উপস্থাপনা : সাহিত্যে নামকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ নামকরণের মধ্য দিয়েই কোনো রচনার আলোচ্য বিষয়ের প্রভাব প্রতিফলিত হয়ে ওঠে। মনোরম ও আকর্ষণীয় নামের ছোঁয়ায় পাঠকের মন আলোড়িত হয়, আগ্রহ জন্মে রচনাটি পড়ার।
এসব কারণে যে-কোনো গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা ইত্যাদির নামকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব দিক বিবেচনা করে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর অসাধারণ ছোটগল্প ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ গল্পের নামকরণ করেছেন।
সাহিত্যে নামকরণের রীতি : বলা হয়— Literature is the mirror of life অর্থাৎ, সাহিত্য জীবনের দর্পণ। আর সাহিত্যের দর্পণ হলো নামকরণ। কেননা নামকরণের মাধ্যমেই সাহিত্যকর্মের মূলভাব পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে।
আরও জানো : পথ জানা নাই গল্পের নামকরণের সার্থকতা
এজন্য প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক Cavendis বলেন- A beautiful name is better than a lot of wealth. অর্থাৎ, একটি সুন্দর নাম অনেক সম্পদের চেয়েও উত্তম । আলোচ্য বিষয়ের সাথে ন্যূনতম সামঞ্জস্য না থাকলে সাহিত্যের নামকরণ সার্থক হয় না। সুতরাং একটি শিল্পকর্মকে সার্থক করে তুলতে নামকরণের রীতিনীতি যথাযথ মেনে চলতে হয় ।
নামকরণের ভিত্তি : বিভিন্ন রচনা, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা ইত্যাদির নামকরণের মাধ্যমে এর অভীষ্ট লক্ষ্য, ভাব ও বক্তব্য প্রতিভাত হয়ে ওঠে। তাই সাহিত্যের নামকরণের ক্ষেত্রে লেখককে বিচক্ষণতার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ের প্রতি নজর দিতে হয়। যথা-
- রচনার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য
- নায়ক-নায়িকার নাম
- স্থান বা কাল ।
- কেন্দ্রীয় চরিত্র
- রূপক বা প্রতীকী ব্যঞ্জনা
আলোচ্য গল্পের নামকরণের প্রতিপাদ্য : ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ গল্পের নামকরণটি রূপক। এ রূপকের অন্তরালে গল্পকার একটি অন্তর্নিহিত তাৎপর্য উপস্থাপন করেছেন। তুলসী গাছ এখানে রূপক সাংকেতিক অর্থে প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেছে।
আরও জানো : পাদটীকা গল্পের নামকরণের সার্থকতা
গল্পের বিষয়বস্তু : ব্রিটিশশাসিত ভারত স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৭ সালে ১৫ই আগস্ট। দেশ স্বাধীন হয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে (হিন্দুদের জন্য ভারত, মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান)। ঢাকা তখন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী।
দেশ বিভাগের পরপরই পাকিস্তানে বসবাসরত হিন্দুরা ভারতে আর ভারতে বসবাসরত মুসলমানরা কেউ পশ্চিম পাকিস্তানে কেউ বা পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি জমায়। এরকম উদ্বাস্তুদের কয়েকজন কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে একটি পরিত্যক্ত হিন্দু বাড়ি দখল করে বসবাস শুরু করে।
মোদাব্বের, মতিন, মকসুদ, আমজাদসহ কয়েকজন উদ্বাস্তু একসঙ্গে থাকে, খায়দায়, গান গায় । সুখ-দুঃখের আনন্দময় জীবনের আসর পাতে একসঙ্গে নিরাশ্রয় এ মানুষগুলো। একদিন মোদাব্বের বাড়িতে একটি তুলসী গাছ আবিষ্কার করে। তুলসী গাছটি হিন্দুয়ানি চিহ্ন হিসেবে উপড়ে ফেলতে চায় সে, কিন্তু অন্যদের হস্তক্ষেপে তা আর উপড়ে ফেলা হয় না; বরং তাদের মধ্যে একজন গাছটির যত্ন নেয় ।
গাছটির প্রতি এবং এ বাড়িটি ফেলে যাওয়া হিন্দু পরিবারের প্রতি মমতায় ভরে ওঠে ওদের মন। একসময় পুলিশ এসে বাড়িটি থেকে তাদের উচ্ছেদ করে। তখন তুলসী গাছটিও যত্ন না পেয়ে শুকিয়ে আসে। গাছটি হয়ে ওঠে হাজার হাজার আশ্রয়হীন, যত্নহীন উদ্বাস্তু মানুষের প্রতিচ্ছবি।
নামকরণের সার্থকতা : বেঁচে থাকার জন্য আশ্রয় দরকার, সেবা দরকার। উদ্বাস্তু জীবনে যা সম্ভব নয় । হাজার হাজার উদ্বাস্তু মানুষের প্রতীক তুলসী গাছটি রূপক অর্থে গল্পের প্রধান অংশ দখল করে নিয়েছে। তুলসী গাছের মতোই উদ্বাস্তুরা দেশভাগের পর অবহেলিত ও নিগৃহীত হয়েছে।
গল্পকার তুলসী গাছের মাধ্যমে সমাজের একটি বাস্তবচিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন নির্মোহ চিত্তে । সুতরাং একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, আলোচ্য গল্পের নামকরণ ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ যথার্থ ও সঠিক হয়েছে।
উপসংহার : আলোচ্য গল্পে তুলসী গাছটি প্রতীকী ব্যঞ্জনায়, নান্দনিকভাবে বেড়ে উঠেছে, হয়ে উঠেছে সমগ্র গল্পের কাহিনি ও বক্তব্যের কেন্দ্রবিন্দু। তাই গল্পটির নামকরণ ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ কৌতূহলোদ্দীপক, চিত্তাকর্ষক, আকর্ষণীয়, যথার্থ ও সার্থক হয়েছে।