প্রশ্ন : ॥ শামসুদ্দীন আবুল কালাম রচিত পথ জানা নাই গল্পের মূলভাব/ বিষয়বস্তু/সার-সংক্ষেপ তোমার নিজের ভাষায় লেখ।”
উপস্থাপনা : ‘পথ জানা নাই’ নামক অসাধারণ ছোটগল্পটি বাংলা সাহিত্যে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক শামসুদ্দীন আবুল কালাম বিরচিত আলোচ্য গল্পে নগর-সভ্যতার কুপ্রভাব ও প্রতিক্রিয়া উল্লেখপূর্বক এর প্রতি তীব্র কটাক্ষ ও অনীহা প্রকাশ করা হয়েছে।
পথ জানা নাই গল্পের মূলভাব
১. গল্পের পটভূমি মাউলতলা : দক্ষিণ বাংলার একটি সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা গ্রাম মাউলতলা। এ গ্রামটিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে ‘পথ জানা নাই’ গল্পের কাহিনি।
২. মাউলতলার সহজ-সরল জীবন : এ মাউলতলা গ্রামটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত ছিল বহির্জগতের সাথে সম্পর্কশূন্য মধ্যযুগীয় ছায়া-সুনিবিড় শান্তির নীড়। রাজনৈতিক বহু উত্থান-পতনের মাধ্যমে রাজশক্তির বিলুপ্তি ঘটেছিল, কিন্তু মাউলতলার নিস্তরঙ্গ জীবনে তার কোনো প্রভাব পড়েনি ।
আরও জানো : পথ জানা নাই গল্পের আলোকে গহুরালির চরিত্র/কেন্দ্রীয় চরিত্র
৩. নগর-সভ্যতার স্পর্শ : তরুণ জোনাবালি মাউলতলা গ্রামের সন্তান। সে তরুণ বয়সে ভাগ্যান্বেষণে শহরে পাড়ি জমায়। চল্লিশ বছর পর গ্রামে ফিরে আসে। সাথে নিয়ে আসে অনেক ধন-সম্পদ এবং নগর-সভ্যতার ছোয়া।
সে সকলের সহযোগিতায় গ্রামের উন্নয়নকল্পে গ্রাম ও শহরের একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে একটি সড়ক নির্মাণ করে । এভাবে গ্রামের কৃষক গফুর আলি ওরফে গহুরালিদের জীবনে লাগে শহরের ছোঁয়া বা নগর সভ্যতার স্পর্শ ।
৪. নগর-সভ্যতার উপকরণ : শহরের সাথে যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ার পর একে একে মাউলতলা গ্রামের অধিকাংশ পুরুষই শহর ঘুরে আসে। ঘুরে আসে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সহজ-সরল গ্রামীণ কৃষক গহুরালিও। শহরের রাস্তাঘাট, দোকানপাট, বাড়িঘর এবং শহরবাসীদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ইত্যাদি আকৃষ্ট করে গহুরালিকে।
আবার একই সঙ্গে সে ব্যথিত হয় শহরের মানুষের সহানুভূতিহীনতা ও আন্তরিকতার অভাব অবলোকন করে। এমনকি এক বারাঙ্গনার মুগ্ধকর আহ্বানকে আন্তরিকতা ভেবে প্রতারণার শিকার হয় গহুরালি। তখন সে ভাবে, মূলত উৎকট নগর সভ্যতার প্রধান উপকরণ হলো প্রতারণা।
আরও জানো : পথ জানা নাই গল্পের নামকরণের সার্থকতা
৫. গ্রামীণ জীবনে জটিলতার আগমন : মাউলতলার শান্ত-স্নিগ্ধ জীবনে নানা জটিলতার আগমন ঘটে নবনির্মিত সড়ক ধরেই। সাদামাটা গ্রামীণ জীবনে নানা কূটবুদ্ধি চর্চা হতে থাকে। মামলা-মকদ্দমা, খুন-জখম শুরু হয়, হিংসা-বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়।
লেখকের ভাষায়, “এই পথে শহরের ফৌজদারী দেওয়ানীতেও ছুটাছুটি শুরু হইল ধীরে ধীরে। শাদামাটা সরল জীবনে আসিতে লাগিল কূটবুদ্ধি আর কৌশলের দড়িজাল। এই সড়কের চারিদিকে প্রচুর গলি-ঘুঁজিরও সৃষ্টি হইল। অনেক বাঁক, অনেক মোড় মাউলতলা জটিল হইয়া উঠিল।”
৬. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও মাউলতলা : ইতোমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। চাল- ডালের দাম বাড়ল। শুরু হলো দুর্ভিক্ষ। লেখকের ভাষায়-“চাল-ডালের দাম বাড়িল দাম চড়িল সব জিনিসের কমিল কেবল জীবনের। ধীরে ধীরে এই সড়ক বাহিয়াই আসিল মন্বন্তর । আসিল রোগ-ব্যাধি, চোরাবাজার আর দুর্নীতির উত্তাল জোয়ার।”
৭. বিপর্যন্ত গ্রামীণ সমাজব্যবস্থা : শহরের সাথে সংযোগকারী সড়কের মাধ্যমে নগরকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থার প্রভাব প্রবেশ করল মাউলতলা গ্রামে। মাউলতলার শাও সুনিবিড় নিস্তরঙ্গ জীবনে লাগল উন্নয়নের চেয়ে বেশি বিপর্যয়ের স্পর্শ। খুন, মারামারি, মামলা-মকদ্দমা হয়ে দাড়ালো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ।
৮. নৈতিক বিপর্যয় : মাউলতলা নৈতিক দিক থেকেও বিপর্যন্ত হয়ে পড়ল । গ্রামটিতে আধুনিকতার নামে শুরু হলো ঘুষ, দুর্নীতি, বেহায়াপনা, রোগব্যাধি ও অনাচার। যেমন- শহরের বাবুর্চিখানার কর্মচারী লুৎফরের সাথে উধাও হয়ে যায় আসগরউল্লাহর সোমত্ত মেয়ে কুলসুম।
গহুরালির স্ত্রী হাজেরা পালিয়ে যায় এক মিলিটারির দালালের হাত ধরে। যুদ্ধ ফেরত ইউসুফ বয়ে আনে দুরারোগ্য যৌনব্যাধি, তাতে মৃত্যুবরণ করে তার স্ত্রী। এভাবে নানাবিধ নৈতিক বিপর্যয়ের শিকার হয় মাউলতলা ।
৯. অন্তরে-বাইরে নিঃস্ব গহুরালি : মিলিটারির দালালরা তরিতরকারি, কাঠ, মুরগি ইত্যাদি কিনতে আসে গ্রামে। এদেরই একজনের সাথে ঘনিষ্ঠতা জন্মে গহুরালির। গহুরালি মনে করেছিল, এর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখলে মন্বন্তরের সময় তার অন্নাভাব দূর হবে, কিন্তু অন্নাভাব তো দূর হলোই না; বরং একদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখল, তার জীবনসঙ্গিনী হাজেরা নেই।
সে মিলিটারির দালালের হাত ধরে পালিয়ে গেছে শহরের পথে । গহুরালি মন্বন্তরে নিঃস্ব হয়েছিল বাইরে, এবার হলো অন্তরে।
উপসংহার : নগর-সভ্যতা মানুষকে ধন-সম্পদ, সুখ-ঐশ্বর্য দিলেও নৈতিক ও মানবিক উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি; বরং নাগরিক সভ্যতার ছোঁয়া গ্রামীণ শান্তিপূর্ণ জীবনকে বিপর্যস্ত করে দেয় । সমাজ সচেতন গল্পকার শামসুদ্দীন আবুল কালাম এ চিরন্তন সত্যই তুলে ধরেছেন ‘পথ জানা নাই ছোটগল্পে ।