উপস্থাপনা : পুঁইমাচা গল্পে বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও সমাজসচেতন গল্পকার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তৎকালীন সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরেছেন। গল্পটিতে সামন্ততান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সমাজব্যবস্থার বাস্তব করুণ কাহিনি বর্ণিত হয়েছে ।
তৎকালীন সমাজব্যবস্থা : পুঁইমাচা গল্পটিতে তৎকালীন সমাজব্যবস্থার চমৎকার চিত্র ফুটে উঠেছে। সহায়হরি চাটুয্যে, স্ত্রী অন্নপূর্ণা এবং চার মেয়ে নিয়ে তাদের সংসার। অভাব- অনটনের সংসার হওয়া সত্ত্বেও মোটামুটি ভালোভাবেই তাদের জীবন কাটছিল। বড় মেয়ের নাম ক্ষেন্তি, বয়স পনেরো। কিন্তু এ বয়সই ক্ষেন্তির জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
এ বয়সের মেয়ের বিয়ে না হলে ব্রাহ্মণের জাত যায়। তাই মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার জন্য সমাজপতিদের পক্ষ থেকে সহায়হরির ওপর আদেশ নেমে আসে। সমাজপতিদের কঠোর শাসনে সহায়হরি মণিগায়ের শ্রীমন্ত মজুমদারের ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে ঠিক করতে বাধ্য হন।
আরও জানো : পুঁইমাচা গল্পের বিষয়বস্তু /মূলভাব/মূল বক্তব্য/মূল সুর
কিন্তু যখন জানতে পারলেন ছেলেটির স্বভাব-চরিত্র ভালো নয়, তখন বিয়ে ভেঙে দেন; কিন্তু এটা সমাজপতিরা সহজে মেনে নেয়নি। সমাজের কর্তাব্যক্তিরা মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উপর্যুপরি চাপ দিচ্ছিল। এমনকি বিয়ে না দিলে তারা সহায়হরিকে একঘরে করার হুমকি দেয়। উপায়ান্তর না দেখে অবশেষে সহায়হরি তার আদরের মেয়ে ক্ষেন্তিকে চল্লিশোর্ধ্ব এক পাত্রের সাথে বিয়ে দিতে বাধ্য হন।
সামাজিক সম্পর্ক : তৎকালীন সমাজের সামাজিক বন্ধন অত্যন্ত নিবিড় ও গভীর ছিল। বিশেষ করে সহায়হরি ও অন্নপূর্ণা যে গ্রামে বসবাস করতো সে গ্রামে। ওপর শ্রেণির লোকেরা কিছুটা ঈর্ষাপরায়ণ হলেও সাধারণ মানুষ ছিল পরস্পরের ঘনিষ্ঠজন।
সহায়হরি তাই তারক খুড়োর কাছ থেকে রস আনার জন্য স্ত্রীর কাছে ঘটি চেয়েছিলেন। আবার ক্ষেন্তি খেদিদের বাড়িতে গেলে খুড়িমা তাকে পিঠা খেতে দিয়েছিল। এভাবে সেই সমাজের মানুষেরা পরস্পর খাবার-দাবার ও জিনিস-পত্র আদান-প্রদান করতো। একে অন্যকে বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতো ।
আরও জানো : পুঁইমাচা গল্পের ক্ষেন্তির চরিত্র বিশ্লেষণ কর
সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থা : ‘পুইমাচা’ গল্পে সহায়হরি ও অন্নপূর্ণা দম্পতির সংসারের বর্ণনায় তৎকালীন সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থা ফুটে উঠেছে। সহায়হরির পূর্বপুরুষ পরমেশ্বর চাটুয্যের নামে নীলকুঠির আমলে এ অঞ্চলে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেয়েছে, কিন্তু আজ সে অবস্থা নেই। দারিদ্র্যের কষাঘাতে এখন সহায়হরির সংসার জর্জরিত।
আর্থিক দুরবস্থার · কারণে আদরের মেয়ে ক্ষেন্তির বিয়ের যৌতুকের আড়াইশ টাকা বাকি থাকায় সহায়হরি মেয়েকে নাইয়র আনতে পারেনি। বিয়ের সময় সে যে গেল, আর এল না। মৃত্যু তাকে ডেকে নিয়ে যায়। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে সহায়হরি অন্যের নিকট থেকে নির্লজ্জের ন্যায় এটা- সেটা চেয়ে আনত। দু’পয়সা বাকি ছিল বলে গয়া পিসি ক্ষেন্তিকে তৃপ্তি সহকারে খাওয়াতে পারেন না।
খাওয়ার লোভে পিতা-কন্যা মিলে বরোজপোতার বন থেকে মেটে আলু চুরি করে। পৌষ-সংক্রান্তিতে অন্নপূর্ণা মেয়েদের পিঠার আবদারে সামান্য একটু করে গোলা হাতে দেয়। সহায়হরির পরিবারের এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তৎকালীন সমাজের আর্থিক দুরবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে।
আরও জানো : পুঁইমাচা গল্পের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা কর
তৎকালীন সমাজে যৌতুক মহামারী : যৌতুকপ্রথার কষাঘাতে তৎকালীন সমাজ ছিল জর্জরিত । সহায়হরি মেয়ে ক্ষেন্তির বিয়েতে যৌতুক দিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন । তবুও আড়াইশ টাকা বাকি থাকার কারণে মেয়ে ক্ষেন্তিকে বরণ করে নিতে হয়েছিল দুর্বিষহ জীবন যৌতুকের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় এক বছর সহায়হরি মেয়েকে দেখতে যেতে পারেননি।
অতঃপর স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে মেয়েকে দেখতে গেলে শাশুড়ি অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন বেয়াইকে ছোটলোক বলে গালমন্দ করে তাড়িয়ে দেন। সহায়হরির আদরের কন্যা ক্ষেন্তি অবশেষে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়। তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দূর সম্পর্কের এক পিসির বাড়িতে। শাশুড়ি শয্যাশায়িনী ক্ষেন্তির শরীর থেকে গহনাপত্র খুলে রাখেন। কিন্তু ক্ষেন্তি বসন্ত রোগ থেকে মুক্তি না পেয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
জঘন্য সমাজব্যবস্থা : আশীর্বাদ হওয়ার পর যৌক্তিক কারণে ক্ষেন্তির বিয়ে ভেঙে দেওয়ায় সমাজপতিরা বাবা সহায়হরিকে একঘরে করার হুমকি দেয়। সমাজশক্তির একটি পাষাণরূপ দৃঢ় কাঠামো, একটা নৈর্ব্যক্তিক যন্ত্রণার অভিব্যক্তি এখানে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে এবং কতটা মনুষ্যত্ব বিবর্জিত ছিল এ সমাজ তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
বৃহত্তর মানবজীবন, মানুষের প্রেম- প্রীতি ও আবেদন এ সমাজে অর্থহীন। যে সামাজিক রোগ ক্ষেন্তিকে গ্রাস করেছে তার উৎস সমাজের গভীর শেকড়ে প্রোথিত ছিল।
কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ : ‘পুই মাচা’ গল্পের মাধ্যমে তৎকালীন হিন্দু সমাজের নানা কুসংস্কার ফুটে উঠেছে। ছুঁলেই জাত যাবে, অপবিত্র হবে- এরকম একটা কুসংস্কার প্রচলিত ছিল তৎকালীন হিন্দু সমাজে । এছাড়া বর্ণভেদপ্রথা মেনে চলা হতো রীতিমতো।
যৌক্তিক কারণে আশীর্বাদ করা মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেলেও তাকে আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘উচ্ছুগু’ করা মেয়ে বলে। পৌষ-সংক্রান্তির সময় প্রথম পিঠাখানা কানাচে ষাঁড়া-ষষ্ঠীকে ফেলে দিয়ে আসা ইত্যাদি • কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কুসংস্কারের আসল রূপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
উপসংহার : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুঁই মাচা’ গল্পে তৎকালীন আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এটা বিশ্লেষণ করে আমরা বলতে পারি, প্রথানির্ভর, অন্ধ ধর্মভিত্তিক ও স্বার্থকেন্দ্রিক সমাজের নির্মম অনুশাসনে পিষ্ট একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের করুণ আর্থিক দুর্গতি থেকে সে সমাজের বাস্তব অবস্থা পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে।