হোম পদার্থ রসায়ন জীব ইসলামিক

ইমাম আবু দাউদ(রহ)এর জীবনী ও আবি দাউদের বৈশিষ্ট্য

উপস্থাপনা : হাদীসের সুবিশাল পরিমণ্ডলে ইমাম আবু দাউদ (র) এক উজ্জ্বল ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের পরেই হাদীসবিশারদগণ তাঁর নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে নক্ষত্র। তিনি স্বীয় মহিমা ও স্বকীয়তায় সবিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। হাদীস গবেষণার ক্ষেত্রে থাকেন । ইলমে হাদীসে তাঁর অবদান চিরদিন অক্ষয় ও অম্লান হয়ে থাকবে।

ইমাম আবু দাউদ (রহ)-এর জীবনী :

১. জন্ম ও বংশ পরিচয় : তাঁর নাম সোলায়মান, উপনাম আবু দাউদ। পিতার নাম আশয়াস। তাঁর পুরা নাম আবু দাউদ সোলায়মান ইবনুল আশয়াস ইবনে ইসহাক আল আসাদী আস সিজিস্তানী।

ইমাম আবু দাউদ (র) ২০২ হিজরী মোতাবেক ৮১৭ খ্রিস্টাব্দে কান্দাহার ও চিশতের নিকটবর্তী সিজিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ঊর্ধ্বতন পুরুষ ইমরান আরব দেশের অধিবাসী এবং আসাদ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ইমরান তাঁর সমকালের সিফফীনের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং হযরত আলী (রা)-এর পক্ষে যুদ্ধ করে শহীদ হন।

আরো পড়ো : ইমাম বুখারী (র)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী (পয়েন্ট আকারে)

২. শিক্ষাজীবন : ইমাম আবু দাউদ (র)-এর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি সম্ভবত নিজ গ্রামেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। দশ বছর বয়সে তিনি নিসাপুরের এক মাদরাসায় ভর্তি হন। এখানেই তিনি প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে আসলামের কাছে হাদীসশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন।

হাদীসে উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্য তিনি মিসর, সিরিয়া, হেজায, ইরাক, খোরাসান প্রভৃতি বিখ্যাত হাদীস গবেষণা কেন্দ্ৰসমূহ ভ্রমণ করেন এবং তদানীন্তন সুবিখ্যাত মুহাদ্দিসগণের নিকট থেকে হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করেন। বসরা যাওয়ার পূর্বে তিনি খোরাসানে বিভিন্ন মুহাদ্দিসের নিকট হাদীসের শিক্ষা লাভ করেন ।

৩. তাঁর শিক্ষকবৃন্দ : তাঁর উল্লেখযোগ্য শিক্ষকগণ হলেন- ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ওসমান ইবনে আবু শায়বা, কুতাইবা ইবনে সাঈদ, ইয়াহইয়া ইবনে মুঈন (র)।

৪. কর্মজীবন : ইমাম আবু দাউদ (র) শিক্ষাজীবন শেষ করে ইলমে হাদীসের খেদমতে নিজেকে উৎসর্গ করেন। তিনি হাদীস চর্চা, গবেষণা ও শিক্ষাদানে সারা জীবন কাটিয়ে দেন। এ প্রেক্ষিতে তিনি হাদীসশাস্ত্রের অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো-

১. সুনানু আবি দাউদ, ২. মারাসীলে আবু দাউদ, ৩. আন নাসিখ ওয়াল মানসূখ, ৪. ফাযায়েলুল আনসার, ৫. মারেফাতুল আওকাত, ৬. কিতাবু বদউল অহী, ৭. আর রদ্দু আলাল কাদারিয়্যা, ৮. মুসনাদে মালেক ইবনে আনাস, ৯. আল মাসায়েল, ১০. মা তাফাররাদা বিহি আহলুল আসমার ইত্যাদি।

