উপস্থাপনা :
জীবন আপনা-আপনি বিকশিত হয় না। তাকে বিকাশের পথে পরিচালিত করতে হয়। সেখানে অধ্যবসায়ের মতো মহৎ বৈশিষ্ট্য আরোপিত হলে জীবন সুন্দর ও সার্থক হয়ে ওঠে। অনেক গুণের সমাবেশে মানুষের যে সুন্দর চরিত্র গড়ে ওঠে তার পিছনে ভূমিকা পালন করে অধ্যবসায়। মানবসন্তান জন্মগ্রহণ করেই মানুষ হয় না। তার জন্য প্রয়োজন মনুষ্যত্ববোধের। অধ্যবসায় জীবনের গৌরবময় লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য কাজ করে।
অধ্যবসায়ের পরিচয় :
কোন কাজে সফলতা লাভের জন্য বারবার চেষ্টা করার নাম অধ্যবসায়। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে কাজে আত্মনিয়োগ করার সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রের অনন্য গুণ যখন কাজে লাগানো হয় তখনই অধ্যবসায়ের পরিচয় পাওয়া যায়।
অধ্যবসায় কী :
অধ্যবসায় হচ্ছে কতিপয় গুণের সমষ্টি। চেষ্টা, উদ্যোগ, আন্তরিকতা, পরিশ্রম, ধৈর্য ইত্যাদি গুণের সমন্বয়ে অধ্যবসায় পরিপূর্ণতা লাভ করে । কোন কাজে ব্যর্থ হওয়ার পরও সফলতার জন্য পুনঃ পুনঃ চেষ্টা করার নামই অধ্যবসায়। তাছাড়া মনের আস্থা ও বিশ্বাসকে বাস্তবে রূপদানের জন্য সুদৃঢ় সংকল্প নিয়ে চেষ্টার পুনরাবৃত্তিকেও অধ্যবসায় বলা হয় ।
অধ্যবসায়ের প্রথম ধাপ :
পৃথিবীতে যে কোনো কাজে প্রথম উদ্যোগে সাফল্য লাভ করা সহজ নয়। যে মানুষ কাজের প্রথম উদ্যোগে সাফল্য লাভের আশায় ব্যর্থ হয়ে নিজেকে অসহায় মনে করে কাজ ছেড়ে দেয়, সে জীবনে কখনো উন্নতি লাভ করতে পারে না। অধ্যবসায়ী হতে না পারলে জীবনে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উপনীত হওয়া যায় না। পৃথিবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ইতিহাস পড়লে জানা যায়, তাদের অনেকেই প্রথম উদ্যোগেই কোনো কাজে সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। এজন্য বারবার বিভিন্ন কৌশলে, নতুন আঙ্গিকে চেষ্টা করতে হয়েছে।
অধ্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য :
অবিরাম সাধনা, ক্রমাগত প্রচেষ্টা আর সুদৃঢ় প্রত্যয়ের নামই অধ্যবসায়। অথবা বলা যায়, সাফল্য অর্জনের জন্য ক্রমাগত সাধনাই অধ্যবসায়। অধ্যবসায় মানব চরিত্রের একটি গুণ—অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সঙ্গে রয়েছে উদ্যোগ, পরিশ্রম এবং আন্তরিকতা ইত্যাদি। মনের দৃঢ়সংকল্প নিয়ে, উৎসাহে উদ্দীপ্ত হয়ে, নিরলস সাধনার মাধ্যমে সফলতার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে আত্মনিয়োগ করলেই অধ্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়।
জীবনে বাধাকে অতিক্রম করার সাধনাই হলো অধ্যবসায়। আলস্য পরিহার করে দৃঢ় প্রত্যয়ে নিরন্তর সাধনাই অধ্যবসায়। অধ্যবসায় জীবনকে আশাবাদী করে তোলে—জীবনকে অর্থবহ করে। ‘একবার না পারিলে দেখ শতবার’, এখানেই অধ্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।
আরও পড়ুন : সময়ের মূল্য – বাংলা রচনা ২০ পয়েন্ট [ সাথে PDF ২টি ]
