উপস্থাপনা : মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) এর মুখনিঃসৃত পবিত্র বাণী সংকলন ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, তিনি হলেন ইমাম বুখারী (র) তাঁর অমর কীর্তি বুখারী শরীফের সাথে অন্য কোনো গ্রন্থের তুলনা চলে না। এ গ্রন্থ পাঠান্তে পাঠককে মুগ্ধ করে। নিম্নে বুখারী শরীফের বৈশিষ্ট্য, প্রেক্ষাপট ও অবদান সংশ্লিষ্ট আলোচনা করা হলো-
বুখারী শরীফের বৈশিষ্ট্যাবলি :
ইমাম বুখারী (র)-এর অসামান্য অবদান আস সহীহ লিল বুখারী। তিনি ৬ লক্ষ হাদীস থেকে যাচাইবাছাই করে ২৭৬১ মতান্তরে ২৬০২ কিংবা দ্বিরুক্তি বাদ দিয়ে ৪০০০টি হাদীসের সমন্বয়ে বুখারী শরীফ সংকলন করেন।
তাই গ্রন্থটি বিশুদ্ধতার নিরিখে কুরআনের পর পৃথিবীর অন্যান্য সকল গ্রন্থ থেকে সর্বাধিক বিশুদ্ধ, পূর্ণিমার শশীসম মর্যাদায় সমাসীন। জমহুর মুহাদ্দিসীনের মন্তব্য- বস্তুত বুখারী গ্রন্থের বৈশিষ্ট্যাবলিই এর বিশুদ্ধতার প্রামাণ্য দলীল। নিম্নে বুখারী শরীফের বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরা হলো ।
১. জামে গ্রন্থ : বুখারী শরীফের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি একটি জামে গ্রন্থ। এ গ্রন্থটিতে সিয়ার, আদব, মানাকিব, আশরাত, আহকাম, ফিতান, আকাইদ, ও তাফসীর এ ৮টি বিষয়ের পূর্ণ আলোচনা রয়েছে।
২. সুলাসিয়াত : সিহাহ সিত্তার মধ্যে একমাত্র বুখারী শরীফেই সর্বাধিক ২২টি সুলাসিয়াত তথা রাসূল (স) পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে মাত্র তিন রাবীর সনদে বর্ণিত হাদীস রয়েছে।
আরো জানো : ইমাম বুখারী (র)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী (পয়েন্ট আকারে)
৩. কুরআনের আয়াত দ্বারা অধ্যায় শুরু : বুখারী (র) তাঁর গ্রন্থকে অধ্যায়ে অধ্যায়ে বিভক্ত করে অনেক অধ্যায় কুরআনের আয়াত অথবা সহীহ হাদীস দিয়ে শুরু করেছেন। মূলত বুখারী শরীফের এটি একটি, অন্যতম বৈশিষ্ট্য ।
৪. হাদীস গ্রহণের পদ্ধতি : মুহাদ্দিসগণ হাদীসের রাবীদের চারটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। আর বুখারী শরীফে ইমাম বুখারী (র) প্রথম শ্রেণি থেকে যাচাইবাছাই সাপেক্ষে হাদীস গ্রহণ করে অন্যদের বর্ণনা পরিহার করেছেন।
৫. হাদীস সংকলনের বিস্ময়কর পদ্ধতি : ইমাম বুখারী (র) হাদীস লিপিবদ্ধ করার পূর্বে পবিত্র হয়ে নিতেন। তিনি প্রথমে গোসল করে দু’রাকাত সালাত আদায় করতেন এবং সবশেষে ইস্তেখারা করে হাদীস লেখার কাজ আরম্ভ করতেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন- সহীহ বুখারীতে আমি কোনো হাদীস এমনিতে লিখিনি, যতক্ষণ না গোসল করে দু’রাকাত নামায পড়েছি এবং ইস্তেখারার মাধ্যমে আল্লাহর নিকট থেকে তার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছি।
৬. রাবীদের গুণাবলি : অন্যান্য গ্রন্থের তুলনায় এ গ্রন্থে সমালোচিত রাবীদের সংখ্যা নিতান্তই কম। বুখারী শরীফের ৪৫৩ জন রাবীর মধ্যে সমালোচিত রাবী মাত্র ৮০ জন ।
