উপস্থাপনা ঃ
জীবিকার তাগিদে একঘেয়ে কাজ করতে করতে কর্মক্লান্ত সৈনিক যখন অবসন্ন হয়ে পড়ে, ঠিক তখনি মন চায় বেড়িয়ে আসতে খোলা প্রান্তরে। প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমিতে প্রকৃতির নির্মল আলো-বাতাস বুক ভরে পান করলে দূর হয় ক্লান্তি, সতেজ হয় মন, ফিরে আসে মনে কর্মস্পৃহা। শ্যামলিমা প্রকৃতির জাদুর স্পর্শে দূর হয় বিরক্তি, অস্থিরতা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রকৃতির কোলে বর্তমানে গড়ে উঠেছে নয়নাভিরাম পর্যটন শিল্প ।
বাংলাদেশও এ শিল্পে বিশেষ মনোনিবেশ করেছে। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে সৃষ্টি হয়েছে উন্নত যোগাযোগ, প্রচার মাধ্যমগুলোর সাহায্যে ভ্রমণপ্রিয় মানুষের কানে পৌঁছে যায় নয়নাভিরাম মনোমুগ্ধকর স্থানগুলোর খবর । এ সকল স্থান পরিদর্শনের জন্য পৃথিবীর একস্থান থেকে অন্য স্থানে ছুটে আসছে ভ্রমণপ্রিয় জনগণ। এ সকল মানুষকে আশ্রয় করেই গড়ে উঠেছে পর্যটন শিল্প ।
আরও পড়ুন :- বাংলা রচনা: বাংলাদেশের কৃষক [ Class - 6, 7, 8 ,9 ,10]
পর্যটন শিল্প ও পর্যটকের পরিচয় :
পর্যটন শব্দের আভিধানিক অর্থ হল ভ্রমণ। ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যে সকল শিল্প গড়ে ওঠে তাকে পর্যটন শিল্প বলে। পর্যটক শব্দের অর্থ ভ্রমণকারী । মানুষ যেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে সেখান থেকে অন্য কোন স্থানের উদ্দেশ্যে সাময়িক প্রবাহ বা গমনাগমনকে পর্যটন বলে। পর্যটকদের সেবা নিশ্চিত করার জন্য গড়ে ওঠে পর্যটন শিল্প ।
বিশ্ব পর্যটন সংস্থার সংজ্ঞানুসারে একজন পর্যটক হলেন অস্থায়ী পরিব্রাজক যিনি নিম্নোক্ত কারণে বা কোন উদ্দেশ্যে কোন স্থানে বা কোন দেশে কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টার জন্য অবস্থান করেন, যেমন : ক. অবসর কাটানো । খ. পারিবারিক উদ্দেশ্যে । গ. সম্মেলন বা মিশনারিজ কাজে। ঘ. ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে।
বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের রূপ :
যে দেশে প্রবেশ করার হাজার দরজা, বের হওয়ার কোন দরজা নেই সে দেশ বাংলাদেশ। বিশ্ব পর্যটক ইবনে বতুতা ও হিউয়েন সাং-এর মত বিশ্ব পর্যটক এদেশ দেখে বলেছিলেন, এমন মনোমুগ্ধকর মায়াময় হাতছানি পৃথিবীর আর কোথাও দেখিনি। যুগ যুগ ধরে চির সবুজ, আর স্বপ্নের দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে বাংলাদেশ। প্রকৃতির সৌন্দর্যের লীলাভূমি এদেশ । নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর দেশ বাংলাদেশ।
আরও পড়ুন :- বাংলাদেশের জাতীয় ফুল রচনা : শাপলা - ক্লাস ৬, ৭, ৮, ৯, ১০
বিশ্ব পর্যটকদের আকর্ষণ করার মত অনেক সম্পদ রয়েছে। যেমন :
ক. প্রাকৃতিক আকর্ষণ : ১. পাহাড়-পর্বত, ২. সমুদ্র সৈকত, ৩. নদ-নদী, জলাভূমি, ৪. বন্যপ্রাণী ও বনভূমি ।
খ. প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন : ১. পাহাড়পুর, ২. মহাস্থানগড়, ৩. ময়নামতি ।
গ. স্থানীয় কুটির শিল্পের পণ্য : ১. বিভিন্ন প্রকার শিল্পজাত দ্রব্য, ২. আঞ্চলিক গান, নাচ ইত্যাদি । ৩. উপজাতীয়দের জীবনধারা।
ঘ. ধর্মীয় নিদর্শন : ১. মসজিদ, মাজার, ২. মন্দির, প্যাগোডা, গীর্জা ইত্যাদি ।
প্রাকৃতিক নিদর্শন হিসেবে আছে বিস্তীর্ণ পাহাড়-পর্বত। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে এ সকল পাহাড়-পর্বত অবস্থিত। সমগ্র পাবর্ত্য চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা জেলার অংশবিশেষে এ সকল পাহাড় অবস্থিত। পাহাড়ের নয়নাভিরাম দৃশ্য সবার মন কেড়ে নেয় । এদেশে সর্ববৃহৎ পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত ঘিরে । প্রায় পঁচাশি মাইল বিস্তৃত এ সমুদ্র সৈকত ।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ছাড়াও রয়েছ সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার স্থান কুয়াকাটা। আছে বিস্তীর্ণ বনভূমি, বন-বনানীর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য । সুন্দরবন তেমন একটি পর্যটন কেন্দ্র। নানা প্রকার পশু পাখির কলকাকলিতে মুখরিত এ সকল অঞ্চল। নদ-নদীর দেশ বাংলাদেশ। এদেশের যে কোন নদীর দু'তীর দেখলেই মন ভরে যায়। সবুজের কোণ ঘেঁষে এসকল নদ-নদী দুরন্ত বেগে ছুটে চলেছে আপন ঠিকানায় ।
মহাস্থানগড় পাহাড়পুর আর কুমিল্লার ময়নামতিতে আছে প্রত্নতাত্ত্বিক পর্যটন শিল্প । এসকল স্থানের হাজার বছর পূর্বের কারুকাজ দেখে মন ভরে যায় । বাংলাদেশের চাষী, জেলে, রাখাল, কামার, কুমারের জীবনধারা নিয়েও গড়ে উঠেছে পর্যটন শিল্প । এ ছাড়া সকল সাধারণ মানুষ বাদে পাহাড়ী উপজাতিদের ধর্মীয় আচার-আচরণ, সামাজিক রীতিনীতি ও মন কাড়বে সকল পর্যটকদের।
আরও পড়ুন :- বাংলা রচনা - বাংলাদেশের ঋতু বৈচিত্র্য [ Class 6, 7, 8. 9, 10 ]
তাদের জীবনধারা নিয়েও গড়ে উঠেছে পর্যটন শিল্প। এদেশের অনেক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, যেমন- কারুকাজ খচিত মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা ইত্যাদিকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে পর্যটন শিল্প । যেমন- খুলনার ৬০ গম্বুজ মসজিদ, কক্সবাজারের প্যাগোডা দর্শনীয় স্থান ।
বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের সমস্যা :
অসংখ্য বেকারের কর্মস্থানের সুযোগ আছে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে । এ শিল্পকে প্রসারের জন্য মূলধন হচ্ছে জাতির মানসিক গঠন, সেবাদানের উপযুক্ত দক্ষ জনগোষ্ঠী। পর্যটনের মৌলিক তিনটি সমস্যা হল : ১. পর্যটক আকর্ষণ, ২. পরিবহনের সমস্যা, ৩. খাদ্য ও বাসস্থানের সমস্যা।
উল্লিখিত সমস্যার মূলে রয়েছে আরও অনেক সমস্যা। সেগুলো নিম্নরূপ :
ক. রাজনৈতিক সমস্যা : অস্থিরতা, মিটিং, মিছিল, হরতাল ইত্যাদি।
খ. সামাজিক সমস্যা : পর্যটকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ।
গ. উপকরণের অভাব : হোটেলের অপ্রতুলতা, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা শুল্কমুক্ত বিপণীর অভাব, দুর্বল পরিবহন ব্যবস্থা।
ঘ. বিপণন সমস্যা : প্রচার ব্যবস্থার ত্রুটি, সঠিক তথ্যের অভাব, উপস্থাপনার দুর্বলতা ।
প্রশাসনিক সমস্যা : অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর দুর্ব্যবহার, প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যটকদের সহায়তার অভাব ।
উপসংহার :
বাংলাদেশ পর্যটনের কেন্দ্রবিন্দু । এখানে পর্যটকদের আকর্ষণের অনেক উপাদান ছড়িয়ে আছে। তাই এখানে পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা প্রচুর । বিরাজমান সমস্যার সমাধান করতে পারলে পর্যটন শিল্পের আয় দিয়ে বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব হত।
আপনার পছন্দ হতে পারে এমন আরও পোস্টের তালিকা