উৎপত্তি বা উৎস অনুসারে শব্দ কত প্রকার ও কী কী ? উদাহরণ সহ

মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষকে পরস্পরের সাথে ভাবের আদান-প্রদান করতে হয় । মানুষের মনে যখন কোন ভাবের উদয় হয়, তখন তা বাগযন্ত্রের সাহায্যে কতিপয় সাংকেতিক ধ্বনির মাধ্যমে প্রকাশিত হয় । কণ্ঠ থেকে নির্গত এই সব অর্থপূর্ণ ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি যখন কোন বস্তু, বিষয় বা ভাবকে ব্যক্ত করে, তখন সে ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিকে বলা হয় শব্দ ।

উৎপত্তি বা উৎস অনুসারে শব্দ কত প্রকার ও কী কী ?

উৎপত্তি বা উৎস অনুসারে বাংলা ভাষার শব্দ সমষ্টিকে ৬ ভাগে ভাগ করা যায় । যথা-

ক. তৎসম
খ. তদ্ভব
গ. অর্ধ তৎসম
ঘ. দেশি
ঙ. বিদেশি ও
চ. মিশ্র।

ক. তৎসম শব্দ : ‘তৎসম’ একটি পারিভাষিক শব্দ। এ শব্দটিকে ভাঙ্গলে ‘তৎ’ এবং ‘সম’ এ দুটি শব্দ পাওয়া যায়। ‘তৎ’ অর্থ তার বা সংস্কৃতের এবং ‘সম’ অর্থ সমান। অর্থাৎ ‘তৎসম’ শব্দের অর্থ হলো সংস্কৃতের সমান। সুতরাং যে সকল সংস্কৃত শব্দ কোনরূপ বিকৃত না হয়ে সরাসরি বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে, তাদেরকে তৎসম শব্দ বলে। যেমন – ভ্রাতা, চন্দ্র, সূর্য, কর্ম, নিমন্ত্রণ, অগ্নি, মস্তক, হস্ত, আম্র, গ্রহ, যুক্ত, শক্তি, মুক্ত, ভক্তি, বক্ষ, বৃক্ষ, চক্ষু, কর্ম, কর্ণ, বর্ম, ধর্ম, চর্ম, ক্ষতি, নিদ্রা, নক্ষত্র ইত্যাদি। বাংলা ভাষায় প্রায় একলক্ষ পঁচিশ হাজার শব্দ আছে। এদের মধ্যে তৎসম শব্দের পরিমাণ প্রায় চল্লিশ হাজার।

আরো পড়ুন : গঠন অনুসারে ও অর্থ অনুসারে শব্দ কত প্রকার ও কী কী উদাহরণ সহ

খ. তদ্ভব শব্দ : তদ্ভব’ একটি পারিভাষিক শব্দ। এ শব্দটিকে ভাঙ্গলে ‘তৎ’ এবং ‘ভব’ এ দুটি শব্দ পাওয়া যায়। ‘তৎ’ অর্থ তার বা সংস্কৃত এবং ‘ভব’ অর্থ উৎপন্ন। অর্থাৎ ‘তদ্ভব’ শব্দের অর্থ হলো সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন। সুতরাং যে সকল সংস্কৃত শব্দ প্রাকৃত ভাষার মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে আধুনিক বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে, তাদেরকে তদ্ভব শব্দ বলে । বর্তমানে এই শব্দগুলোকে খাঁটি বাংলা শব্দও বলা হয়। যেমন- হস্ত > হথ > হাত; চন্দ্ৰ > চন্দ > চাঁদ; কার্য > কজ্জ > কাজ: দধি > দহি > দই; কর্ণ > কন্ন > কান; মৎস > মচ্ছ > মাছ ইত্যাদি।

গ. অর্ধ তৎসম : ‘অর্ধ’ অর্থ আধা আর ‘তৎসম’ অর্থ সংস্কৃত। অর্থাৎ অর্ধ তৎসম শব্দের অর্থ হলো আধা সংস্কৃত । সুতরাং যে সকল সংস্কৃত শব্দ কিঞ্চিত পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে, তাদেরকে অর্ধ তৎসম শব্দ বলে। যেমন- জ্যোৎস্না > জ্যোছনা; গৃহিনী > গিন্নী; কুম্ভীর > কুমির; গাত্র > গতর; নিমন্ত্রণ > নেমন্তন্ন; ক্ষুধা > খিদে ইত্যাদি ।

ঘ. দেশি শব্দ : বাংলাদেশের আদিম অনার্য জাতির ব্যবহৃত ভাষা থেকে যে সব শব্দ বাংলা ভাষায় এসেছে, সেগুলোকে দেশি শব্দ বলে। যেমন- কুলা, খোপা, গয়লা, ঝিঙা, টোপর, চোঙ্গা, ডিঙ্গি, ঢেঁকি, ঢোল, ধুতি ইত্যাদি।

ঙ. বিদেশি শব্দ : পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও জাতির ভাষা থেকে যে সব শব্দ বাংলা ভাষায় এসেছে, সেগুলোকে বিদেশি শব্দ বলে । বাংলা ভাষায় প্রচলিত কতিপয় বিদেশি শব্দের উদাহরণ নিম্নে দেয়া হলো-

১. আরবি : আল্লাহ, আজান, আমীর, আক্কেল, আরজ, আজাব, আশরাফ, আতরাফ, আখেরাত, ইসলাম, ইনসান, ইনাম, ইমারত, ইল্লত, ঈমান, ঈদ, এজলাস, উকিল, এবাদত, ওস্তাদ, ওয়াজ, ওজু, কুরআন, হাদিস, কিতাব, কয়েদ, কায়দা, কাজী, কোরবানী, কুলুপ, কিচ্ছা, কলম, কেরামত, কবর, গোলাম, গায়েব, জনাব, তাজ্জব, তাসবিহ, তহবিল, দুনিয়া, দোয়াত, মৌলভি, মুন্সেফ, মক্কেল, মোকাবিলা, মোক্তার, বাকি, হাজির, রাজা, আসবাব, আতর, এজলাস, কলব, কলেমা, কসাই, কাফের, কেয়ামত, খয়রাত, খাসি, গরজ, গোনাহ, জবাব ইত্যাদি ।

আরো পড়ুন : সাধিত শব্দ কাকে বলে কত প্রকার ও কী কী এবং সাধিত শব্দ গঠন

২. ফারসি : অন্দর, আওয়াজ, আবাদ, আন্দাজ, আসমান, আসামী, আমীর, আয়না, আইন, আদব, আকল, আতর, আবহাওয়া, উজির, উকিল, উমরাহ, ওজন, ওয়াশিল, কম, কলম, কাগজ, কামান, কানুন, কসাই, কুলুপ, কোরবানি, কিশমিশ, কারখানা, কোমর, খানা, খানসামা, খাজনা, খাতা, খোরাক, খেয়াল, খবর, খুব, গোমস্তা, গোলাপ, গজব, গালিচা, চরখা, চাকর, জানোয়ার, জমি, জমা, জের, জাহান, জবানবন্দি, জামা, জোর, জেরা, তাজা, তহশীল, তালুক, তাকিয়া, দলিল, দোয়াত, দরবার, দালান, দূরবীন, দখল, দোকান, দারোগা, দপ্তর, নামাজ, নগদ, নাবালক, নালিশ, নরম, নেহায়েত, পিয়ারা, পর্দা, পছন্দ, পেশা, পেয়ালা, পোদ্দার, পশম, বরাবর, বেশি, বেকুব, ভিস্তি, মলম, মখমল, মজবুত, ময়দা, মুহুরি, মোকদ্দমা, মুনসেফ, মসজিদ, মোহর, রেশম, রায়, শরিয়ৎ, শিশি, শহীদ, শাল, শিরনী, শহর, শিকার, সন, সরকার, সর্দার, সেতার, সিন্দুক, সেলাই, সাদা, সাগরেদ, হালুয়া, হিসাব, হুকা, হুজুর, হজম, হাকিম ইত্যাদি।

৩. তুর্কি : আলখাল্লা, উর্দি, কাচি, কোর্মা, কাবু, কুলি, খাতুন, খানম, গালিচা, চাকু, দারগা, বিবি, বোঁচকা, বাবুর্চি, বাহাদুর, বেগম, বাবু, বাবা, লাশ ইত্যাদি ।

৪. ইংরেজি : অয়েল, আয়রন, আর্ট, আরদালি, অফিস, স্কুল, ইঞ্জিনিয়ার, ইঞ্জিন, ইঞ্চি, ইনসিওর, ইনন্সপেক্টর, উইল, এয়ারিং, এরোপ্লেন, ওয়াটারপ্রুফ, কন্ট্রোল, কলেজ, কানেস্তারা, কোট, কাপ্তেন, কফি, কাটলেট, কেরোসিন, কাপ, কোচোয়ান, কোটপ্যান্ট, কেস, কলেরা, কার্নিশ, ক্রিকেট, কার্পেট, কালেক্টর, গ্লাস, চেয়ার, চিমনি, চক, জজ, জেল, টেবিল, টিকিট, ট্রেন, টিন, ট্রাম, ট্রেডমার্ক, ডাক্তার, ডেক, ডক, ডিগ্রি, ডজন, ডেলি, থিয়েটার, দেরাজ, নার্স, নম্বর, নিব, প্লেট, পলেস্তরা, পুলটিশ, পালিশ, প্লাটফর্ম, পিন, পিওন, প্যাড, পোস্ট, পেন্সিল, পাস, প্যান্ট, পুলিশ, পার্ক, পকেট, পাউডার, পাবলিক, ফেল, ফি, ফ্রি, ফুটবল, ফুটপাথ, ফোন, ফুট, ফটো, বেঞ্চি, বুরুশ, বেলেস্তারা, বার্ণিশ, ব্যাংক, ব্যাগ, বাস, বোর্ড, বাথরুম, বান্ডিল, ভেটো, মেম, মোটর, মার্কিন, মানিব্যাগ, মাস্টার, ম্যাজিস্ট্রেট, মাইল, রেজিস্ট্রি, শ্লেট, স্টীমার, সোফা, সিল্পক, সোডাওয়াটার, সমন, হারমোনিয়াম, হ্যাট, হ্যান্ডসেক, হেডমাস্টার, হাসপাতাল ইত্যাদি ।

