উপস্থাপনা : রাসূল (স)-এর ইন্তেকালের পর তাঁর সুন্নাহ সংরক্ষণ ও সংকলনে যেসব মহামনীষী ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন, ইমাম নাসায়ী (র) ছিলেন তাঁদের প্রথম সারির ব্যক্তিত্ব। তাঁর সংকলিত সুনানে নাসায়ী বিশুদ্ধতম ছয়টি হাদীসগ্রন্থের অন্যতম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। নিম্নে ইমাম নাসায়ী (র)-এর জীবনী ও তাঁর সংকলিত হাদীসগ্রন্থের বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো ।
ইমাম নাসায়ী (র) -এর জীবনী :
১. নাম ও পরিচয় : তাঁর নাম আহমাদ, উপনাম আবু আবদুর রহমান, পিতার নাম শুয়াইব । সুতরাং তাঁর পূর্ণ নাম হচ্ছে- আবু আবদুর রহমান আহমাদ ইবনে শুয়াইব ইবনে আলী ইবনে বাহার ইবনে সিনান আন নাসায়ী। বর্তমান ইরানের খোরাসান প্রদেশের নাসা নামক শহরে হিজরী ২১৫ সনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
২. শিক্ষাজীবন : খুব অল্প বয়সেই তিনি ইলমুল হাদীসের প্রতি গভীর অনুরাগ পোষণ করেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বিদেশ সফর শুরু করেন। প্রথমে তিনি কুতাইবা ইবনে সাঈদুল বালখী (র)-এর নিকট উপস্থিত হন এবং তথায় এক বছর দু’মাস অবস্থান করে তাঁর নিকট হতে হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করেন।
এরপর তিনি হিজরী ৩০২ সনে দামেস্কে উপস্থিত হন। পর্যায়ক্রমে তিনি মুসলিম জাহানের হাদীস চর্চা কেন্দ্ৰসমূহ ভ্রমণ করেন এবং হাদীস সংগ্রহের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেন ৷
আরো পড়ো : ইমাম আবু দাউদ(রহ)এর জীবনী ও আবি দাউদের বৈশিষ্ট্য
৩. শিক্ষকমণ্ডলী : ইমাম নাসায়ী (র) উচ্চ শ্রেণির অসংখ্য আলেমের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তাঁর প্রসিদ্ধ শিক্ষকগণ হচ্ছেন- কুতাইবা ইবনে সাঈদ বলখী, ইসহাক ইবনে রাহওয়াই, আলী ইবনে খুরাসান, আবু দাউদ, মুহাম্মদ ইবনে আবদুল আ’লা, মুহাম্মদ ইবনে বাশশার, ইউনুস ইবনে আবদুল আলা, মুজাহিদ ইবনে মুসা (র) প্রমুখ ।
৪. ছাত্রবৃন্দ : ইমাম নাসায়ী (র) ছিলেন তাঁর যুগের একজন সর্বশ্রেষ্ঠ হাদীসবিশারদ। ফলে হাদীসশাস্ত্রের জ্ঞান আহরণের জন্য বহু জ্ঞান পিপাসু তাঁর কাছে আগমন করতেন।
তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন- আবয়ায ইবনে মুহাম্মদ, আবুল আব্বাস আহমদ ইবনে আল হাসান, আবুল হাসান মুহাম্মদ ইবনে হাশেম, মানসুর ইবনে ইসমাঈল, ইয়াকুব ইবনে আল মুবারক, আবুল ফাতাহ ওবায়েদ ইবনে জাফর এবং আবুল হাসান আহমাদ ইবনে মাহবুব (র) প্রমুখ ।
৫. স্বভাবচরিত্র : তিনি খুবই আল্লাহভীরু লোক ছিলেন। প্রায়ই রোযা রাখতেন এবং সারা রাত আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতেন। প্রায় প্রতিবছর হজ্জ করতেন এবং জেহাদ করার মানসিকতা পোষণ করতেন। বাস্তব জীবনে তিনি সুন্নাতের পূর্ণ অনুসারী ছিলেন সর্বদা রাজদরবার থেকে দূরে থাকতেন। তিনি ছিলেন একজন সৎসাহসী মহাপুরুষ।
আরো পড়ো : ইমাম তিরমিযী (রহ)এর জীবনী ও তিরমিযী শরীফের বৈশিষ্ট্য
৬. হাদীসশাস্ত্রে তাঁর অবদান : সুনানুন নাসায়ী রচনা তাঁর হাদীসশাস্ত্রের উল্লেখযোগ্য অবদান। গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে তিনি এ গ্রন্থে হাদীস চয়ন করেছেন। এ গ্রন্থের প্রত্যেকটি হাদীস সহীহ। প্রতিটি হাদীস সংকলনের সময় তিনি ইস্তেখারা করতেন ।
৭. রচিত গ্রন্থাবলি : ইমাম নাসায়ী (র) অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে-
- السُّنَنُ الكُبْرَى
- السُّنَنُ الصُّغْرَى
- كِتَابُ عَمَلِ اليَوْمِ وَاللَّيْلَةِ
- مُسْنَدُ عَلِيٍّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ
- كِتَابُ الضُّعَفَاءِ وَالمَتْرُوكِينَ
- مُسْنَدُ حَدِيثِ مَالِكِ بْنِ أَنَسٍ
- مُسْنَدُ حَدِيثِ الزُّهْرِيِّ
- الأَغْرَابُ
- كِتَابُ فَضَائِلِ القُرْآنِ
- كِتَابُ التَّفْسِيرِ
- كِتَابُ الجُمُعَةِ
- غَرَائِبُ الزُّهْرِيِّ
- كِتَابُ المَنَاسِكِ
