আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে সঠিক পথের দিশা দেয়ার জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। আর তাদের সত্যতা প্রমাণের জন্য স্বীয় নবী ও রাসূলগণের মাধ্যমে কিছু অলৌকিক ঘটনা প্রদর্শন করেছেন, যা মুজিজা নামে খ্যাত।
মুজিজা শব্দের অর্থ কি ?
মুজিজা -এর আভিধানিক অর্থ : المُعجِزَةُ শব্দটি إِعْجَازٌ থেকে গৃহীত। এটা বাবে أَفْعَالٌ থেকে اِسْمُ فَاعِلٍ এর وَاحِدٌ مُؤَنَّثٌ এর সীগাহ। যা ع – ج – ز মাদ্দাহ থেকে নির্গত। এটা আভিধানিক অর্থ হলো –
১. অক্ষমকারী।
২. অলৌকিক বিষয়।
৩. অসাধারণ কর্ম ।
৪. অস্বাভাবিক কর্ম।
৫. মুজিযা অর্থ দুর্বলকারী, অলৌকিক নিদর্শন,
৬. ইংরেজি প্রতিশব্দ— Miracle, Wonder ইত্যাদি,
মুজিজা কি ?
আল্লাহর পক্ষ থেকে তারই নির্দেশে সত্য প্রমাণের উদ্দেশ্যে নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে প্রকাশিত নিদর্শনই হলো মুজিজা।
আরও : মুজিযা ও কারামতের সংজ্ঞা, অর্থ ও পার্থক্য
মুজিজা কাকে বলে ?
শরিয়তের পরিভাষায়— নবী রাসূলগণের মাধ্যমে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম যে সকল অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, সেগুলোকে মুজিযা বলা হয়।
রাসূল (সাঃ) এর প্রধান মুজিজা কি কি?
মহান আল্লাহ রাসূল (স)-কে অনেক মুজিযা দান করেছেন। নিম্নে তাঁর প্রধান মুজিযাসমূহ উপস্থাপন করা হলো-
১. পবিত্র কুরআন : অন্যান্য সকল নবীর মুজিযা ছিল তাৎক্ষণিক। আর আল্লাহ মুহাম্মদ (স)-কে দিয়েছেন একটি চিরস্থায়ী মুজিযা, তা হলো পবিত্র কুরআন। আল্লাহ কুরআন নাযিল করে তৎকালীন আরবের বড় বড় কবি ও সাহিত্যিকদেরকে এর অনুকরণে ছোট্ট একটি সূরা তৈরি করতে আহ্বান করেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَإِنْ كُنتُمْ فِي رَيْبٍ مِمَّا نَزَّلْنَا عَلَى عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِنْ مِثْلِهِ وَادْعُوا شُهَدَاءكُمْ مِنْ دُونِ اللّهِ اِنْ كُنْتُمْ صَدِقِينَ .
অন্যত্র আল্লাহ কাফেরদের উক্তিকে এভাবে তুলে ধরেন এবং তারা তাতে অক্ষম হয়।
وَقَالُوا لَوْلَا يَأْتِينَا بِآيَةٍ مِنْ رَبِّهِ أَوَلَمْ تَأْتِهِمْ بَيِّنَةُ مَا فِي الصُّحُفِ الْأُولَى.
অর্থাৎ, তারা বলে, মুহাম্মদ তাঁর রবের নিকট হতে একটি নিদর্শন নিয়ে আসে না কেন? তাদের কাছে কি পূর্বতন গ্রন্থসমূহের সকল শিক্ষা সুস্পষ্ট হয়ে আসেনি। কুরআনের ভাষার ন্যায় এর জ্ঞানও মুজিযা। বৈজ্ঞানিকদের নতুন নতুন আবিষ্কারের সাথে সাথে প্রতি যুগেই মানবজাতি কুরআনের নতুন নতুন মুজিযা জানতে পারছে। অবশেষে তারা স্বীকার করেছে, এ গ্রন্থ মানবরচিত নয়।
আরও : নবী করীম (সা) এর: জন্ম, নাম, বংশ পরিচয় ও মর্যাদা
২. ইসরা ও মিরাজ : অলৌকিকভাবে রাত্রি ভ্রমণ ও ঊর্ধ্বগমন রাসূল (স)-এর অন্যতম প্রধান মুজিযা । মহান আল্লাহ বলেছেন-
سُبْحانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الاقصا الَّذِى بُرَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ ابْتِنَا – إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ . –
অর্থাৎ, পবিত্র ও মহিমাময় সেই সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীতে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম তথা মক্কার মসজিদ থেকে মসজিদুল আকসা তথা জেরুযালেমের মসজিদ পর্যন্ত। যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময় তাঁকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য। আর নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।
বিভিন্ন আয়াত ও বহুসংখ্যক সহীহ হাদীস প্রমাণ করে যে, রাসূল (স) জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে মিরাজে গমন করেন। সেখানে তিনি সিদরাতুল মুনতাহা, জান্নাত ও জাহান্নামসহ আল্লাহর বহু নিদর্শন প্রত্যক্ষ করেন। তাঁর বাহন ছিল বোরাক।
পবিত্র কুরআন ও হাদীসে মিরাজের নির্দিষ্ট কোনো তারিখ উল্লেখ করা হয়নি। তাই এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরাম অনেক মতামত ব্যক্ত করেছেন। তবে অধিকাংশের মতে, হিজরতের এক বছর পূর্বে রজবের ২৭ তারিখে মিরাজ সংঘটিত হয়েছে।
আরও : মুজিযা এর দৃষ্টান্ত, উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য কুরআনের আলোকে
আধুনিক বিজ্ঞান সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছে যে, জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে এরূপ অলৌকিক নৈশভ্রমণ ও ঊর্ধ্বারোহণ অসম্ভব নয়। মিরাজের ঘটনাবলির মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞানীরা আরো অনেক মুজিযার সন্ধান পেয়েছে।
৩. চন্দ্র খণ্ডিতকরণ : মক্কার কাফেররা রাসূল (স)-এর কাছে অলৌকিক নিদর্শনের দাবি করে। তখন রাতেরবেলায় তাঁর হাতের আঙ্গুলের ইশারায় পূর্ণিমার চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায় । কিছুক্ষণ পর আবার তা একত্রিত হয়। যেমন আল্লাহ্ তায়ালা বলেন-
اِقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ
সহীহ বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থের অনেক সহীহ হাদীসে চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে।
এছাড়া আরো অগণিত আয়াত ও হাদীসে তাঁর মুজিযার কথা বর্ণিত হয়েছে যেমন তাঁর দোয়ায় খাদ্যে অলৌকিক বরকত, সামান্য পানিতে হাত রাখলে ঝরনা বের হওয়া, যাতে মানুষ অযু, গোসল ও পানি পান করতে পারে, তার দোয়ায় মৃত ঝরনায় পানি সঞ্চার হওয়া, মাত্র দু’পাত্র পানি থেকে হাজার হাজার পাত্র পূর্ণ করা, অলৌকিকভাবে বৃষ্টিপাত হওয়া, ফসল অলৌকিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া,
হিজরতের পথে উম্মে মা’বাদ-এর ছাগল থেকে অস্বাভাবিক দুগ্ধ দোহন, খন্দকের পরিখা খননকালে পাথর থেকে এমন রশ্মি বের হওয়া যা রোম ও পারস্য পর্যন্ত আলোকিত করে দিয়েছিল। তাছাড়া তাঁর দোয়ায় অন্ধ ব্যক্তি দৃষ্টিশক্তি প্রাপ্ত হয়, মৃত্যু পথযাত্রী রোগী আরোগ্য লাভ করে, বাকশক্তিহীন কথা বলে এবং পাগল সুস্থ হয় ইত্যাদি ।