মহানবী (স)-এর মুখনিঃসৃত বাণী আল হাদীস তাঁর জীবদ্দশায় কুরআনের সাথে সংমিশ্রণের আশঙ্কা, রাসূল (স)-এর নিষেধাজ্ঞা এবং লিখন সামগ্রীর অপ্রতুলতার কারণে গ্রন্থাকারে সংগৃহীত ও সংকলিত হয়নি।
উপরন্তু সাহাবীগণের তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তি থাকার কারণে গ্রন্থাকারে সংকলন করার প্রয়োজনীয়তাও অনুভূত হয়নি। তারপরও সাহাবীগণের কেউ কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু কিছু হাদীস সংকলন করেছিলেন। নিম্নে হাদিস সংকলনের ইতিহাস বিস্তারিত আলোচনা করা হলো ।
হাদিস সংকলনের ইতিহাস :
হাদিস সংকলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা হাদীস সংকলনের প্রক্রিয়াকে ৭টি স্তরে ভাগ করতে পারি। যথা- ক. মহানবী (স)-এর যুগে হাদীস সংকলন, খ. খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে হাদীস সংলকন, গ. ওমর ইবনে আবদুল আযীয (র)-এর যুগে হাদীস সংকলন, ঘ. হিজরী প্রথম শতকে হাদীস সংকলন, ঙ. হিজরী দ্বিতীয় শতকে হাদীস সংকলন, চ. হিজরী তৃতীয় শতকে হাদীস সংকলন, ছ. মুতাওয়াক্কিলের যুগে হাদীস সংকলন।
আরো দেখো : হাদিস কাকে বলে? হাদিসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা
ক. মহানবী (স)-এর যুগে হাদীস সংকলন : ইসলামের প্রাথমিক যুগে পবিত্র কুরআনের সাথে হাদীসের সংমিশ্রণের আশঙ্কায় মহানবী (স) হাদীস সংকলনের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। যেমন মহানবী (স)-এর বাণী-
وَلَا تَكْتُبُوا عَنِّي غَيْرَ القُرْآنِ، وَمَنْ كَتَبَهُ فَلْيَمْحُهُ
পরবর্তীতে রাসূল (স) লেখার মাধ্যমে হাদীস সংরক্ষণের অনুমতি প্রদান করলে বিভিন্ন কেন্দ্রস্থলে যোগ্য ব্যক্তিদের অক্লান্ত পরিশ্রমে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলিত হয়। যেমন-
১. মদিনা সনদ : পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত সনদ। তথা মদিনা সনদ হাদীস সংকলনের প্রথম অনুপ্রেরণা ।
২. ইসলাম গ্রহণকারীদের নামের তালিকা : মহানবী (স) মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নবমুসলিমদের নামের তালিকা প্রণয়ন করতে নির্দেশ প্রদান করেন। এ সম্পর্কে হযরত আবু হোরায়রা (রা) বলেন-
وَكَتَبْنَا لَهُمْ أَلْفًا وَخَمْسَ مِائَةِ رَجُلٍ
৩. আবু যরের লেখা : ঐতিহাসিক হাফেয ইবনে আবদুল বার (র) লিখেছেন- রাসূল (স) আমর ইবনে হাযম (রা) ও অন্যান্যকে সদকা, দিয়ত, ফারায়েয এবং সুন্নাত সম্পর্কে এক দস্তাবেজ লিখে দিয়েছিলেন।
আরো দেখো : হাদিস(حَدِيثٌ) অর্থ, সংজ্ঞা, প্রকারভেদ,উদ্দেশ্য ও আলোচ্য বিষয়
৪. সন্ধিপত্র : বনু সাকীফের সাথে রাসূল (স) এক সন্ধিপত্র সম্পাদন করেন, যা নিম্নরূপে শুরু হয়েছিল-
هٰذَا الكِتَابُ مِن رَسُولِ ٱللَّهِ صَلَّى ٱللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِثَقِيفٍ
৫. অন্যান্য : বিভিন্ন গোত্র ও সম্প্রদায়ের প্রতি বিভিন্ন সময় লিখিত ফরমান, বিভিন্ন বাদশাহ ও রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে লিখিত ইসলামের দাওয়াত সংবলিত চিঠি ইত্যাদির মাধ্যমে রাসূল (স)-এর হাদীস সংকলিত ও সংরক্ষিত হয়।
খ. খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে হাদীস সংকলন : কুরআন মাজীদ গ্রন্থাকারে পূর্ণাঙ্গভাবে লিপিবদ্ধ হওয়ার পর কুরআন ও হাদীসের মাঝে সংমিশ্রণের আশঙ্কা দূরীভূত হয়ে যায়। আর তখন থেকে সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণ হাদীস সংকলনের প্রতি সচেষ্ট হন। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১. হযরত আবু বকর (রা) : হযরত আবু বকর (রা) নিজে পাঁচশত হাদীসের একটি সংকলন প্রস্তুত করেছিলেন, তবে শেষ জীবনে তিনি নিজেই তা নষ্ট করে ফেলেন। কোনো শব্দ ভুল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তিনি এমন করেছেন। তাই দেখা যায়, তিনি মহানবী (স) থেকে একেবারেই কমসংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন।
আরো দেখো : উসুলুল হাদিস:অর্থ,সংজ্ঞা,আলোচ্য বিষয়,উদ্দেশ্য,উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
২. হযরত ওমর (রা) : হযরত ওমর (রা) ইসলামের ভিত্তি হিসেবে পবিত্র কুরআনের পরেই হাদীসকে স্থান দিতেন। তিনি তাঁর শাসনকার্য পরিচালনায় হাদীস লিপিবদ্ধ করে শাসকদের নিকট প্রেরণ করতেন। তাঁর খেলাফতকালে হযরত আবু মুসা আশয়ারী (রা) কুফার শাসনভার গ্রহণ করে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,
بَعَثَنِي إِلَيْكُمْ عُمَرُ ابْنُ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أُعَلِّمُكُمْ كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّكُمْ
এতেই প্রমাণিত হয়, হযরত ওমর (রা)-এর হাদীসের প্রতি অনুরাগ কতটা গভীর ছিল।
৩. হযরত ওসমান (রা) : হযরত ওসমান (রা) খুব কমসংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন। কারণ তিনি ভুল হওয়ার আশঙ্কায় হাদীস বর্ণনা করা থেকে এক প্রকার বিরত ছিলেন বলা চলে।
৪. হযরত আলী (রা) : যে কয়জন সাহাবী হাদীস লিপিবদ্ধ করেছিলেন হযরত আলী (রা) ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তাঁর লিখিত গ্রন্থটির নাম ছিল সহীফা। অবশ্য সাহাবায়ে কেরামের এ সংগ্রহ ও সংকলন ছিল সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত পর্যায়ে। তবে সামগ্রিকভাবে হাদীস সংকলন হয়েছিল পঞ্চম খলিফা খ্যাত হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয (র)-এর শাসনামলে ।
গ. ওমর ইবনে আবদুল আযীযের শাসনামলে হাদীস সংকলন : ৯৯ হিজরীতে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয (র) খলিফা নির্বাচিত হয়ে হাদীসের বিক্ষিপ্ত সম্পদকে একত্রিত করে সংকলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনি ইসলামী রাজ্যের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে হাদীস সংকলনের প্রয়োজন অনুভব করে কতিপয় পন্থা গ্রহণ করেন। যেমন-
১. মহানবীর অনুসরণ : রাসূল (স)-এর অনুসরণ ও আনুগত্যের জন্য হাদীস সংকলন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়।
২. হাফেযে হাদীসগণের ইন্তেকাল : যে সকল সাহাবী হাদীস মুখস্থ করেছিলেন, তাঁদের মৃত্যু ও শাহাদাত হাদীস সংকলনের পথকে উন্মুক্ত করে দেয়।
আরো দেখো : হাদিস বর্ণনাকারীর স্তর কয়টি ?বেশি হাদিস বর্ণনাকারী ৭ সাহাবী
৩. কুরআন হৃদয়ঙ্গমের নিমিত্ত : হাদীস কুরআনের ব্যাখ্যাগ্রন্থ। তাই কুরআনের ন্যায় হাদীসকেও গ্রন্থাকারে সংকলন করার তীব্র প্রয়োজনীয়তা সে সময়ে অনুভূত হয়েছিল।
৪. মুসলিম সাম্রাজ্যের অভাবনীয় বিস্তৃতি : মুসলিম সাম্রাজ্যের অভাবনীয় বিস্তৃতির কারণে বহুবিধ নতুন নতুন সমস্যার সমাধানের জন্য হাদীস সংকলন অতীব প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়।
৫. জাল হাদীস প্রণয়ন : এ সময় কতিপয় ইসলামবিরোধী ও বিদয়াতী নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ ও মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য মিথ্যা ও জাল হাদীস তৈরি করায় প্রকৃত হাদীসসমূহ সনদসহ সংকলনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় ।
৬. খলিফার ফরমান জারি : দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথম দিকে উমাইয়া খলিফা হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয (র) ইসলামী রাষ্ট্রের মগ্ন এলাকায় এ ফরমান জারি করেন যে-
اُنْظُرْ ما كانَ مِنْ حَديثِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَاكْتُبْهُ، فَإِنِّي خِفْتُ دُرُوسَ العِلْمِ وَذَهَابَ العُلَماءِ
৭. হাদীস সংকলনে মুহাদ্দিসগণের আত্মনিয়োগ : সে সময় ইসলামী রাষ্ট্রের আনাচে- কানাচে মুহাদ্দিসগণ হাদীসে নববী পুস্তকে লিপিবদ্ধ করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
আরো জানো : সিহাহ সিত্তাহ কি? কয়টি ও কি কি। সংকলকের নাম সমূহ
ঘ. হিজরী প্রথম শতকে হাদীস সংকলন : খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আযীয (র)-এর আদেশক্রমে ইমাম শাবী, ইমাম যুহরী, ইমাম মাকহুল দামেস্কী ও কাযী আবু বকর ইবনে হাযম (র) হাদীস সংকলনে মনোনিবেশ করেন। এ শতকে হাদীস সংকলনের কাজ সামান্য হলেও এরই ফলে যে হাদীস গ্রন্থাকারে সংকলনের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছিল তা অনস্বীকার্য
হিজরী দ্বিতীয় শতকে হাদীস সংকলন : দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথম থেকেই হাদীস সংকলনের কাজ শুরু হয়। তবে এ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এ কাজ নিয়মিতভাবে চলতে থাকে । এ যুগে সংকলিত গ্রন্থগুলো হলো-
১. কিতাবুল আসার- ইমাম আবু হানীফা (র)।
২. মুয়াত্তা ইমাম মালেক (র)।
৩. আল জামে- সুফিয়ান সাওরী (র) ।
৪. কিতাবুস সুনান- ইমাম মাকহুল (র)
৫. কিতাবুস সুনান- আবু আমর আওযায়ী (র)।
৬. কিতাবুস সুনান- আবু সাঈদ ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়া (র)।
৭. কিতাবুল মাগাযী- আবু বকর ইবনে হাযম (র)।
৮. কিতাবুস সুনান, কিতাবুয যুহদ, কিতাবুল মানাকিব- যায়েদ ইবনে কুদামা (র)।
৯. ইমাম শাবী (র) একই বিষয়ের হাদীস একই স্থানে একত্রিত করে একটি গ্রন্থে রূপ দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তা মাত্র কয়েকটি অধ্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল। এর বেশি তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। এ যুগের হাদীস সংকলন পদ্ধতিকে বলা হয় তাদভীন।
চ. হিজরী তৃতীয় শতকে হাদীস সংকলন : হিজরী তৃতীয় শতকে মুসলিম জাহানে যারা হাদীস শিক্ষাদান ও গ্রন্থ প্রণয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন তাঁরা হলেন, আলী ইবনুল মাদানী, ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন, আবু যুরয়া রাযী, আবু হাতেম রাযী, মুহাম্মদ ইবনে জারীর তাবারী, ইবনে খোযায়মা, ইসহাক ইবনে রাহওয়াই, মুহাম্মদ ইবনে সাদ ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) প্রমুখ ।
ছ. মুতাওয়াক্কিলের যুগে হাদীস সংকলন : আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়াক্কিলের যুগ হচ্ছে হাদীস সংরক্ষণ ও সংকলনের সোনালি যুগ। এ যুগে মুহাদ্দিসগণ নির্ভরযোগ হাদীসসমূহ একত্রিতকরণের প্রতি আত্মনিয়োগ করেন। এ যুগ তৃতীয় শেষার্ধ হতে শুরু হয়ে পঞ্চম শতাব্দীতে শেষ হয় ।
১. হাদীস যাচাইয়ের মানদণ্ড নির্ণয় : মুহাদ্দিসগণ সহীহ হাদীস ও জাল হাদীসের মধ্যে পার্থক্য প্রমাণ করার জন্য رَاوِيَة ও دِرَايَة নামে দুটি পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা অত্যন্ত যাচাইবাছাই করে সহীহ হাদীসগ্রন্থ প্রণয়ন করেন ।
২. মাদরাসা স্থাপন : সে সময় একদল স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র থেকে ইসলামী সভ্যতা রক্ষা করার জন্য খলিফা মুতাওয়াক্কিল সরকারিভাবে হাদীস সংকলনে উদ্যোগী হন তিনি হাদীস শিক্ষাদানের জন্য অনেক মাদরাসা স্থাপন করেন ।
৩. সিহাহ সিত্তাহ প্রণয়ন : আল্লাহর অনুগ্রহে ইমাম বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী, তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ (র)-এর মতো কতিপয় মনীষীর আবির্ভাব ঘটে। তাঁরা অনেক কষ্ট স্বীকার করে বিশুদ্ধ ছয়টি হাদীসগ্রন্থ রচনা করেন।
8. রেওয়ায়াত ও দোয়াত : মুহাদ্দিসগণ সহীহ হাদীস ও জাল হাদীসের মধ্যে পার্থক্য প্রমাণ করার জন্য রেওয়াত ও দোয়াত নামে দুটি হাদীস পরীক্ষণ পদ্ধতি গ্রহণ করেন।
পরিশেষে : খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে হাদীস সংগ্রহের কাজ শুরু হলেও সামগ্রিকভাবে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের কাজ শুরু হয় পঞ্চম খলিফা হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয (র)-এর যুগে । তখন থেকেই হাদীসের বিস্তার শুরু হয়।
হাদিস সংকলনের ইতিহাস – pdf
ফাইল সাইজ: 232 KB | ফরম্যাট: PDF
আপনার ফাইল প্রস্তুত হচ্ছে… অপেক্ষা করুন
30 সেকেন্ড
অথবা