প্রশ্ন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরচিত একরাত্রি গল্পের বিষয়বস্তু / মূল বক্তব্য নিজের ভাষায় লেখ।
অথবা, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একরাত্রি গল্পের মূলভাব নিজের ভাষায় আলোচনা কর।
অথবা, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একরাত্রি গল্পের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নিজের ভাষায় আলোচনা কর।
উপস্থাপনা : বাংলা সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র, নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরচিত ‘একরাত্রি’ তাঁর অনন্য সৃষ্টি ‘গল্পগুচ্ছ’ শীর্ষক গ্রন্থের অন্তর্গত একটি অসাধারণ ছোটগল্প। এ গল্পে মানব-মানবীর শাশ্বত প্রেমকে গল্পকার ভিন্ন মাত্রায় উপস্থাপনের প্রয়াস পেয়েছেন।
সংকীর্ণ কামনা-বাসনার ঊর্ধ্বে এক দেহাতীত প্রেমের ঘটনাকে উপজীব্য করে গভীর ভাব-ব্যঞ্জনায় নির্মিত হয়েছে আলোচ্য গল্পটি। গল্পটি একজন কথকের ভাষ্যে রচিত হয়েছে। কথক নিজেই গল্পের নায়ক। নিচে গল্পটির মূল বক্তব্য উপস্থাপন করা হলো ।
একরাত্রি গল্পের বিষয়বস্তু / মূলভাব
গল্পের বিষয়বস্তু/মূলভাব : ‘একরাত্রি’ গল্পটি কথকের ভাষ্যে রচিত। এতে নায়কের নাম গোপন রাখা হয়েছে। বস্তুত গল্পকার নিজেই গল্পের নায়ক। এটি শুরু হয়েছে নায়কের বাল্যস্মৃতি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে।
নায়কের পরিচয় : গল্পের নায়কের পিতা চৌধুরী-জমিদারের নায়েব ছিল। গ্রামের পাঠশালায় সে পড়ালেখা করে । পিতার পরিকল্পনা ছিল লেখাপড়া শেষে তাকে জমিদারির গোমস্তাগিরিতে লাগিয়ে দেওয়ার; কিন্তু নায়ক ছিল কিছুটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী। সে লেখাপড়া শিখে কালেক্টরের নাজির হতে চায়।
আরও জানো : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের- একরাত্রি গল্পের নামকরণের সার্থকতা
নায়িকার পরিচয় : ‘একরাত্রি’ গল্পের নায়িকার নাম সুরবালা। সে ছিল নায়কের প্রতিবেশী এবং ছেলেবেলার খেলার সাথি। একসাথে তারা পাঠশালায় যেত। তবে সুরবালা ছিল নায়কের চেয়ে সাত বছরের ছোট। সমাজে সুরবালার রূপের প্রশংসা ছিল।
নায়ক ও সুরবালার সম্পর্ক : নায়ক প্রতিবেশী সুরবালার সাথে বাল্যকালে বউ-বউ খেলত এবং একই পাঠশালায় লেখাপড়া করতো। যেমন গল্পে এসেছে- “সুরবালার সঙ্গে একত্রে পাঠশালায় গিয়াছি এবং বউ-বউ খেলিয়াছি।” সুরবালার মা নায়ককে খুব আদর-যত্ন করতো। এ অধিকারবলে সে সুরবালার প্রতি কর্তৃত্ব খাটাত। অন্যদিকে সুরবালাও, নায়কের সকল প্রকার আদেশ-নিষেধ পালন করতো।
নায়কের কলকাতা গমন : একই পাড়ার নীলরতনের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে নায়ক শৈশবেই আদালতজীবী হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতায় গিয়ে তার গ্রামের এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয়।
স্বদেশি আন্দোলনে যোগদান : নায়কের লেখাপড়া ঠিকমতোই চলছিল। পাশাপাশি নায়ক স্বদেশি আন্দোলনেও জড়িয়ে পড়ে। দেশোদ্ধারে আদর্শ নেতা হওয়ার নেশায় বিভোর থাকে সে। বিখ্যাত নেতা মাটসীনি গারিবালডি তার স্বপ্নের নায়কে পরিণত হয়।
ছোটবেলার খেলার সাথি সুরবালাকে সে বেমালুম ভুলে যায়। এমন সময় পরিবারের পক্ষ থেকে সুরবালার সাথে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে নায়ক তার পিতাকে জানিয়ে দেয়, লেখাপড়া শেষ না করে সে বিয়ে করবে না । নেতা হওয়ার স্বপ্নই তাকে জেকে ধরে।
আরও জানো : একরাত্রি গল্পের প্রেমের স্বরূপ বিশ্লেষণ কর
সুরবালার বিয়ে : নায়ক সুরবালাকে বিয়ের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলে নোয়াখালীর সরকারি উকিল রামলোচন বাবুর সাথে সুরবালার বিয়ে হয়ে যায় ।
বিপর্যস্ত নায়ক : নায়ক কলকাতায় মাধ্যমিক পাসের পর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমন সময় তার পিতার মৃত্যু হয়। গোটা পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে তার ওপর। পিতৃবিয়োগে শোকবিহ্বল নায়ক দিশেহারা হয়ে পড়ে। এভাবে তার জীবনে ছন্দপতন শুরু হয়।
