(toc) Table Of Contens
উপস্থাপনা :
বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে পরিবর্তিত হচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন জীবন, আমাদের আধুনিকতা ও আমাদের চিন্তাচেতনা । এমনকি বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে জীবনকে গতিময়।
বিজ্ঞানের সংজ্ঞা :
‘বিজ্ঞান' শব্দের অর্থ বিশেষ জ্ঞান। মানুষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যে বিশেষ জ্ঞানের সন্ধান পেয়েছে, তাকে বলা হয় বিজ্ঞান। বর্তমান সভ্যতা ও সমৃদ্ধি মানুষের দীর্ঘকালীন সংগ্রামের ইতিহাস। প্রকৃতির সীমাহীন বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে মানুষ স্বীয় প্রতিভাবলে প্রকৃতিকে জয় করার কৌশল আবিষ্কার করেছে। মানুষ চিরকাল সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে প্রশস্ত পরিসরে নিজেকে প্রকাশ করতে ব্যাকুল। এই প্রকাশের জন্যই প্রয়োজন বিশেষ জ্ঞানের বা বিজ্ঞানের।
দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান :
দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। বিজ্ঞানের মাধ্যমে মানুষ গোটা বিশ্ব তথা প্রকৃতিকে নিজের হাতের মুঠোয় বন্দি করে রেখেছে। মানুষের মনের সকল ইচ্ছা পূরণ করে দিচ্ছে বিজ্ঞান। প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞান দিয়েছে অপরিমিত সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্য। সকাল থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারাদিনের কর্মপ্রবাহে আমরা বিজ্ঞান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি। টুথপেস্ট থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য।
প্রাচীন যুগে বিজ্ঞান :
প্যাপিরাস জাতীয় নলখাগড়া থেকে মিসরের মানুষ প্রথম লেখার উপযোগী কাগজ বানায়। ইরাক অঞ্চলের মানুষেরা প্রথম চাকাযুক্ত গাড়ি বানিয়ে পরিবহন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যুগান্তর আনে। কয়েক হাজার বছর আগে চীনের বিজ্ঞানীরা অতি দ্রুত যান্ত্রিক পদ্ধতিতে যোগ- বিয়োগ করার উপযোগী গণকযন্ত্র বা 'আবাকাস' তৈরি করেন। অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ক্লক' প্রথম তৈরি করেছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার বিজ্ঞানীরা আজ থেকে দু'হাজার বছরেরও আগে।
জল তোলার উপযোগী বিশেষ ধরনের পাম্প এবং যন্ত্রচালিত ঘড়ি প্রথম আবিষ্কৃত হয় চীনদেশে। প্রথম ছাপাখানা এবং কম্পাস যন্ত্র ঐ দেশেরই আবিষ্কার। এ সমস্তই ঘটেছিল খ্রিষ্টজন্মের আগে। গ্রিসের মানুষেরা প্রথম পৃথিবী ও মহাকাশের মানচিত্র বানায়। প্রাণিবিদ্যার ক্ষেত্রে, চিকিৎসাশাস্ত্র, স্থাপত্যবিদ্যা এবং জ্যামিতির ক্ষেত্রে গ্রিক বিজ্ঞানীদের অবদান বড় কম ছিল না।
আধুনিক যুগে বিজ্ঞান :
প্রতিদিন বিজ্ঞান :
আজকের দিনে সম্ভবত একটা মূহূর্তও বিজ্ঞানের সাহায্য ছাড়া অচল। আমাদের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট তথা প্রতিটি স্থানই বৈদ্যুতিক আলোয় উজ্জ্বল হয়ে আছে। রেডিও, টেলিভিশন, টেলিফোন, বৈদ্যুতিক পাখা, বিভিন্ন যানবাহনসহ দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি জিনিসই বিজ্ঞানের দান । বিজ্ঞানের সাহায্য ছাড়া কৃষিকাজে, শিল্পায়নে, যোগাযোগ ব্যবস্থার সাফল্যের কথা ভাবাই যায় না।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান:
চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান অনন্য। রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজ্ঞান আমাদের জীবনকে রোগ যন্ত্রণা ও ব্যাধির আশঙ্কামুক্ত করে তুলেছে। চিকিৎসকগণ রোগ নিরাময়ে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, ঔষধ প্রয়োগ করে ব্যাধিকে নির্মূল ও নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে হাসপাতালসমূহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া চলতে পারে না।
এক্স-রে, আলট্রাভায়োলেট-রে, আলট্রাসনোগ্রাফি, রেডিও থেরাপি প্রভৃতি অত্যাধুিনক যন্ত্রপাতির ব্যবহার এখন আর নতুন কিছু নয়। প্যাথোলজি, রেডিওলজি, সার্জারি, নিওরো সার্জারি, অর্থোপেডিক প্রভৃতি তো অনেক আগের ঘটনা ।
প্রাত্যাহিক জীবনে বিজ্ঞানের ইঞ্জিনিয়ারিং কলাকৌশল :
বিজ্ঞানে একটি শাখা কারিগরি বিজ্ঞান বা ইঞ্জিনিয়ারিং। দৈনন্দিন জীবনে ইঞ্জিনিয়ারিং কলা-কৌশলের প্রভাবও অপরিসীম । সভ্যতার উন্নতি ও বিকাশে এর অবদান বিস্ময়কর। ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যার সাহায্যে অসম্ভবকে সম্ভব করা হচ্ছে। অকল্পনীয়কে বাস্তবে রূপ দেয়া হচ্ছে। খরস্রোতা বা প্রমত্তা যে নদীকে দেখে মানুষ একদিন ভয় পেত, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বদৌলতে সে নদীতে আজ বাঁধ দেয়া হচ্ছে।
নদীর জলধারাকে আটক করে তা থেকে খালকেটে জলসেচের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এছাড়া অতি অল্প খরচে জলবিদ্যুৎ উৎপন্ন হওয়ায় সমাজ ও সভ্যতা নানাভাবে উপকৃত হচ্ছে। ঐ বিদ্যুৎ শক্তি থেকে লক্ষ লক্ষ ঘরে আলো জ্বলছে আজ । হাজার হাজার কল-কারখানয় স্বল্প ব্যয়ে উৎপাদন চলছে ও বড় বড় সেতু নির্মাণ, পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণ করছে, নির্মাণ করছে সুরঙ্গের মধ্য দিয়ে রাস্তা। খরস্রোতা নদী, দুর্গম বনপথ ও ভয়ঙ্কর মরুপ্রান্তরকে যেন অবলীলাক্রমে অতিক্রম করছে মানুষ।
বড় বড় নদী ও সমুদ্রের মধ্যে সেতু তৈরি করে প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তার করছে। এমনকি ঊষর মরুভূমিতে ফসল ফলিয়ে কারিগরি বিজ্ঞান আজ অসাধ্য সাধন করছে। গৃহনির্মাণে, পথঘাট তৈরি, সেতু-গড়া ইত্যাদি ক্ষেত্রেও নবযুগ সূচিত হয়েছে । মানুষ অতি অল্প সময়ের মধ্যে গগনচুম্বী অট্টালিকা নির্মাণ করছে। সেখানে মানুষকে আরামে ও আনন্দে রাখার কি বিপুল আয়োজন। এগুলো বাদ দিলে আমাদের প্রতিদিনের স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহই মনে হয় রুদ্ধ হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন :- কম্পিউটার : বাংলা প্রবন্ধ রচনা - Class 8, 9 এবং SSC | PDF
শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান :
বিজ্ঞানের কারণে পাঠ্যপুস্তক সহজ লভ্য হয়েছে। লেখনী, কাগজ, সংবাদপত্র ও পুস্তকরাজি এসবই বিজ্ঞানের অবদান। ছাত্রসমাজের পরম বন্ধু বিজ্ঞান তাদের লেখার কাগজ বহন করে আনছে রেল-স্টিমারে, বই ছাপা হচ্ছে ছাপাখানায় বিদ্যুতের সাহায্যে। ক্লাস ঘরে মাথার ওপর পাখা ঘুরছে। অন্ধ শিক্ষার্থীদের জন্য হয়েছে ব্রেইল পদ্ধতির আবিষ্কার। এমনকি প্রতিবন্ধীদের জন্য বিজ্ঞান করেছে নানা ব্যবস্থা।
গ্রামীণ জীবনে বিজ্ঞান :
গ্রামাঞ্চলের মানুষ সাইকেল, মটরগাড়ি, ট্রেন, স্টিমার, লঞ্চ, টর্চ লাইট প্রভৃতির ব্যবহার প্রতিনিয়ত করে চলেছে, যা বিজ্ঞানের অবদান। বর্তমানে আমাদের গ্রামগুলোতে দিন দিন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে। পল্লীবিদ্যুৎ সংস্থার উদ্যোগে দ্রুত বিদ্যুতায়ন চলছে গ্রামে-গঞ্জে। উন্নত চাষাবাদ, শিল্পায়ন, বিনোদন ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় আমাদের পল্লীগুলো বিজ্ঞানের কল্যাণেই সব সুবিধা লাভ করতে শুরু করেছে।
বিজ্ঞানের বিরূপ ফল :
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের কিছু বিরূপ ফলও দেখা যায়। বিজ্ঞানের কল্যাণে ব্যাপক শিল্পায়ন হওয়ায় কলকারখানার শ্রমিকদেরকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে এবং বস্তি জীবনযাপন করতে হচ্ছে। কলকারখানার বর্জ্যসমূহ নানাভাবে পরিবেশ দূষিত করে তুলছে, ফলে মানুষের সাধারণত স্বাস্থ্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পরিবেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । যুদ্ধকালীন মারণাস্ত্রের ব্যবহার হাজার হাজার মানুষের জীবন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন করেছে । বিভিন্ন দেশ একে অপরের দিকে বিভিন্ন মারণাস্ত্র তাক করে আছে।
বিজ্ঞান এবং অত্যাধুনিকতা :
শৌখিন ব্যবহার :
আমাদের ঘরে যে ইলেকট্রিক পাখা চলছে, বিজ্ঞানের অবদান না থাকলে তা কি আমরা পেতাম? কারও কারও ঘরে রয়েছে এয়ারকুলার। বলাবাহুল্য সেটিও দিয়েছে বিজ্ঞান। রেডিও, টেলিভিশন, ফ্রিজ, কম্পিউটার এগুলোও আজ আমাদের নিত্যসঙ্গী। রেডিও আমরা পেয়েছি অনেকদিন আগেই। পরে এসেছে টেলিভিশন এবং রেফ্রিজারেটার। টেলিভিশন প্রতিদিন আমাদের চোখকে, আমাদের দৃষ্টিকে নন্দিত করছে।
শুধু থিয়েটার-সিনেমা নয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন তথ্যচিত্র সে পৌঁছে দিচ্ছে আমাদের ঘরে। আমরা বিছানায় বসেই দেখতে পাই আফ্রিকার জঙ্গল। রেফ্রিজারেটর আমাদের সাংসারিক প্রয়োজনে বড়ই জরুরি। শাক-সবজি, মাছ, ডিম থেকে আরম্ভ করে ওষুধপত্র প্রভৃতি নিত্য প্রয়োজনীয় সাংসারিক দ্রব্যকে সতেজ রাখছে এ যন্ত্রটি। আমাদের রান্না করা খাবারও রেখে দেওয়া হয় এর ভেতর। তাতে বাঁচে আমাদের বাড়তি শ্রম সাশ্রয় হয় জ্বালানি। কম্পিউটার বিশ্বকে এনে দিয়েছে হাতের মুঠোয়।
জীবনের নানা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান :
মোটরগাড়ি, মোটর সাইকেল ইত্যাদি আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনকে করেছে সহজ ও গতিময়। আমরা যে দু চাকার সাইকেল ব্যবহার করছি এটিও বিজ্ঞানের দান। আমরা যে পাকা রাস্তা বানিয়েছি তার ভেতরেও কাজ করছে বিজ্ঞানের কারিগরি জ্ঞান। টেলিফোন-টেলিগ্রাফ আজ আমাদের প্রতিদিনের প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী।
আমরা ঘরে বসে যে প্রতিদিন দূর-দূরান্তের চিঠিপত্র পাই, তা সম্ভব হতো না যদি না আমরা বিজ্ঞানের সাহায্য পেতাম। এই যে আমরা প্রতিদিন নানা কাজে সর্বদা কলম দিয়ে লিখি তাও সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানের সহায়তায়। সিনেমা, থিয়েটার, চিত্র-স্থাপত্য-ভাস্কর্য ইত্যাদি তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণে বহু বৈজ্ঞানিক উপকরণ ব্যবহার করে চলেছি আমরা নীরবে।