অধ্যবসায়ের গুরুত্ব :
অধ্যবসায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনের হাজারও কাজকর্মে সফলতা লাভের জন্য অধ্যবসায় আবশ্যক। জীবনে অতি সহজে কোনো কিছু লাভ করা যায় না। আকাঙ্ক্ষা আর সামর্থ্যের সংগতি অনেক সময় জীবনে দেখা যায় না। বরং অনেক প্রতিবন্ধকতা জীবন বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিধা, সংকোচ, লোকলজ্জা, অক্ষমতা, অলসতা ইত্যাদি জীবনে সাফল্যের বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়াও রয়েছে বাইরের চাপ, ভেতরের অনীহা ইত্যাদি।
অথচ জীবনকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে কাজে, সাফল্য আনতে হবে কর্মে তবেই জীবনের ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জিত হবে। অধ্যবসায় এসব বাধা-বিঘ্ন দূর করে, সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করার প্রেরণা যোগায়। অধ্যবসায়ের মাধ্যমে মানুষ শক্তির সন্ধান পায়, সাফল্যের পথ দেখে আর নিজেকে যোগ্যতর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
ছাত্রজীবনে অধ্যবসায় :
আজকের ছাত্ররাই আগামীদিনে জাতিকে নেতৃত্ব দেবে। সুতরাং ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। অলস ও শ্রমবিমুখ ছাত্র-ছাত্রীরা জীবনে কখনো বিদ্যার্জন করতে পারে না। অধ্যবসায়ী ছাত্র-ছাত্রীরা অল্প মেধাসম্পন্ন হলেও সফলতা লাভ করতে পারে। কোনো ছাত্র যদি প্রথম বা দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় অকৃতকার্য হয়ে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকে, তবে সে আর সফলতা অর্জন করতে পারে না। কোনো ছাত্রকে একবার বিফল হয়ে বসে থাকলে চলবে না, তাকে দ্বিগুণ উৎসাহে পুনরায় চেষ্টা করতে হবে।
ব্যক্তিজীবনে অধ্যবসায় :
অধ্যবসায় জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলে সেখানে সফলতা নিশ্চিত। মানুষ সারাজীবন চলে সাধনার পথে। মানুষ পৃথিবীতে যখন আসে তখন সে অত্যন্ত দুর্বল থাকে। কিন্তু সাধনার মাধ্যমে তাকে যথার্থ যোগ্যতার পরিচয় দেয়। জীবনের লক্ষ্য অর্জন করার জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত সাধনা। সংসারে সুখ অর্জন করতে হয়। অলস মানসিকতা এবং দুর্বল হাতে তা অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই মানুষকে অধ্যবসায়ী হতে হয়।
অধ্যবসায়ের মাধ্যমে মানুষ স্বনির্ভর হয়। বলিষ্ঠ সাধনার মাধ্যমে মানুষ সুখের সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পারে। জীবনকে আদর্শ হিসেবে গড়ে তোলা যায় এই মহৎ গুণের সাহায্যে। বড় হওয়ার সাধনায় অধ্যবসায় একান্ত প্রয়োজনীয়। ধনে, মানে, অবদানে ব্যক্তিগতভাবে মহিমান্বিত হতে হলে অধ্যবসায়ী হতে হবে। অধ্যবসায়কে জীবনের মূলমন্ত্র করতে হবে। তবেই জীবন সাফল্যে মহিমান্বিত হয়ে উঠবে।
জাতীয় জীবনে অধ্যবসায় :
