বাংলা ব্যাকরণে কারক একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর অর্থ ‘যাহা ক্রিয়া সম্পাদন করে। তাছাড়া শব্দ যখন বাক্যে ব্যবহৃত হয়, তখন তাকে বলে পদ। বাক্যে ব্যবহৃত পদগুলোর মধ্যে একটি পারস্পরিক সম্পর্ক থাকে। বাংলা ব্যাকরণে এ সম্পর্ককে কারক বলে ।
কারক শব্দের অর্থ কি ?
‘কৃ’ ধাতুর সাথে ‘নক’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে (√কৃ + নক) কারক শব্দটি গঠিত হয়েছে। ‘কৃ’ শব্দের অর্থ ‘করা’ । অর্থাৎ ‘কারক’ শব্দের অর্থ ‘যাহা ক্রিয়া সম্পাদন করে। তাছাড়া শব্দ যখন বাক্যে ব্যবহৃত হয়, তখন তাকে পদ বলে ।
কারক কাকে বলে ?
সংজ্ঞা : বাক্যের অন্তর্গত ক্রিয়া পদের সাথে বিশেষ্য ও সর্বনাম পদের যে অন্বয় বা সম্পর্ক থাকে, তাকে কারক বলে ।
যেমন- ছাত্ররা স্কুলে বই পড়ে। এখানে বাক্যটির ক্রিয়াপদ ‘পড়ে’। অন্যান্য পদের সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে। যেমন-কারা পড়ে? – ছাত্ররা। কোথায় পড়ে?-স্কুলে। কী পড়ে ? বই। তাহলে দেখা যায়, বাক্যের ক্রিয়াপদের সঙ্গে অপরাপর পদের সম্পর্ক বিদ্যমান। এ সম্পর্কই কারক।
আরো জানো : কর্তৃকারক:সংজ্ঞা, প্রকারভেদ, উদাহরণ ও বিভিন্ন বিভক্তির ব্যবহার
কারক কত প্রকার ও কি কি ?
কারক প্রধানত ছয় প্রকার। যথা-
ক. কর্তৃকারক।
খ. কর্মকারক।
গ. করণ কারক।
ঘ. সম্প্রদান কারক।
ঙ. অপাদান কারক।
চ. অধিকরণ কারক।
ক। কর্তকারক : কোনো বাক্যে যে ক্রিয়া সম্পাদন করে, তাকে কর্তৃকারক বলে। বাক্যের ক্রিয়াকে ‘কে’ দ্বারা প্রশ্ন করলেই কর্তৃকারক নির্ণয় করা যায়। যেমন- মাহিন বই পড়ে। গরু ঘাস খায়। পাখি গান গায় ইত্যাদি।
প্রথম বাক্যে কে পড়ে?-মাহিন, দ্বিতীয় বাক্যে কে খায়?-গরু, তৃতীয় বাক্যে কে গায়?-পাখি। সুতরাং ‘মাহিন’, ‘গরু’ ও ‘পাখি’ এখানে কর্তৃকারক।
খ। কর্মকারক : যাকে অবলম্বন করে ক্রিয়া সম্পাদিত হয়, তাকে কর্মকারক বলে। ক্রিয়াকে ‘কী’, ‘কাকে’ প্রশ্ন করলে কর্মকারক পাওয়া যায়। যেমন-গরু ঘাস খায়। শিক্ষক ছাত্রকে পড়ান। রহিম করিমকে ভালোবাসে ইত্যাদি।
প্রথম বাক্যে কী খায়?-ঘাস, দ্বিতীয় বাক্যে কাকে পড়ান?-ছাত্রকে, তৃতীয় বাক্যে কাকে ভালোবাসে? – করিমকে। সুতরাং ‘ঘাস’, ‘ছাত্রকে’ ও ‘করিমকে’ এখানে কর্মকারক।
আরো জানো : কর্ম কারক : সংজ্ঞা, প্রকারভেদ, উদাহরণ ও বিভিন্ন বিভক্তি
গ। করণ কারক : যা দিয়ে ক্রিয়া সম্পাদিত হয়, তাকে করণ কারক বলে। ক্রিয়াকে ‘কী দিয়ে’, ‘কীসের দ্বারা’ ইত্যাদি প্রশ্ন করে করণ কারক নির্ণয় করা যায়। যেমন-আমরা চোখ দিয়ে দেখি। ছেলেরা কলম দিয়ে লিখে। মাহিন ছুরি দ্বারা আম কাটে ইত্যাদি ।
প্রথম বাক্যে কী দিয়ে দেখি?-চোখ দিয়ে, দ্বিতীয় বাক্যে কী দিয়ে লিখে?-কলম দিয়ে, তৃতীয় বাক্যে কীসের দ্বারা কাটে?-ছুরি দ্বারা। সুতরাং ‘চোখ দিয়ে’, ‘কলম দিয়ে’ ও ‘ছুরি দ্বারা’ এখানে করণ কারক।
ঘ। সম্প্রদান কারক : যাকে কোনো কিছু দান করা বোঝায়, তাকে সম্প্রদান কারক বলে। ক্রিয়াকে ‘কাকে’ প্রশ্ন করে সম্প্রদান কারক নির্ণয় করা যায়। যেমন-দরিদ্রকে ধন দাও। ভিক্ষুককে ভিক্ষা দাও ইত্যাদি। প্রথম বাক্যে কাকে ধন দাও?-দরিদ্রকে, দ্বিতীয় বাক্যে কাকে ভিক্ষা দাও?-ভিক্ষুককে। সুতরাং ‘দরিদ্রকে’ ও ‘ভিক্ষুককে’ এখানে সম্প্রদান কারক।
স্বত্ব ত্যাগ না হলে সম্প্রদান কারক হয় না। যেমন-ধোপাকে কাপড় দাও সম্প্রদান কারক নয়। কারণ ধোপাকে নিঃর্স্বাথভাবে দান করা হয়নি।
আরো জানো : সম্প্রদান ও অপাদান কারক : সংজ্ঞা, উদাহরণ ও বিভক্তির ব্যবহার