৮. নির্যাতনের শিকার : তিনি ৩০২ হিজরীতে দামেস্কে উপস্থিত হন। এখানে তিনি উমাইয়া শাসকগণ কর্তৃক হযরত আলী (রা) ও খান্দানে রাসূল (স)-এর অবমাননা এবং অপপ্রচার দেখে দারুণভাবে মর্মাহত হন। তখন হযরত আলী (রা) ও রাসূল (স)-এর পরিবারের প্রশংসামূলক একটি গ্রন্থ রচনা করেন।
অতঃপর দামেস্কের জামে মসজিদে উপস্থিত লোক সম্মুখে তা পড়তে শুরু করলে তাঁর বিরুদ্ধে শিয়া অপবাদ দিয়ে উমাইয়াগণ তাঁকে বেদম প্রহার শুরু করে। ফলে বৃদ্ধ ইমাম মারাত্মক আহত ও কাতর হয়ে পড়েন।
আরো পড়ো : ইমাম ইবনে মাজাহ এর জীবনী ও ইবনে মাজাহর বৈশিষ্ট্য
৯. ইন্তেকাল : উমাইয়াগণ কর্তৃক নির্মম প্রহারের ফলে ইমাম নাসায়ী (র) মারাত্মকভাবে আহত হলে শেষ ইচ্ছা হিসেবে তাঁকে মক্কায় পৌছে দিতে অনুরোধ করেন, যেন সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারেন। আশঙ্কাগ্রস্তভাবে তাঁকে মক্কায় নেয়া হলে সেখানে হিজরী ৩০৩ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর । সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী স্থানে তাঁকে দাফন করা হয় ।
সুনানুন নাসায়ীর বৈশিষ্ট্যসমূহ :
১. নাসায়ী প্রকৃত অর্থে একটি সুনান গ্রন্থ। কারণ এ গ্রন্থে শুধু ইবাদত ও তাহারাত বিষয়ক হাদীস অধিক ।
২. ইমাম নাসায়ী হাদীস নির্বাচনে ইমাম বুখারী ও মুসলিমের রীতি অনুসরণ করেন।
৩. ইমাম নাসায়ী প্রথমে সহীহ ও দোষমুক্ত উভয় প্রকারের হাদীস সন্নিবেশ করে তাঁর গ্রন্থ সংকলন করেন। অতঃপর তা হতে কঠোর শর্তাধীনে সংক্ষিপ্ত সংস্করণ তৈরি করেন। যার নামকরণ করেন السُّنَنُ الصُّغْرَى এরই অপর নাম المُجْتَبَى
৪. এ গ্রন্থে ইলালুল হাদীসের জন্য পৃথক অধ্যায় সংযোজন করে তাতে হাদীসের ইল্লত সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হয়েছে।
৫. এ গ্রন্থের মাঝে মাঝে قَالَ الحَارِسُ بْنُ مِسْكِينٍ قِرَاءَةً عَلَيْهِ وَأَنَا أَسْمَعُ লেখা দেখা যায়। এর কারণ হলো, ইমাম নাসায়ী ও তাঁর শিক্ষক হারেস ইবনে মিসকীনের মধ্যে সম্পর্ক ছিল না বিধায় আড়াল থেকে হাদীস শ্রবণ করতেন।
আরো পড়ো : বুখারী শরীফের বৈশিষ্ট্য, প্রেক্ষাপট ও তার অবদান বিস্তারিত
৬. এ গ্রন্থে বর্ণনাকারীর নাম, উপনাম, উপাধি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা পেশ করা হয়েছে।
৭. কয়েক লক্ষ হাদীস থেকে এ গ্রন্থে মাত্র ৪৪৮২টি নির্ভুল হাদীস গৃহীত হয়েছে। এ গ্রন্থে আছে ১৫টি অধ্যায় ও ১৭৪৪টি পরিচ্ছেদ।
৮. এ গ্রন্থের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে ইমাম নাসায়ী (র) স্বয়ং দাবি করেন- المُنْتَخَبُ المُسَمَّى بِالمُجْتَبَى صَحِيحٌ كُلُّهُ
৯. প্রায় সকল মুহাদ্দিস এ ব্যাপারে একমত যে, অন্যদের বর্ণিত হাদীসের তুলনায় বিশুদ্ধতার বিচারে সুনানে নাসায়ী অধিকতর নির্ভরযোগ্য।
১০. এতে প্রতিটি হাদীস বিশুদ্ধ পদ্ধতিতে বর্ণিত হয়েছে। তাই এ গ্রন্থের হাদীসগুলো সন্দেহের ঊর্ধ্বে। যেমন হাফেয আবুল হাসান মুয়াফিরী বলেন, “হাদীসের পণ্ডিতগণ যেসব হাদীস তাখরীজ করেছেন, সেগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় যে, ইমাম নাসায়ী যে হাদীস তাখরীজ করেছেন, তা অন্যান্য মুহাদ্দিসগণের তাখরীজকৃত হাদীস অপেক্ষা বিশুদ্ধ” ।
১১. এ গ্রন্থের বিন্যাসপদ্ধতি অতি সুন্দর ও চমৎকার। এতে সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের বৈশিষ্ট্যগুলোর অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। এতে বিভিন্ন মাসয়ালা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে সহীহ বুখারীর অনুসরণ করা হয়েছে এবং রচনা বিন্যাসের দিক দিয়ে সহীহ মুসলিমের অনুসরণ করা হয়েছে।
পরিশেষে : ইমাম নাসায়ী (র) ইসলামের ইতিহাসের এক কীর্তিমান মহামনীষী। ইলমে হাদীসের বিশুদ্ধতম সংকলন ও গ্রন্থায়নে তাঁর অবদান ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে । তাঁর অবদানের স্বীকৃতি সুনানুন নাসায়ীকে সিহাহ সিত্তার অন্যতম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।