বা তারও বেশি। কোনো কোনো শৈবাল দেখতে পর্ব-মধ্যপর্ববিশিষ্ট মনে হয়। যেমন- Chara. কোনো কোনো শৈবালের দেহ লম্বা পাতার ন্যায়, যেমন – Ulva.
উপকারী হতে পারে : ইউলোথ্রিক্স (Ulothrix) কি ? এর গঠন এবং কিভাবে জনন ঘটে
শৈবাল কোথায় জন্মায় :
এরা প্রধানত জলজ উদ্ভিদ। পরিষ্কার স্বাদু ও লবণাক্ত পানি, অপরিষ্কার বদ্ধ জলাশয়, দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনের পানিতে ভাসমান অথবা পানিতে নিমজ্জিত কোনো অবলম্বনের সাথে সংযুক্ত অবস্থায় শৈবাল জন্মে থাকে। কয়েক প্রকার শৈবাল স্থলজ অর্থাৎ মাটিতে জন্মায়। এদের অন্যান্য উদ্ভিদ বা প্রাণিদেহের কলার মধ্যে অন্তর্বাসীরূপে অথবা ছত্রাকের সাথে মিথোজীবী সংগঠনরূপে অথবা অন্যান্য উদ্ভিদ বা প্রাণীদের পরাশ্রয়ীরূপেও জন্মাতে দেখা যায় ।
শৈবাল কিভাবে খাদ্য উৎপাদন করে ?
শৈবাল একটি জলজ উদ্ভিদ এবং এর দেহে ক্লোরোফিল থাকে। জলজ উদ্ভিদ হওয়ায় শৈবাল পানি থেকে CO2 গ্রহণ করে। সূর্যালোকের উপস্থিতিতে CO2 এবং পানি থেকে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় শর্করা জাতীয় খাদ্য উৎপন্ন করে। উৎপাদিত শর্করার কিছু অংশ শৈবাল তার প্রয়োজনীয় বিপাকীয় প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে ব্যবহার করে।
শৈবালের উপকারিতা ও অপকারিতা :
শৈবালের উপকারিতা:
→ উৎপাদক হিসেবে : জলাশয়ের খাদ্য চক্রে শৈবাল প্রধান উৎপাদক হিসেবে কাজ করে।
→ বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের যোগান : বহু বছর আগে বায়ুমন্ডলে কোন অক্সিজেন ছিলো না । নীলাভ-সবুজ শৈবাল প্রথম সালোকসংশ্লেষণ শুরু করে এবং লক্ষ লক্ষ বছরের সালোকসংশ্লেষণের ফলে বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন জমা হতে থাকে এবং বর্তমান পর্যায়ে আসে ।
→ মানুষের খাদ্য হিসেবে : প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন প্রজাতির শৈবাল যেমন- Chondrus crispus, Ulva lactuca প্রভৃতিকে মানুষ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে আসছে। মানুষের খাদ্য তালিকায় Chlorella একটি ভিটামিন সমৃদ্ধ শৈবাল ।
→ পশুখাদ্য হিসেবে : Rhodymenia, Alaria, Laaminaria saccharina, Ascophyllum প্রভৃতি শৈবাল ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
→ পরিবেশ দূষণ রোধ : সামুদ্রিক শৈবালেরা সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে পরিবেশ থেকে বিপুল পরিমান CO2 গ্রহণ করে এবং পরিবেশে O, ত্যাগ করে।
→ জৈব জ্বালানি (Biofual) : বর্তমানে জ্বালানির চাহিদা মেটানোর জন্য জৈব জ্বালানি তৈরির জন্য শৈবাল বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