নায়কের চাকরিলাভ : বিধবা মাতা ও দুবোনের ভরণপোষণের জন্য নায়ক দেশোদ্ধারের মহান ব্রত ত্যাগ করে চাকরির সন্ধানে বের হয়। অনেক চেষ্টার পর নোয়াখালী জেলার একটি এন্ট্রান্স স্কুলে সেকেন্ড মাস্টারের চাকরি পায়; শুরু হয় তার নতুন জীবন।
সুরবালার পুনরুত্থান : নায়কের থাকার ব্যবস্থা হয় স্কুলঘরের একটি কামরায়। স্কুলের অনতি দূরে একটি বাড়িতে উকিল রামলোচন বাবু সুরবালাকে নিয়ে বসবাস করেন, তা নায়ক আগেই জানতে পেরেছে।
প্রথমে সুরবালার কাছাকাছি অবস্থান নায়কের কাছে ভাবনার বিষয় মনে না হলেও একপর্যায়ে তার নিস্তরঙ্গ হৃদয়সমুদ্রে অলক্ষ্যে সুরবালার পুনরুত্থান মহাসমুদ্রের তরঙ্গ কল্লোল সৃষ্টি করে ।
আরও জানো : পুঁইমাচা গল্পের বিষয়বস্তু /মূলভাব/মূল বক্তব্য/মূল সুর
বাধার প্রাচীর : একদিন নায়কের রামলোচন বাবুর বাসায় বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ হয়।. বৈঠকখানায় তারা ভারতবর্ষের দুরবস্থা নিয়ে গল্প করছিল। এমন সময় পাশের ঘরে চুড়ির টুংটাং শব্দ, শাড়ির একটু খসখসানি এবং পায়েরও একটু আওয়াজ শুনতে পায়। নায়ক বুঝতে পারে সুরবালা জানালার ফাঁক দিয়ে কৌতূহলী চোখে তাকে দেখছে।
নায়কের মনের পর্দায় ভেসে ওঠে সুরবালার সাথে ঘুরে বেড়ানো সেই শৈশবকালের নানা স্মৃতি। সুরবালার জন্য তার মন হাহাকার করে ওঠে, কিন্তু স্বামী-সংসার নামক সামাজিক বন্ধনের কাছে নায়কের শত আশা-আকাঙ্ক্ষা বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায় ।
নায়কের অনুভূতি : সেদিন রামলোচনের বাসা থেকে ফিরে আসার পর নায়কের জীবনে এক নতুন অনুভূতি জাগ্রত হয়। বিগত জীবনের সব ভুল বুঝতে পেরে সে অনুতপ্ত হয়। যে সুরবালাকে সে ইচ্ছে করলেই পেতে পারত, আজ তাকে চোখে দেখার অধিকারটুকুও তার নেই।
নিজের প্রশ্নবাণেই আজ সে জর্জরিত। সুরবালা আজ তার কেউই নয়, কিন্তু সুরবালা তার কী না হতে পারত। তার সব সুখ-দুঃখের সাথি হয়ে সুরবালা যে তার কাছে থাকতে পারেনি, সে তার নিজেরই ভুলে। এখন নীরবে সুরবালার স্মৃতিচারণ ছাড়া তার আর করার কিছুই নেই।
অনন্ত রাত্রির উদয় : বিপর্যন্ত নায়কের সমগ্র অন্তর জুড়ে এখন শুধুই সুরবালা। ইতোমধ্যে এক সোমবার সকাল থেকেই সমগ্র আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। চারদিকে দুর্যোগের ঘনঘটা। নায়কের মনে পড়ে, মোকদ্দমার কাজে রামলোচন কিছুদিন যাবৎ বাড়িতে নেই । এ দুর্যোগের রাতে ঘরে সুরবালা একা। সুরবালাকে সাহায্য করার জন্য তার মন ব্যাকুল সুরবালা পুকুর পাড়ে আসে।
নায়কও ঘর থেকে বেরিয়েছে সুরবালাকে সাহায্য করতে। রাত একটা-দেড়টার দিকে বানের জল ধেয়ে আসলে আত্মরক্ষার জন্য প্রলয়ংকর সেই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাতে নায়ক আবার কাছে পায় সুরবালাকে। অন্ধকারে তারা দু’জন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে। তারা খুব কাছাকাছি হলেও বিচ্ছেদের যোজন দূরত্ব তাদের নির্বাক করে রাখে।
নায়কের আত্মোপলব্ধি : নায়ক অবশেষে জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে উপলব্ধি করতে পারে- “মনুষ্যসমাজ একটা জটিল ভ্রমের জাল। ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করিতে কাহারও মনে পড়ে না, তাহার পরে বেঠিক সময়ে বেঠিক বাসনা লইয়া অস্থির হইয়া মরে।” ‘একরাত্রি’ এমনি একজন অস্থিরচিত্ত নায়কের কাহিনি।
উপসংহার : ‘একরাত্রি’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি অনবদ্য গল্প । যার শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে, আবেগ-উচ্ছ্বাসের বশবর্তী হয়ে সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করতে না পেরে গল্পের নায়ক যেমন পরে অস্থির হয়ে মরে, বেশিরভাগ মানুষের স্বভাবই এমন। তাই সুস্থির মনে, ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করতে হবে।