ঙ। অপাদান কারক : যা থেকে ক্রিয়া প্রকাশিত হয়, তাকে অপাদান কারক বলে। ক্রিয়াকে ‘কোথা থেকে, কী থেকে, কীসের থেকে’ ইত্যাদি প্রশ্ন করে অপাদান কারক নির্ণয় করা যায়। যেমন-গাছ থেকে ফল পড়ে। তিলে তেল হয় ইত্যাদি।
প্রথম বাক্যে কোথা থেকে?-গাছ থেকে, দ্বিতীয় বাক্যে কীসে?-তিলে। সুতরাং ‘গাছ থেকে’ ও ‘তিলে’ এখানে অপাদান কারক।
চ। অধিকরণ কারক : যে স্থানে, যে সময়ে বা যে বিষয়ে ক্রিয়া সম্পন্ন হয়, তাকে অধিকরণ কারক বলে । ক্রিয়াকে কোথায়, কোন স্থানে, কখন, কোন সময়ে, কোন বিষয়ে ইত্যাদি প্রশ্ন করে অধিকরণ কারক নির্ণয় করা যায়। যেমন-স্থান : বনে বাঘ থাকে। সময় : সকালে সূর্য ওঠে। বিষয় : মাহিন অঙ্কে ভালো।
প্রথম বাক্যে কোথায়?-বনে, দ্বিতীয় বাক্যে কখন?-সকালে, তৃতীয় বাক্যে কোন বিষয়ে?-অঙ্কে। সুতরাং ‘বনে’, ‘সকালে’ ও ‘অঙ্কে’ এখানে অধিকরণ কারক।
আরো জানো : অধিকরণ কারক কাকে বলে?কত প্রকার ও কি কি উদাহরণ সহ বিস্তারিত
কারক চেনার সহজ উপায় :
কর্তৃকারক : ক্রিয়াকে ‘কে’ দ্বারা প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায় তা কর্তৃকারক ।
কর্মকারক : ক্রিয়াকে ‘কী’ বা ‘কাকে’ দ্বারা প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায় তা কর্মকারক।
করণকারক : ক্রিয়াকে ‘কী’ দ্বারা প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায় তা করণকারক।
সম্প্রদান কারক : ক্রিয়াকে ‘কাদেরকে’ দ্বারা প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায় তা সম্প্রদান কারক।
অপাদান কারক : ক্রিয়াকে ‘কোথা’ হতে বা ‘থেকে’ দ্বারা প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায় তা অপাদান কারক।
অধিকরণ কারক : ক্রিয়াকে ‘কখন’ বা ‘কোথায়’ দ্বারা প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায় তা অধিকরণ কারক।
কারক নির্ণয় পদ্ধতি :
ভালো করে খেয়াল করো, ক্রিয়া পদ ছাড়া বাক্যগঠন সম্ভব নয় । ক্রিয়ার সাথে অন্যান্য পদ বা শব্দের সুসম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়েই বাক্যার্থের পূর্ণ প্রকাশ। যেমন—
‘খান সাহেব প্রতি শুক্রবার নিজ তহবিল হতে স্ব-হস্তে ভিক্ষুকদেরকে টাকা দান করেন।
এ বাক্যে ‘দান করেন’ ক্রিয়া পদ।
এ ক্রিয়াপদের সাথে অন্যান্য সকল পদের কোন না কোন সম্পর্ক রয়েছে। যেমন-
- ‘কে’ দান করেন’ – খান সাহেব (কর্তা)।
- ‘কী’ দান করেন? – টাকা (কর্ম) ।
- ‘কী দ্বারা’ দান করেন? – স্বহস্তে (করণ) ।
- ‘কাকে’ দান করেন? – ভিক্ষুকদেরকে (সম্প্রদান)।
- ‘কোথা হতে’ দান করেন? – নিজ তহবিল হতে (অপাদান)।
- ‘কখন’ দান করেন? – প্রতি শুক্রবার (অধিকরণ)।
বাক্যটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেল যে, ‘দান করেন’ ক্রিয়াপদের সাথে খান সাহেব, টাকা, স্বহস্তে, ভিক্ষুকদেরকে, নিজ তহবিল হতে, প্রতি শুক্রবার ইত্যাদি পদগুলোর কোন না কোন সম্পর্ক রয়েছে। বাক্যস্থিত পদগুলোর এ সম্পর্কই কারক। ক্রিয়ার সাথে অন্যান্য পদের সম্পর্ককে একটি চিত্রের সাহায্যে প্রকাশ করা যায়। যেমন-
কারক নির্ধারণে ক্রিয়াকে কে, কী, কাকে, কী দ্বারা, কোথা থেকে, কোথায় ইত্যাদি প্রশ্ন করেও কারক সম্পর্কে ধারণা নেয়া যায় । কিন্তু নির্ভুল কারক নির্ণয়ে বিভক্তি অথবা প্রশ্নোত্তর পদ্ধতিই যথেষ্ট নয় । শব্দার্থ তথা পদার্থের বৈশিষ্ট্য এবং ক্রিয়ার সঙ্গে পদটির সম্বন্ধ কী এ বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