উপকারী হতে পারে : স্পাইরোগাইরা কি? এর অবস্থান, গঠন, বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব বর্ণনা
→ সমুদ্রে মাছের অবস্থান নির্ণয় : মাঝে মাঝে সমুদ্রের নির্দিষ্ট অঞ্চলে শৈবালের আধিক্য ঘটে এবং খাদ্য প্রাপ্তির আশায় ঐ অঞ্চলে মাছেরও সংখ্যাধিক্য ঘটে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ঐ অঞ্চলগুলো শনাক্ত করে সহজেই প্রচুর পরিমাণ মাছ সংগ্রহ করা যায়।
শৈবালের অপকারিতা :
→ উদ্ভিদের রোগ সৃষ্টি : Cephaleuros virescens নামক শৈবাল (Algae) কফি, চা ইত্যাদি গাছে রোগ সৃষ্টি করে এসবের ফলন কমিয়ে দেয় ।
→ মাছের রোগ সৃষ্টি : কিছু কিছু শৈবাল মাছের ফুলকা রোগ সৃষ্টি করে। যেমন-Oedogonium
→ ওয়াটার রুম : জলাধারে পুষ্টির পরিমাণ বেড়ে গেলে কিছু নীলাভ সবুজ শৈবালের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে “ওয়াটার ব্লুম” সৃষ্টি হয়। এতে জলাধারের পানি দূষিত হয় এবং মাছ মরে যায় ।
→ রাস্তাঘাট পিচ্ছিল : অনেক সময় সরু রাস্তা, পুকুর ঘাট বা বাথরুমের মেঝেতে প্রচুর নীলাভ-সবুজ শৈবাল জন্মায় । এসব শৈবালের মিউসিলেজ (পিচ্ছিল) অবরণ রাস্তাঘাট পিচ্ছিল করে সমস্যার সৃষ্টি করে।
→ স্থাপনার ক্ষতি : দেয়ালে শৈবালের অতিবৃদ্ধি দালানের ক্ষতি সাধন করে থাকে।
ছত্রাক
ছত্রাক কি ?
ছত্রাক হলো ইউক্যারিওটিক ক্লোরোফিলবিহীন, পরভোজী, সমাঙ্গদেহী, অপুষ্পক এবং অযৌন ও যৌন জনন সক্ষম, রেণু উৎপাদনকারী জীব।
ছত্রাক কাকে বলে?
ক্লোরোফিলবিহীন এককোষী বা বহুকোষী সরল প্রকৃতির অভাস্কুলার সমাঙ্গদেহী উদ্ভিদগোষ্ঠীকে ছত্রাক বলে ।
উপকারী হতে পারে : লাইকেন কাকে বলে? লাইকেনের বৈশিষ্ট্য এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব
ছত্রাক এর বৈশিষ্ট্য :
- এরা ক্লোরোফিলবিহীন – অসবুজ, সালোকসংশ্লেষণে অক্ষম।
- এরা পরজীবী, মৃতজীবী বা মিথোজীবী হিসেবে বাস করে থাকে ।
- এদের কোষে সুগঠিত নিউক্লিয়াস ও বিভিন্ন অঙ্গাণু রয়েছে।
- কোষ প্রাচীর কাইটিন নির্মিত এবং সঞ্চিত খাদ্য গ্লাইকোজেন।
- এদের পরিবহণতন্ত্র নেই।
- এদের জননাঙ্গ এককোষী।
- জাইগোট স্ত্রীজননাঙ্গ থাকা অবস্থায় বহুকোষী ভ্রূণে পরিণত হয় না।
- হ্যাপ্লয়েড স্পোর দিয়ে বংশবিস্তার হয়।
- জাইগোটে মায়োসিস হয়।
ছত্রাকের উপকারিতা ও অপকারিতা :
ছত্রাকের ৫টি উপকারিতা :
১। খাদ্য হিসেবে : প্রাচীনকাল থেকে মানুষের খাদ্য হিসেবে ও খাদ্য সুস্বাদুকরণের জন্য ছত্রাক ব্যবহার করা হচ্ছে। মাশরুম বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে খাদ্য হিসেবে চাষ করা হয় ।
২। ওষুধ তৈরিতে : পৃথিবীর প্রথম বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলন Penicillium chrysogenum গণের ছত্রাক থেকে তৈরি ।
৩। জৈব এসিড ও উৎসেচক তৈরি : বিভিন্ন প্রজাতির ছত্রাক থেকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত বিভিন্ন জৈব এসিড ও উৎসেচক উৎপাদন করা হয়।
৪। কৃষিতে ব্যবহার : ছত্রাকের বহুমুখী ব্যবহার কৃষিতে দেখা যায়। মৃত জীবদেহ ও জৈববর্জ্য পচনের মাধ্যমে সার তৈরিতে ছত্রাকের ভূমিকা অতুলনীয় ।
৫। পরিবেশ সংরক্ষণে : বিভিন্ন প্রজাতির মৃত্তিকাবাসী ছত্রাক ভূমি গঠন ও মাটির বুনট সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। পরিবেশের ক্ষতিকর উপাদান শনাক্তকরণের জন্যও অনেক ছত্রাক ব্যবহার করা হয়।
উপকারী হতে পারে : স্পাইরোগাইরা কি? এর অবস্থান, গঠন, বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব বর্ণনা
ছত্রাকের ৫টি অপকারিতা :
১। খাদ্য পচন ও বিষক্রিয়া সৃষ্টি : বেশ কিছু মৃতজীবী ছত্রাক আমাদের খাদ্যদ্রব্যে পচন ও বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে।
২। উদ্ভিদের রোগ সৃষ্টি : পরজীবী ছত্রাক আবাদী ফসলের মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে।
৩। গৃহপালিত পশু, পাখি ও মাছের রোগ সৃষ্টি : বিভিন্ন প্রজাতির পরজীবী ছত্রাক গৃহপালিত প্রাণিদেহের অভ্যন্তরে ও বাইরে রোগ সৃষ্টি করে।
৪। মানুষের রোগ সৃষ্টি : বিভিন্ন প্রজাতির পরজীবী ছত্রাক মানুষের ত্বক, শ্বাসনালি, ফুসফুস, পরিপাকতন্ত্র, চক্ষু, লিভার, কিডনি প্রভৃতি অঙ্গের মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে ।
৫। দ্রব্যসামগ্রির ক্ষতিসাধন : কাঠের আসবাবপত্র, মূল্যবান দলিল, চামড়ার ব্যবহার্য দ্রব্য, ফটোফিল্ম, এমনকি সোনার গহনার ওপর বিভিন্ন প্রজাতির মৃতজীবী ছত্রাক জন্মে এগুলোকে নষ্ট করে ।
শৈবাল ও ছত্রাক এর মধ্যে পার্থক্য :
শৈবাল | ছত্রাক |
---|---|
১। শৈবালের দেহে ক্লোরোফিল থাকায় এরা সবুজ বর্ণের হয়। | ১। শৈবালের দেহে ক্লোরোফিল থাকায় এরা সবুজ বর্ণের হয়। |
২। এদের কোষপ্রাচীর সেলুলোজ নির্মিত । | ২। এদের কোষপ্রাচীর কাইটিন নির্মিত । |
৩। এদের খাদ্য শ্বেতসার হিসেবে জমা থাকে । | ৩। এদের খাদ্য গ্লাইকোজেন বা তৈলবিন্দু হিসেবে জমা থাকে। |
৪। এদের দেহে ক্লোরোফিল থাকায় এরা নিজেদের খাদ্য নিজেরাই তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ এরা স্বভোজী । | ৪। এদের দেহে ক্লোরোফিল না থাকায় নিজেদের খাদ্য নিজেরা প্রস্তুত করতে পারে না অর্থাৎ এরা পরভোজী। |
৫। এরা আলোর উপর নির্ভরশীল। তাই অন্ধকারে বাঁচতে পারে না। | ৫। এরা আলোর উপর নির্ভরশীল নয় তাই আলো ও অন্ধকার উভয় স্থানেই বাঁচতে পারে। |
৬। এদের অধিকাংশ পানিতে বাস করে। | ৬। এদের অধিকাংশ স্থলে বাস করে। |
উপকারী হতে পারে : আলুর লেট ব্লাইট রোগ এবং দাদ রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার