প্রশ্ন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একরাত্রি গল্পের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা
অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরচিত একরাত্রি গল্পের নামকরণের সার্থকতা বিচার কর।
উপস্থাপনা : বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের সার্থক রূপকার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরচিত ‘একরাত্রি’ গল্পটি তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে সংকলিত। এটি তাঁর অসাধারণ সৃষ্টি। এ গল্পে মানব-মানবীর শাশ্বত প্রেমকে গল্পকার ভিন্নমাত্রায় উপস্থাপন করেছেন ।
সংকীর্ণ কামনা-বাসনার ঊর্ধ্বে এক দেহাতীত প্রেমের ঘটনাকে উপজীব্য করে গভীর ভাবব্যঞ্জনায় নির্মিত হয়েছে গল্পটি। এর নামকরণের ক্ষেত্রে লেখকের শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় পাওয়া যায় ।
নামকরণের রীতিনীতি : বলা হয়- Literature is the mirror of life. অর্থাৎ সাহিত্য জীবনের দর্পণ। আর সাহিত্যের দর্পণ হলো নামকরণ। কেননা নামকরণের মধ্য দিয়ে সাহিত্যের মূল ভাববস্তু ফুটে ওঠে। নামকরণ সম্পর্কে প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক Cavendis বলেন- A beautiful name is better than a lot of wealth. অর্থাৎ, একটি সুন্দর নাম অঢেল সম্পদের চেয়ে উত্তম।
সাহিত্যিকগণ সাধারণত কল্পনাবিলাসী হয়ে থাকেন। তারা ভাব বা কল্পনার সমুদ্রে অবাধ সন্তরণ করেন। তাই বলে তারা সাহিত্যের স্বীকৃত রীতিনীতির ঊর্ধ্বে নন। রচনার সাথে সামঞ্জস্য না রেখে নামকরণ করলে তা সার্থক হয় না। সুতরাং একটি শিল্পকর্মকে সার্থক করে তুলতে নামকরণের রীতিনীতি অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।
আরও জানো : একরাত্রি গল্পের বিষয়বস্তু / মূলভাব / মূল বক্তব্য
নামকরণের ভিত্তি : প্রবন্ধ, কবিতা বা গল্পের নামকরণের মধ্য দিয়ে এগুলোর প্রকৃত ভাববস্তু ফুটে ওঠে। তাই সাহিত্যে নামকরণের ক্ষেত্রে লেখককে বিচক্ষণতার সাথে কিছু বিষয়ের প্রতি নজর দিতে হয়। যেমন-
- রচনার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বা বিষয়বস্তু
- স্থান বা কাল
- রূপক বা প্রতীকী ব্যঞ্জনা
- নায়ক-নায়িকার নাম
- কেন্দ্রীয় চরিত্র
একরাত্রি গল্পের নামকরণ : আলোচ্য ‘একরাত্রি’ ছোটগল্পটির নামকরণ করা হয়েছে গল্পের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের ওপর ভিত্তি করে। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র, কাহিনি বা ঘটনা কোনোকিছুকেই বিবেচনা না করে নায়কের জীবনের একটি রাতের উপলব্ধি থেকে গল্পের নামকরণ করা হয়েছে।
একরাত্রি’ গল্পের বিষয়বস্তু : মানবমনের সূক্ষ্ম অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে ‘একরাত্রি’ গল্পে। এ গল্পে নায়কের মনে যে সুপ্ত প্রেম অবরুদ্ধ হয়েছিল, এক রাতে নায়িকার পুনরাবির্ভাবে তা জাগ্রত হয়ে উঠেছে। যে সুরবালাকে নায়ক প্রথম জীবনে এতটুকু গুরুত্ব দেয়নি, সেই একটি বিশেষ রাতকে আশ্রয় করে নায়কের সবকিছু আচ্ছন্ন করে দিয়েছে। নায়কের কাছে সে রাত অবিস্মরণীয় এক রাত যা স্মৃতির পাতায় অম্লান।
আরও জানো : একরাত্রি গল্পের প্রেমের স্বরূপ বিশ্লেষণ কর
এক রাতের পরম প্রাপ্তি : নায়ক রামলোচন বাবুর বাড়িতে যাওয়ার পর থেকেই সুরবালাকে নিয়ে সব সময় ভাবনায় পড়ে থাকে, উন্মুখ হয়ে থাকে তাকে এক নজর দেখতে। অবশেষে এক ঝড়ের রাত তাকে সে সুযোগ করে দিল।
সুরবালাকে সাহায্য করার জন্য নায়ক ঘর থেকে বের হয়ে দেখতে পায় সুরবালাও ঘর থেকে বের হয়ে ঢিবির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। নীরব নিথর রাতে তারা দুজন কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। একে অন্যকে অনুভব করে, কোনো কথা বলে না। নায়কের জীবনে এ রাত ছিল পরম প্রাপ্তির রাত।
‘একরাত্রি’র মাহাত্ম্য : মানুষের জীবনে সময়ের অবিরাম গতিধারায় কত রাত আসে কত রাত যায়! বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যায় অতীতের দিনরাতগুলো। এর মধ্যে কারো কারো জীবনে কিছু কিছু মাহেন্দ্রক্ষণ উঁকি দিয়ে যায়, যা আজীবন হৃদয়ে দোলা দেয়। স্মৃতির পাতায় অম্লান হয়ে থাকে।
‘একরাত্রি’ গল্পের নায়কের জীবনেও এমন একটি রাতের আবির্ভাব ঘটেছিল। এ রাতের নীরব নিস্তব্ধ অন্ধকারে সে বাল্যসাথি সুরবালাকে কাছাকাছি অনুভব করে জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেয়েছে। এই একটি রাত ছিল তার জীবনের সবচেয়ে মাহাত্ম্যপূর্ণ ক্ষণ।
আরও জানো : পুঁইমাচা গল্পের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা কর
একটি অনন্ত রাতের উদয় : বিপর্যস্ত নায়কের সমগ্র অন্তর জুড়ে এখন শুধুই সুরবালা। ইতোমধ্যে এক সোমবার সমগ্র আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। চারদিকে দুর্যোগের ঘনঘটা। নায়কের মনে পড়ে, এ দুর্যোগের রাতে ঘরে সুরবালা একা ।
সুরবালাকে সাহায্য করার কথা তার সমগ্র হৃদয় জুড়ে অনুভূত হলেও দ্বিধাদ্বন্দ্বে সে সুরবালার কাছে যেতে পারে না। রাত একটা-দেড়টার দিকে বানের জল ধেয়ে এলে আত্মরক্ষার জন্য সুরবালা পুকুর পাড়ে আসে। নায়কও ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সুরবালাকে সাহায্য করতে।
প্রলয়ংকরী সেই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাতে নায়ক আবার কাছে পায় তার সুরবালাকে। অন্ধকারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে দু’জনে। খুব কাছাকাছি থেকেও বিচ্ছেদের যোজন দূরত্ব তাদের নির্বাক করে রাখে। ঝড়-বৃষ্টি থেমে গেলে দু’জনেই ফিরে যায় আপন আপন নীড়ে। একটি অনন্ত রাতের স্মৃতি রয়ে যায় নায়কের সমর্থ হৃদয়-মন জুড়ে ।
নামকরণের সার্থকতা : গল্পকার এ গল্পে একটি বিশেষ রাতকে নায়কের তুচ্ছ জীবনের চরম সার্থকতা বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ রাতেই নায়ক মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়িয়ে অনন্ত আনন্দের আস্বাদ পেয়েছে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যর্থতার গ্লানি তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।
শিক্ষা, রাজনীতি, সংসার কোনো ক্ষেত্রেই নায়ক সার্থক হতে পারেনি। একদিন যাকে হাত বাড়ালেই পাওয়া যেত, সেই সুরবালাও এখন অধরা। সে একটি বিশেষ রাতে ক্ষণিকের জন্য নায়কের কাছে এসেছিল। আর এই একটি রাতই তার সারাজীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা।
সুতরাং দেখা যায়, গল্পের সমগ্র অবয়ব জুড়ে যে কাহিনি আবর্তিত হয়েছে তা সমাপ্তি লাভ করেছে এক রাতের এক আবেগঘন মুহূর্তের মধ্য দিয়ে। এক রাতের তাৎপর্যের মধ্যে গল্পের মূলসুর বাঁধা রয়েছে। তাই গল্পকার তাঁর এ গল্পের নামকরণ করেছেন ‘একরাত্রি’।
উপসংহার : বাংলা ছোটগল্পের সার্থক রূপকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর একরাত্রি গল্পের নামকরণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট শিল্পকুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। গল্পের প্রধান চরিত্র এক স্কুল মাস্টারের জীবনের তাৎপর্যপূর্ণ একটি রাতের মহিমাকে নির্ভর করেই মূলত গল্পটি নির্মিত, হয়েছে। সুতরাং নির্দ্বিধায় বলা যায়, গল্পের ‘একরাত্রি’ নামকরণ শিল্পসম্মত ও সার্থক হয়েছে।