আরো পড়ো : ইমাম মুসলিম রহ এর জীবনী (পয়েন্ট ভিত্তিক)- pdf

৫. ছাত্রবৃন্দ : গ্রন্থ রচনার সাথে সাথে তিনি শিক্ষাদানে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। তার ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- ইমাম আবু ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা আত তিরমিযী, ইমাম আবদুর রহমান আহমদ ইবনে শুয়াইব আন নাসায়ী, আর আওয়ানা, আবু বিশর আদদুলাভী, আলী ইবনে হাসান ইবনুল আবদ, আবু উসামা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল মালেক, আবু সাঈদ ইবনে আরাবী, ইবনে ওয়াসা এবং স্বীয়পুত্র আবু বকর (র)।

৬. চরিত্র : তিনি ছিলেন আবেদ, যাহেদ, আল্লাহভীরু ও ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ। দুনিয়ার ভোগবিলাসের প্রতি তাঁর কোনো মোহ ছিল না। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি বর্ণনা প্রণিধানযোগ্য। যেমন-

ক. ইমাম দাসাহ (র) উল্লেখ করেন, ইমাম আবু দাউদ (র)-এর জামার একটি হাতা প্রশস্ত ও অপরটি সংকীর্ণ ছিল। তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, যে হাতাটি প্রশস্ত তার মধ্যে আমি লিখিত হাদীসগুলো রেখে দেই এবং সংকীর্ণ হাতার মধ্যে এ জাতীয় কিছু নেই ।

আরো পড়ো : ইমাম তিরমিযী (রহ)এর জীবনী ও তিরমিযী শরীফের বৈশিষ্ট্য

খ. মুসা ইবনে হারূন (র) বলেন, ইমাম আবু দাউদ (র) দুনিয়াতে হাদীসের খেদমত এবং আখেরাতে জান্নাত লাভের জন্য সৃষ্টি হয়েছেন। আমি তাঁর থেকে উত্তম কোনো ব্যক্তিকে দেখিনি।

গ. ইমাম হাকেম (র) বলেন, নিঃসন্দেহে ইমাম আবু দাউদ (র) তাঁর সমসাময়িক মুহাদ্দিসগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন।

ঘ. ঐতিহাসিক ইবনে তাগরিদী বলেন, তিনি ছিলেন হাদীসের হাফেয, সমালোচক ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ত্রুটি সম্পর্কে অবহিত আল্লাহভীরু এক মহান ব্যক্তি।

৭. মাযহাব : এ ব্যাপারে আলেমগণ কয়েকটি অভিমত ব্যক্ত করেছেন। যেমন-

ক. নওয়াব সিদ্দিক হাসানের মতে, ইমাম আবু দাউদ (র) শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন।

খ. আবু ইসহাক সিরাজী ও আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (র)-এর মতে, তিনি হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। কেননা তিনি তাঁর গ্রন্থে হাম্বলী মাযহাবের পক্ষে দলীল পেশ করা যায়, এমন সব হাদীসের প্রাধান্য দিয়েছেন ।

গ. কেউ কেউ বলেছেন, তিনি হানাফী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। তবে সঠিক কথা হলো, তিনি ব্যক্তিগতভাবে একজন মুজতাহিদ ছিলেন

৮. ইন্তেকাল : হাদীসশাস্ত্রের এ মহান ব্যক্তি ২৭৫ হিজরী সালের ১৬ শাওয়াল ৭৩ বছর বয়সে বসরা নগরে ইন্তেকাল করেন ।

৯. হাদীসশাস্ত্রে ইমাম আবু দাউদ (র)-এর অবদান : হাদীসশাস্ত্রে ইমাম আবু দাউদ (র)- এর অবদান অপরিসীম। তিনি শিক্ষাগ্রহণ শেষে হাদীসের খেদমতে জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। সারা জীবন সাধনা করে তিনি অনেক গ্রন্থ রচনা করেন এবং শিক্ষাদানের মাধ্যমে বহুসংখ্যক মুহাদ্দিস গড়ে তোলেন। তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান ‘সুনানু আবি দাউদ’, যা সিহাহ সিত্তার অন্যতম গ্রন্থ।

তিনি পাঁচ লক্ষ হাদীস হতে যাচাইবাছাই করে ৪,৮০০টি হাদীস নিয়ে এ গ্রন্থ সংকলন করেন। এর হাদীসসমূহ আহকাম সম্পর্কিত এবং অধিকাংশ মাশহুর পর্যায়ের। ফিকহশাস্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি এ গ্রন্থটি সজ্জিত করেন। ইমাম বুখারী (র)-এর পর ফিকহ সম্পর্কে তিনিই ছিলেন অধিক জ্ঞানসম্পন্ন মনীষী ।

মুহাদ্দিসগণ তাঁর এ হাদীসগ্রন্থকে প্রামাণ্য দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এজন্য ফিকহশাস্ত্র বিশারদগণ বলেছেন, একজন মুজতাহিদের পক্ষে ফিকহের মাসয়ালা বের করার জন্য আল্লাহর কিতাব কুরআন মাজীদের পর সুনানু আবি দাউদই যথেষ্ট । মুহাদ্দিস যাকারিয়া (র) বলেন, ইসলামের মূলমন্ত্র হলো আল্লাহর কিতাব, আর ইসলামের প্রামাণ্য গ্রন্থ হলো সুনানু আবি দাউদ ।

আরো পড়ো : ইমাম ইবনে মাজাহ এর জীবনী ও ইবনে মাজাহর বৈশিষ্ট্য

সুনানু আবি দাউদের বৈশিষ্ট্য :

সুনানু আবি দাউদ স্বীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। নিম্নে সুনানু আবি দাউদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো-

১. সুনান গ্রন্থ : সিহাহ সিত্তার অন্যতম গ্রন্থ সুনানু আবি দাউদ। এতে শরীয়তের হুকুম আহকাম এবং ব্যবহারিক জীবনের প্রয়োজনীয় নিয়মনীতি ও আদেশ নিষেধ সংবলিত হাদীসসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে এবং ফিকহের কিতাবের ন্যায় অধ্যায় ও পরিচ্ছেদে সাজানো হয়েছে ।

২. অত্যধিক যাচাইবাছাইকরণ : ইমাম আবু দাউদ (র) পাঁচ লক্ষ হাদীস থেকে যাচাইবাছাই করে মাত্র ৪,৮০০টি সহীহ হাদীসের মাধ্যমে এ গ্রন্থ সংকলন করেন। এ প্রসঙ্গে ইমাম আবু দাউদ (র) নিজেই বলেন-

অর্থাৎ, আমি রাসূলুল্লাহ (স)-এর পাঁচ লক্ষ হাদীস লিপিবদ্ধ করেছিলাম। তার মধ্য থেকে যাচাইবাছাই করে মনোনীত হাদীস এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছি

৩. দলীল উপস্থাপনা : সুনানু আবি দাউদে মাসয়ালা বর্ণনাক্ষেত্রে ইমামগণের মতামতের আলোকে পেশকৃত দলীল উপস্থাপন করা হয়েছে। ফলে তার মানগত ভিত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুনানু আবি দাউদ সম্পর্কে ফকীহদের মন্তব্য- একজন মুজতাহিদের পক্ষে ফিকহের মাসয়ালা বের করার জন্য আল্লাহর কিতাব কুরআনের পর এ সুনানু আবি দাউদই যথেষ্ট।

৪. সুলাসিয়াতের সন্নিবেশ : সুনানু আবি দাউদে সাহাবীর স্তর থেকে ইমাম আবু দাউদ (র) পর্যন্ত তিন রাবীবিশিষ্ট অনেক সুলাসিয়াত হাদীস স্থান পেয়েছে, যা এর মর্যাদাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

৫. শিরোনাম স্থাপন : ইমাম আবু দাউদ (র) তাঁর হাদীসগ্রন্থে সন্নিবেশিত হাদীসসমূহ ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে উপস্থাপন করেছেন ।

৬. মন্তব্য পেশ : বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে মন্তব্য পেশ করা সুনানে আবু দাউদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কোনো হাদীসের সনদ অথবা মতনে আপত্তিকর কিছু দেখলে ইমাম আবু দাউদ (র) قَالَ أَبُو دَاوُدَ বলে মন্তব্য পেশ করেছেন।

৭. হাদীসের সর্বজনগ্রাহ্য সংকলন : বিপুল গ্রহণযোগ্যতার কারণে সুনানে আবু দাউদ সর্বজনগ্রাহ্য সংকলনের মর্যাদা অর্জন করেছে। এ সম্পর্কে ইমাম আবু দাউদ (র) সে নিজেই বলেন- অর্থাৎ, জনগণ কর্তৃক সর্বসম্মতভাবে পরিত্যক্ত কোনো হাদীসই আমি এতে উদ্ধৃত করিনি।

৮. রেওয়ায়াতে বিশেষ শব্দের প্রাধান্য : সুনানু আবি দাউদে হাদীসসমূহ বর্ণনার ক্ষেত্রে حَدَّثَنَا ও عَنْعَنَت পদ্ধতিদ্বয় প্রাধান্য পেয়েছে।

৯. সিহাহ সিত্তার অন্যতম গ্রন্থ : সুনানু আবি দাউদ সিহাহ সিত্তার অন্যতম গ্রন্থ। এ প্রসঙ্গে হাফেয আবু জাফর ইবনে যোবায়ের গরনাতী (র) বলেছেন, ফিকহ সম্পর্কিত হাদীসসমূহ সামগ্রিক ও সবিস্তারে সংকলিত হওয়ার কারণে সুনানু আবি দাউদের যে বিশেষত্ব আছে, তা সিহাহ সিত্তার অপর কোনো গ্রন্থে নেই।

১০. ইসলামের লালন-গ্রন্থ : সুনানু আবি দাউদের প্রাধান্য বর্ণনা করতে গিয়ে মুহাদ্দিস আল্লামা যাকারিয়া সাজী (র) বলেন-অর্থাৎ, ইসলামের মূলমন্ত্র হলো পরাক্রমশালী মহানুভব আল্লাহর কিতাব, আর ইসলামের লালন-গ্রন্থ হলো সুনানে আবু দাউদ।

১১. আহকাম সম্পর্কিত হাদীস পেশ : সুনানু আবি দাউদের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হলো এতে ঈমান ও আহকামের হাদীস বেশি সংকলিত হয়েছে।

১২. যয়ীফ ও অজ্ঞাতনামা রাবীদের বর্ণনা : ইমাম আবু দাউদ (র) প্রকৃত সহীহ হাদীসের সমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রে যয়ীফ ও অজ্ঞাতনামা রাবীদের বর্ণনাও গ্রহণ করেছেন।

১৩. মুহাদ্দিসগণের নিকট সমধিক গ্রহণযোগ্য : গ্রন্থ সংকলন করে ইমাম আবু দাউদ (র) তা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র)-এর নিকট নিয়ে যান। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) এটাকে খুবই পছন্দ করেন এবং একে একটি উত্তম হাদীসগ্রন্থ বলে প্রশংসা করেন। মূলত তৎকালীন মুহাদ্দিসগণের নিকট এটি একটি অমূল্য সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল।

পরিশেষে : হাদীসশাস্ত্রের ইতিহাসে ইমাম আবু দাউদ (র) একটি অবিস্মরণীয় নাম এবং তাঁর রচিত সুনান গ্রন্থটি উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। বিশুদ্ধতার কারণেই গ্রন্থটি আজও শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন রয়েছে।

শিক্ষাগার

প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে

মাহমুদুল হাসান

শিক্ষাগত যোগ্যতা
গণিতে অনার্স ও মাস্টার্স

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

ফাজিল সম্পন্ন

গোপালপুর দারুল উলুম কামিল মাদ্রাসা

বিশেষ দক্ষতা

বাংলা সাহিত্য • গণিত • ইসলামিক শিক্ষা

অভিজ্ঞতা

শিক্ষকতা ও ৫+ বছর কন্টেন্ট রাইটিং

আমাদের লক্ষ্য

শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা সামগ্রী প্রদান করা। ২০২৩ সাল থেকে লাখো শিক্ষার্থী শিক্ষাগার থেকে উপকৃত হচ্ছে।

Leave a Comment