উপস্থাপনা:
সাহিত্য হলো দৈনন্দিন জীবনে মানুষের কার্যকলাপের বাস্তব চিত্র। একে মানবজীবনের দর্পণ বলা হয়। সাহিত্যে ব্যক্তি জীবনের পাশাপাশি জাতীয় জীবনের আলোচনাও স্থান পায়। বাংলাদেশের অধিকাংশ সাহিত্য জাতীয় জীবনকে কেন্দ্র করে রচিত। বাংলাদেশের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ এক বিরাট স্থান দখল করে আছে।
সাহিত্যের সংজ্ঞা:
সাহিত্য মানবজীবনের দর্পণস্বরূপ। সাহিত্য হলো মানব চরিত্রের বিকাশ। মূলত সাহিত্য কথাটির অর্থ ব্যাপক। একদিকে যেমন গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা এর আওতায় পড়ে। অপরদিকে তেমনি দর্শন, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজনীতির আলোচনাও এতে হয়ে থাকে। মানুয়ের ভাব ও ভাবনা, চিন্তা ও জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির ভাষাশ্রিত রূপই সাহিত্য।
আরো পড়ুন : প্রবন্ধ রচনা : সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার
বাংলাদেশের সাহিত্য:
বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ। এর সাহিত্যে রয়েছে সমাজ, সভ্যতা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি রূপ, রস, সৌন্দর্য ইত্যাদি। বাংলাদেশের এসব নিয়ে ভাব ও কল্পনার সমন্বয়ে বাস্তবতার নিরিখে যে ভাষাশ্রিত রূপ আলোচিত হয়েছে তা-ই বাংলাদেশের সাহিত্য।
মুক্তিযুদ্ধের পরিচয়:
১৯৭১ সালে বাংলার মানুষ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। অনেক প্রাণের বিসর্জনের মধ্য দিয়ে অবশেষে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। তাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একটি ত্যাগের ইতিহাস।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট:
পলাশী যুদ্ধের পর থেকে ইংরেজরা এদেশের রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে এবং পরবর্তীতে সম্পূর্ণ শাসন ক্ষমতা নিয়ে প্রায় দু’শ বছর এ অঞ্চল শাসন করে। ইংরেজ শাসন হতে দেশ মুক্ত হওয়ার পর প্রায় ২৪ বছর পাকিস্তানিরা শাসন করে। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন হয়। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে পাকিস্তানি সামরিক শাসন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম অত্যাচার শুরু হয়। আর সেই সাথে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ তথা দেশ স্বাধীন করার সংগ্রাম।
আরো পড়ুন : রচনা : মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সমাজের ভূমিকা
বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ:
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় চেতনায় এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। এটা ছিল অন্যায়, জুলুম, শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দিক-নির্দেশক; স্বীয় ব্যক্তিত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব, আধিপত্য অটুট রাখার শপথে বলীয়ান হওয়ার প্রেরণাদাতা। আমাদের দেশের সৃজনশীল কবি, সাহিত্যিক ও নাট্যকার তাঁদের ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। এ ধরনের সাহিত্যকর্ম আমাদের নতুন প্রজন্মকে শোষণ, নির্যাতন ও নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনে অনুপ্রেরণা যোগাবে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রভাবিত সাহিত্য:
আমাদের বর্তমান সাহিত্যাঙ্গনের অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ কী- কেন হলো- কিভাবে হলো- কার ভূমিকা কেমন ছিল- এসব প্রশ্নের সঠিক তথ্য পাই আমরা সাহিত্যকর্ম থেকে, যা আমাদের চলার পথে মাইলফলক হিসেবে কাজ করে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ কবি-সাহিত্যিক মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে কতিপয় কবি-সাহিত্যিক তাদের সাহিত্যকর্মের মাধ্যমেজাগিয়ে তুলেছেন ঘুমন্ত জাতিকে, প্রেরণা যুগিয়েছেন তরুণ ও যুবসমাজকে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কবি-সাহিত্যিক হলেন- শওকত ওসমান, আল মাহমুদ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, শামসুর রাহমান, সৈয়দ আলী আহসান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, এম. আর. আখতার মুকুল, হাসান আজিজুল হক, জসীমউদ্দীন প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ গ্রন্থাবলি:
মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এসব গ্রন্থে প্রতিফলিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব চেতনা এবং আমাদের জাতীয়তাবোধ। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো- আল মাহমুদের ‘কাবিলের বোন’, আবদুল হাফিজের ‘রক্তাক্ত মানচিত্র’, এম. এ. ভূঁইয়ার ‘মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস’, শাহিদা বেগমের ‘যুদ্ধে যুদ্ধে নয় মাস’, শওকত ওসমানের ‘জাহান্নাম হতে বিদায়’ প্রভৃতি।
আরো পড়ুন : বাংলা প্রবন্ধ রচনা : গ্রন্থাগার
সংগীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন দেশের বীর সন্তানদের অনেক তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। রচিত হয়েছে মনমাতানো সংগীত-“মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি,” “এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না।” রক্তের বন্যায় সেদিন অন্যায়ের স্তূপ ভেসে গিয়েছিল। আর শিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে গানে গানে মুখরিত করে দিয়েছিল মুক্তিপাগল জনতাকে। চিত্তের প্রশান্তি এনে দিয়েছিল দেশাত্মবোধক বিভিন্ন সংগীত উপহার দিয়ে। এ ছাড়াও নাটক, উপন্যাস ও চিত্রকলায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চিত্র ফুটে উঠেছে।
আমাদের দায়িত্ব:
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য আমাদেরকে সাহিত্যকর্মে আত্মনিয়োগ করতে হবে। এতে নতুন প্রজন্ম এসব সাহিত্য থেকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করবে, আর ভবিষ্যতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার শপথ সার্বভৌমত্ব নেবে। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন ঘটে এমন সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। পাশাপাশি পূর্বরচিত সাহিত্যভাণ্ডার সংরক্ষণ করাও আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
উপসংহার:
বাংলাদেশের সাহিত্য মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলনে যথেষ্ট সমৃদ্ধ নয়; বরং নবীন ও প্রবীণ সাহিত্যিকবৃন্দের আরো সচেষ্ট হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ সাহিত্য রচনায় তৎপর হওয়া আবশ্যক। যতদিন মানুষের মনে সাহিত্যপ্রেম, সাহিত্যের প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে, ততদিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও জাগরিত থাকবে।
আরো পড়ুন : রচনা : আকাশ সংস্কৃতি / আকাশ সংস্কৃতি ও আমাদের করণীয়