৭. পবিত্রতম নগরীতে সংকলন : সহীহ বুখারীর হাদীস সংকলন শুরু হয়েছিল মক্কা মুয়াযযামায় মাসজিদুল হারামের অভ্যন্তরে। পরে এটির বিভিন্ন অধ্যায় ও তরজমাতুল বাব সংযোজনের কাজ সুসম্পন্ন হয় মদিনা মুনাওয়ারার মসজিদে নববীর মিম্বার ও রওযার মধ্যস্থানে।
৮. অহী অধ্যায় : বুখারী শরীফের শুরুতেই অহী অধ্যায় সংযোজন করা হয়েছে, যা এটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
আরো জানো : সহীহ মুসলিম শরীফের বৈশিষ্ট্য – পয়েন্ট আকারে
৯. স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে সংকলন : মহানবী (স) কর্তৃক স্বপ্নযোগে ইলহাম পেয়ে ইমাম বুখারী (র) ‘আল জামেউ লিল বুখারী’ গ্রন্থ সংকলনের কাজে হাত দেন। সিহাহ সিত্তার অন্য কোনো গ্রন্থের ক্ষেত্রে এ দৃশ্যপট লক্ষ্য করা যায় না।
১০. স্বকীয়তা : স্বকীয়তা বুখারী শরীফের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অন্য কোনো গ্রন্থকে অনুসরণ করে বুখারী শরীফ রচিত হয়নি; বরং বুখারী শরীফকে অনুসরণ করে নতুন নতুন অনেক হাদীসগ্রন্থ সংকলিত হয়েছে।
১১. ফিকহী পদ্ধতিতে বিন্যস্তকরণ : বুখারী শরীফকে ফিকহী মাসয়ালার ক্রমানুসারে অধ্যায়ে অধ্যায়ে বিন্যস্ত করা হয়েছে। এ কারণে কোনো কোনো সমালোচক একে সুনান বলেও অভিহিত করেছেন।
১২. সার্বজনীনতা লাভ : সহীহ আল বুখারী যেমনটা সার্বজনীনতা লাভ করেছে অন্য কোনো জামে বা সুনান গ্রন্থ তেমনটা করেনি। তাই কুরআনের মতো তেলাওয়াতের মাধ্যমে ‘বুখারী খতম’ করতে দেখা যায়, যা অন্য কোনো গ্রন্থের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয় না।
১৩. ব্যাকরণগত বর্ণনা : সহীহ বুখারীতে ইমাম বুখারী (র) কঠিন কঠিন আরবি শব্দ ও পরিভাষার ব্যাকরণগত অর্থ বিশ্লেষণ করেছেন, যা অন্য কোনো গ্রন্থের ক্ষেত্রে পরিদৃষ্ট হয় না।
১৪. রুবাইয়াতের আধিক্য : হাদীস গ্রন্থগুলোর মধ্যে সহীহ বুখারীতে এত বিপুল সংখ্যক রুবাইয়াত তথা চার রাবীর সনদে বর্ণিত হাদীস রয়েছে, যা অন্য কোনো হাদীসগ্রন্থে একান্তই অনুপস্থিত।
১৫. অন্যান্য বৈশিষ্ট্য : উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যাবলি ছাড়াও সহীহ বুখারীতে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ পরিলক্ষিত হয়। যেমন-
ক. এতে শায ও মুয়াল্লাল হাদীস অনুপস্থিত ।
খ. ভাষাগত দিক থেকে এটি উন্নত ।
গ. এর অধ্যায়ের শিরোনামে প্রমাণস্বরূপ তালীকাত গ্রহণ করা হয়েছে, যা অন্য কোনো গ্রন্থে নেই ।
ঘ. এতে বর্ণনার ক্ষেত্রে أَخْبَرَنَا-حَدَّثَنَا ও أَنْبَأَنَا-এর মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয়নি।
ঙ. কোনো রাবীর সাথে তাঁর উস্তাদের সাক্ষাৎ হয়নি, এমন রাবীর হাদীস এ কিতাবে গৃহীত হয়নি ।
চ. নিজ মতামত প্রকাশের জন্য অন্যান্য মনীষীদের মন্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে ।
ছ. হাদীস গ্রন্থগুলোর মধ্যে আল কুরআনের পর কেবল সহীহ বুখারীরই সর্বাধিক ব্যাখ্যাগ্রন্থ লেখা হয়েছে।
জ. এ কিতাবের অধ্যায় বিন্যাস ও শিরোনাম সংযোজন স্বয়ং ইমাম বুখারী (র) করেছেন।
আরো জানো : সিহাহ সিত্তাহ কি? কয়টি ও কি কি। সংকলকের নাম সমূহ
সহীহ বুখারী সংকলনের প্রেক্ষাপট :
ইমাম বুখারী (র) হাদীস অধ্যয়ন করতে গিয়ে দেখলেন তাতে সহীহ, যয়ীফ সব ধরনের হাদীস রয়েছে। তাই তিনি স্বীয় উস্তাদ ইসহাক | ইবনে রাহওয়াইহ (র)-এর পরামর্শক্রমে হাদীসের একটি বিশুদ্ধ গ্রন্থ তৈরির ইচ্ছা পোষণ করলেন।
এমনকি একটি স্বপ্ন তাঁর এ ইচ্ছাকে আরো বেগবান করেছিল। তা হলো- আমার একদা রাতে নবী করীম (স)-কে স্বপ্ন দেখলাম যে, আমি নবী করীম (স)- এর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তাঁর হাতে একটা পাখা। এর দ্বারা আমি বাতাস করে রাসূল (স)-এর শরীর থেকে মাছি তাড়াচ্ছি। আমি স্বপ্নবিশারদদের একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম।
তখন তিনি আমাকে জানালেন যে, রাসূল (স)-এর হাদীস থেকে তুমি মিথ্যাকে অপসারিত করবে। এটাই আমাকে সহীহ হাদীস সংকলনে অনুপ্রাণিত করে। পরে ইবনে হাজার আসকালানী (র) বলেন, ইমাম বুখারী (র) যে শুধু বিশুদ্ধ হাদীসগুলো তাঁর গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন, গ্রন্থের নামই তার সাক্ষ্য বহন করে ।
ইমাম বুখারী (র) এ গ্রন্থ প্রণয়নের প্রেরণা তাঁর বিশিষ্ট উস্তাদ ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহ (র)-এর মজলিস থেকেও লাভ করেছিলেন। যেমন তিনি নিজেই বলেছেন- আমি ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহ এর নিকট উপস্থিত ছিলাম।
মজলিসে উপস্থিত তাঁর লোকজনের মধ্যে একজন বলল, কেউ যদি রাসূল (স) হতে বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীস ও সুন্নাতসমূহের এমন একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করত, যা সংক্ষিপ্ত হবে এবং বিশুদ্ধতার দিক থেকে চরম পর্যায়ে উন্নীত হবে, তাহলে খুবই উত্তম হতো এবং আমলকারীদের পক্ষে শরীয়ত পালন করা সহজতর হতো।
সেজন্য তাদেরকে মুজতাহিদদের প্রতি মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হতো না। আবু যায়েদ মারওয়াযী (র) বলেন, আমি একবার হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইবরাহীমের মাঝখানে শুয়েছিলাম। স্বপ্নে রাসূল (স)-এর সাথে যেয়ারত হলো।
আমাকে বলেন, হে আবু যায়েদ! ইমাম শাফেয়ী (র)-এর গ্রন্থের দরস কবে শুরু করবে? আর শেষে আমার গ্রন্থের দরস কখন দেবে? তখন আমি বললাম হুজুর আপনার গ্রন্থকোনটি? তিনি বলেন, মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বুখারীর আল জামেউস সহীহ গ্রন্থটি।
হাদীস সংকলনে ইমাম বুখারীর অবদান :
হাদীসশাস্ত্রে ইমাম বুখারী (র)-এর অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁর অমর কীর্তি আস সহীহুল বুখারী হাদীস গ্রন্থসমূহের মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত এবং সর্বজন সমাদৃত। এটি আল্লাহর কিতাব কুরআন মাজীদের পর সবচেয়ে বিশুদ্ধতম গ্রন্থ। ইমাম বুখারী (র) স্বীয় উস্তাদ ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহের অনুপ্রেরণায় এবং আদিষ্ট হয়ে সুদীর্ঘ ষোলো বছরে এ মূল্যবান গ্রন্থ সংকলন করেন। হাদীস সংকলনে তাঁর অবদান নিম্নরূপ-
১. গ্রন্থ সংকলন : আঠারো বছর বয়স থেকেই ইমাম বুখারী (র) গ্রন্থ রচনা ও সংকলনে মনোনিবেশ করেন। এ সময় সাহাবী ও তাবেয়ীদের বর্ণনা সংবলিত একটি হাদীসগ্রন্থ ও একটি ইতিহাসগ্রন্থ সংকলন করেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলির মধ্যে রয়েছে- আল জামেউস সহীহ, কিতাবুল মাবসূত, আল জামেউল করীর, কিতাবুল ইলাল, আত তারীখুল কবীর, আত তারীখুল আওসাত, আত তারীখুস সগীর, আদাবুল মুফরাদ, বিররুল ওয়ালিদাইন, কাযাউস সাহাবা ওয়াত তাবেয়ীন ইত্যাদি।
২. সংকলন পদ্ধতি : তিনি যখন হাদীস লেখার ইচ্ছে করতেন তখন প্রতিটি হাদীস লেখার আগে গোসল করে ইস্তেখারার নিয়তে দু’রাকাত নফল নামায আদায় করতেন।
৩. হাদীস সংখ্যা : ইমাম বুখারী (র) তাঁর সংগৃহীত ছয় লক্ষ হাদীস থেকে যাচাইবাছাই করে ৭২৭৫টি হাদীস বুখারী শরীফে সন্নিবেশিত করেন। পুনরুল্লেখ ছাড়া মোট চার হাজার হাদীস এতে সন্নিবেশিত হয়েছে। বুখারী শরীফে মোট ১৬০টি পর্ব ৩৪৫০টি অধ্যায় রয়েছে ।
৪. মর্যাদা : হাদীসশাস্ত্রে অতুলনীয় অবদানের জন্য ইমাম বুখারী (র) যেমন অতুলনীয় সম্মান মর্যাদার অধিকারী, তেমনি তাঁর সংকলিত সহীহ বুখারী শরীফও জগদ্বিখ্যাত এবং অনন্য মর্যাদায় মহিমান্বিত শ্রেষ্ঠ হাদীসগ্রন্থ। তাই তো এর মর্যাদার ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণ বলেন, ‘পবিত্র কুরআনের পর যমীনের উপর আসমানের নিচে সর্বাধিক বিশুদ্ধ গ্রন্থ হলো বুখারী শরীফ।’
৫. বুখারী শরীফ সংকলনের অনুপ্রেরণা : ইমাম বুখারী (র) একদা স্বপ্নে দেখেন, তিনি রাসূল (স)-এর পবিত্র শরীর থেকে পাখা দিয়ে মশা মাছি তাড়াচ্ছেন। পরে এ স্বপ্নের তাবীর সম্পর্কে তিনি জানতে পারেন, তিনি রাসূল (স)-এর বিশুদ্ধ হাদীসগুলো থেকে দুর্বল হাদীস আলাদা করবেন। এরপর থেকেই তিনি হাদীস সংকলনে মনোনিবেশ করেন।
৬. মাযহাব : তকীউদ্দীন সুবকী (র)-এর মতে, ইমাম বুখারী (র) প্রথমদিকে শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি নিজস্ব অভিমতের ভিত্তিতে আসলী জীবন পরিচালনা করেন ।
পরিশেষে : হাদীস সংকলনের ইতিহাসে ইমাম বুখারী (র) ও তাঁর কালজয়ী অমর হাদীস সংকলন ‘সহীহ আল বুখারী’ এক গৌরবময় সোনালি অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ইমাম বুখারী (র)-এর অক্লান্ত পরিশ্রম, অভূতপূর্ব মেধা, নিয়তের বিশুদ্ধতা, সততা ও সতর্কতা এবং মননশীলতার প্রামাণ্য হাদীসের সুবাদেই প্রথমে আমরা সহীহ বুখারীর শরণাপন্ন হই।