আকাইদ ইসলামের মৌলিক একটি শাস্ত্র। এ শাস্ত্র ঈমানের প্রকৃতি কোন কোন বিষয়ে, কিভাবে এবং কতটুকু ঈমান জরুরি সেসব বিষয়ে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা দান করে। পাশাপাশি অজ্ঞতা, ভ্রান্তি, কুসংস্কার ও সীমালঙ্ঘন থেকে মুসলমানদের ঈমানকে সুরক্ষা করতে এ শাস্ত্র সাহায্য করে। নিম্নে আকাইদ শব্দের অর্থ কি ? কাকে বলে এবং এর উদ্দেশ্য ও বিষয়বস্তু বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
আকাইদ শব্দের অর্থ কি?
আকাইদ (عَقَائِدُ) শব্দটি আকিদাহ (عَقِيدَة) -এর বহুবচন। যা عَقْدٌ মূলধাতু হতে গৃহীত। এর আভিধানিক অর্থ হলো :
১। দৃঢ় বিশ্বাস ।
২। ধর্মীয় বিশ্বাস।
৩। আন্তরিক ঈমান।
৪। মজবুত বিশ্বাস ।
৫। পরিপূর্ণ করা।
৬। পালন করা ইত্যাদি।
যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে وَالَّذِينَ عَقَدَتْ أَيْمَانُكُمْ فَآتُوهُمْ نَصِيبَهُمْ অর্থাৎ যারা তোমাদের সাথে কৃত অঙ্গীকারসমূহ পূরণ করে, তাদেরকে তাদের অধিকার প্রদান কর।
আরও পড়ুন : আকাইদের মৌলিক বিষয় কয়টি ও কি কি? এবং আকিদার গুরুত্ব
আকাইদ শব্দের একবচন এবং বহুবচন কি ?
আকাইদ (عَقَائِدُ) আসলে বহুবচন রূপ। এর একবচন হলো আকিদাহ (عَقِيدَة ), যার অর্থ বিশ্বাস, আস্থা, ধর্মমত ইত্যাদি।
তাই:
আকাইদ (عَقَائِدُ) এর একবচন : আকিদাহ (عَقِيدَة)।
আকিদাহ (عَقِيدَة) এর বহুবচন : আকাইদ (عَقَائِدُ)।
আকাইদ কাকে বলে ?
সংজ্ঞা : ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায়, যে শাস্ত্র দ্বারা দলিল-প্রমাণসহ ধর্মীয় বিধানসমূহ প্রমাণ করা এবং সকল সন্দেহ ও সংশয় দূর করা সম্ভবপর হয় তাকে আকাইদ বলা হয়।
ইবনে খালদুন (র.)-এর মতে : যে শাস্ত্রে ঈমান সংক্রান্ত বিশ্বাসসমূহ সম্পর্কে যুক্তিনির্ভর দলিলসমূহ দ্বারা প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়ে থাকে, তাকে ইলমুল কালাম বা আকাইদ বলা হয় ।
আরও পড়ুন : বিশুদ্ধ আকিদা কি ? এবং বিশুদ্ধ আকীদার গুরুত্ব
আকাইদশাস্ত্রের উদ্দেশ্য :
আকাইদ শাস্ত্রের মূল উদ্দেশ্য হলো, পার্থিব জীবন ও পরকালীন জীবনে সৌভাগ্য অর্জন করা। আর এ উদ্দেশ্য হাসিল করতে প্রয়োজন বিশুদ্ধ আকিদা বিশ্বাসের জ্ঞানার্জন করে ভ্রান্ত আকিদা বিশ্বাস হতে নিজেকে রক্ষা করা এবং ভ্রান্ত আকিদা বিশ্বাসকে দলীল প্রমাণ দ্বারা খণ্ডন পূর্বক মুসলিম উম্মাহকে প্রকৃত পথ ও সিরাতুল মুস্তাকিমের দিশা দান করা ।
আল্লামা মুহাম্মদ আলী (র) আকাইদ শাস্ত্রের পাঁচটি উদ্দেশ্য উল্লেখ করেছেন । যথা—
১. বিশ্বাসের দৃঢ়তা অর্জন : ব্যক্তির চিন্তাশক্তির বিবেচনায় আকাইদের উদ্দেশ্য হলো। অনুকরণের নাগপাশ ছিন্ন করে দৃঢ়বিশ্বাসের উচ্চস্তরে উপনীত হওয়া।
২. বিশুদ্ধ আকিদা অর্জন : ইসলামী আকিদা বিশ্বাসের পক্ষে স্পষ্ট দলীল প্রমাণের মাধ্যমে সঠিক পথপ্রদর্শন এবং বিরুদ্ধবাদীদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়ার জন্য অকাট্য দলীল প্রমাণ উপস্থাপন করা ।
৩. বাতিল পন্থিদের মোকাবেলা : বাতিলপন্থিদের সন্দেহ-সংশয় এবং ভ্রান্ত মতবাদের আক্রমণ থেকে ইসলামের মূলনীতি এবং আকিদা বিশ্বাসকে রক্ষা করা।
৪. নিয়ত ও কর্মের বিশুদ্ধতা অর্জন : কর্মসমূহে নিয়তের বিশুদ্ধতা অর্জন এবং কর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট হুকুমসমূহে বিশুদ্ধ বিশ্বাসের প্রত্যয় সৃষ্টি করা। কারণ এর ফলেই কর্ম বা আমল গৃহীত হয়ে থাকে।
৫. শরয়ী জ্ঞানবিজ্ঞানের উদ্ভাবন : তাঁর মতে-এ শাস্ত্রের ভিত্তিতে শরয়ী জ্ঞানবিজ্ঞান উদ্ভাবন করা হয়ে থাকে। বস্তুত বিশুদ্ধ বিশ্বাস ও আকিদা অর্জন এবং এর আলোকে কর্ম বা আমলের মাধ্যমে ইহকাল ও পরকালের সাফল্য অর্জন করাই ইলমুল আকাইদের মূল উদ্দেশ্য।
আরও পড়ুন : আকাইদ শাস্ত্রের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
আকাইদশাস্ত্রের বিষয়বস্তু :
আল্লামা কাযী আযদুদ্দীন আবদুর রহমান ٱلْمُوَافِقُ গ্রন্থে আকাইদশাস্ত্রের তিনটি আলোচ্য বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও আকাইদের আলোচ্য বিষয় সম্বন্ধে আরো কিছু স্বতন্ত্র বক্তব্য পাওয়া যায়। যেমন-
১. ওলামায়ে মুতাকাদ্দিমীনের বক্তব্য : তারা বলেন- ইলমুল আকাইদের আলোচ্য বিষয় হলো, আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলি এভাবে যে, ঐগুলো বাস্তব, অনাদি ও অনন্ত। আর তার সাথে আকাইদে দীনিয়াকে সাব্যস্তকারী নিকটতম ও দূরবর্তী বিষয়গুলোও সম্পৃক্ত থাকবে।
২. ওলামায়ে মুতায়াখখিরীনের বক্তব্য : তারা বলেন- এ শাস্ত্রের আলোচ্য বিষয় হলো মহান আল্লাহর সত্তা। কারণ এর মধ্যে আল্লাহ তায়ালার সত্তা ও তাঁর গুণাবলি আলোচনা করা হয়।
৩. অধিকাংশ মুসলিম বিশেষজ্ঞের বক্তব্য : তারা বলেন- জ্ঞাত সেসব বিষয়, যার সাথে দীনি আকিদাসমূহ প্রমাণ করার নিকটবর্তী বা দূরবর্তী সম্পর্ক রয়েছে।
৪. কাজী আরমুভী (র) এর বক্তব্য : মহান আল্লাহর সত্তা। কারণ এর মধ্যে আল্লাহ তায়ালার সত্তাগত গুণাবলির আলোচনা করা হয়। অর্থাৎ ইলমে আকাইদে মহান আল্লাহর যাবতীয় গুণের আলোচনা করা হয়।
৫. ইমাম গাজ্জালী (র) এর বক্তব্য : সাধারণ অস্তিত্বশীল বস্তুই হলো এর আলোচ্য বিষয়। কারণ ইসলামী আকিদা বিশ্বাসের বর্ণনা, প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠা শুধু অস্তিত্বশীল বিষয়ের সাথেই সংশ্লিষ্ট।