৫. পর্তুগিজ : আনারস, আলকাতরা, আচার, আলপিন, আলমারি, আয়া, কফি, কাকাতুয়া, কেরানি, গরাদ, গাঁদা, গীর্জা, চাবি, জানালা, গোলাপ, নিলাম, লোনা, পেঁপে, পিস্তল, পাউরুটি, পেরেক, পাদরি, বোমা, বোতাম, বালতি, বিত্তি, বন্দর, বাসন, মিস্ত্রি ইত্যাদি।

৬. ফরাসি : ওলন্দাজ, কার্তুজ, কুপন, কাফে, ফিরিঙ্গি, বুর্জোয়া, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি।

৭. ওলন্দাজ : ইস্কুপ, ইস্কাপন, টেক্কা, তুরুপ, রুইতন, বোম, হরতন, চিরাতন ইত্যাদি।

৮. হিন্দি : আচ্ছা, কাঁহাতক, কুত্তা, কাচ্ছাপানি, চরখা, চিজ, চানাচুর, ঝুটা, বাতচিত, বানি, সাচ্চা, খিল, চেহারা, জঙ্গল, ঠান্ডা, পানি, বাচ্চা, ভরসা, সাথী, চাহিদা ইত্যাদি।

৯. চীনা : গুলাচি, চা, চিনি, লুচি, সিন্দুর, লিচু, তুফান ইত্যাদি।

১০. জাপানি : রিক্শা, সাম্পান, হারিকিরি, প্যাগোডা ইত্যাদি ।

১১. ইতালি : গেজেট, ম্যালিরিয়া, পিস্তুল, ম্যাজেন্টা ইত্যাদি ।

১২. বর্মি : লুঙ্গি, ফুল, গেঞ্জি, মুখান ইত্যাদি।

১৩. মালয় : গুদাম, সাগু, কিরিচ ইত্যাদি।

১৪. ইন্দোনেশিয় : বাতাবি ইত্যাদি

১৫. মারাঠি : চৌথ, বর্গীয়, বর্তমান ইত্যাদি।

১৬. রাশিয়ান : বলশেভিক, সোভিয়েত, কমিউন ইত্যাদি।

১৭. গুজরাটি : হরতাল, জয়ন্তী, খদ্দর  ইত্যাদি ।

১৮. অস্ট্রেলিয়া : কাঙ্গারু ইত্যাদি।

১৯. আফ্রিকা : জেব্রা, জিরাফ ইত্যাদি।

২০. তিব্বত : জামা ইত্যাদি ।

২১. পেরু : কুইনাইন ইত্যাদি ।

২২. শ্রীলঙ্কা : লঙ্কা ইত্যাদি ।

২৩. ইতালিয় : ম্যাজেন্টা (রং) ইত্যাদি।

চ. মিশ্র বা সংকর শব্দ : দুইটি বিদেশি অথবা একটি দেশি ও একটি বিদেশি শব্দের মিলনে গঠিত যে সব শব্দ বাংলা ভাষায় প্রচলিত রয়েছে তাদের মিশ্র বা সংকর শব্দ বলে। যেমন-

বিদেশি + বিদেশি শব্দের মিলন : হেড মাস্টার, হেড মৌলভী ইত্যাদি ।

দেশি + বিদেশি শব্দের মিলন : রাজা-উজির, হাট-বাজার, শাক-সবজি, লজ্জা-সরম, ধন-দৌলত ইত্যাদি ।

বিদেশি + দেশি শব্দের মিলন : জামাই-বাবু, মাস্টার-মশাই, হেড পণ্ডিত, হাফ হাতা ইত্যাদি ।

মিশ্র প্রত্যয়ান্ত : ফুলদানি, নস্যাদান, মামলাবাজ, মাস্টারি, বাজার ইত্যাদি।

আমার মূল লক্ষ্য একটাই (Sikkhagar-শিক্ষাগার) ওয়েবসাইটের হাত ধরে “শিক্ষা হবে উন্মুক্ত ও বাণিজ্যমুক্ত”। এই প্লাটফর্মে থাকবে একাডেমিক প্রস্তুতি, ভর্তি প্রস্তুতি, চাকরি প্রস্তুতি, স্পেশাল স্কিল এবং ধর্মীয় শিক্ষাসহ নানাবিধ বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ।

Leave a Comment