অধ্যবসায়ের মহৎ গুণে জাতীয় জীবন মর্যাদাবান হয়ে ওঠে। প্রতিটি মানুষ অধ্যবসায়ী হলে জাতীয় জীবনে উন্নয়ন সম্ভব। আর সে জাতি তখন সুনাম ও গৌরবের অধিকারী হবে। যে জাতি যতবেশি অধ্যবসায়ী সে জাতি তত বেশি গৌরবের অধিকারী। জাতির জ্ঞানী-গুণী, শ্রেষ্ঠ বীর, আবিষ্কারক, সমাজ সংস্কারক, রাষ্ট্রনায়ক, শিল্পী, সাহিত্যিক সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সীমাহীন সাধনার মাধ্যমে সফল হয়ে গৌরব লাভ করেছেন।
বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের গৌরবদীপ্ত সাফল্য অধ্যবসায়ের ফল। খুব সাধারণ অবস্থা হতে যারা জীবনের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছেন এমন মহৎ মানুষের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- অধ্যবসায়ই তাঁদের সাফল্যের মূলমন্ত্র। তাই জাতীয় জীবনে সাফল্য ও গৌরব আনয়নের জন্য সকল মানুষকে অধ্যবসায়ী হতে হবে।
আরও পড়ুন : অধ্যবসায় – বাংলা রচনা ১০ পয়েন্ট – [ PDF ৪টি রচনা ]
কর্মজীবনে অধ্যবসায় :
সবার মেধা ও যোগ্যতা এক মাপের নয় । কিন্তু একনিষ্ঠ চেষ্টার মাধ্যমে সবার পক্ষে কর্মজীবনে উন্নতি করা সম্ভব। আসলে কঠোর পরিশ্রম ও সাধনা ছাড়া কোনো কাজেই সফলতা আসে না। অধ্যবসায়ের মাধ্যমে মেধারও উন্নতি হতে পারে। আবার অনেক সময় প্রতিভা থাকলেও ধৈর্য তথা অধ্যবসায়ের অভাবে লোকে ব্যর্থ হয় ।
অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা :
জীবনের সর্বক্ষেত্রে অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ছাত্রজীবনে এ অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। অধ্যবসায় ছাড়া কোনো কঠিন কাজে সফলতা লাভ করা যায় না। কাজ করতে গেলে নানারকম বাধাবিপত্তির মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু বাধাবিপত্তিকে ভয় পেয়ে কাজ থেকে বিরত থাকলে উন্নতির আশা করা যায় না। কোনো কাজে একবার অকৃতকার্য হলেও বসে থাকতে নেই। অব্যাহত গতিতে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। চেষ্টায় সাফল্য আসে। জীবনের এ চলার পথ সহজ করার জন্য অধ্যবসায়ের প্রয়োজন।
অধ্যবসায়ের সফল দৃষ্টান্ত :
জীবন-সংগ্রামে সফলতার মূলমন্ত্র হলো অধ্যবসায়। স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস এর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি ইংল্যান্ডের রাজা এডওয়ার্ডের সঙ্গে ছয়বার যুদ্ধে পরাজিত হয়েও প্রতিজ্ঞা থেকে সরে দাঁড়াননি। পরপর ছয়বার পরাজিত হয়ে যখন একটা গুহায় চিন্তামগ্ন ছিলেন, তখন তিনি দেখলেন একটা মাকড়সা ছয়বার ব্যর্থ হয়েও সপ্তমবারে জাল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সপ্তমবারের যুদ্ধে ইংল্যান্ডের রাজাকে পরাজিত করে নিজের দেশ উদ্ধার করতে সক্ষম হলেন। তাঁর এ সাফল্যের মূলে আছে অধ্যবসায়।
অধ্যবসায়ীর জীবনাদর্শ :
জীবন সংগ্রামে সাফল্য লাভের মূলমন্ত্র অধ্যবসায়। রাজা রবার্ট ব্রুস ছয়বার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সপ্তম বারের চেষ্টায় জয়লাভ করেছিল। অর্ধ-পৃথিবীর অধীশ্বর নেপোলিয়ন তাঁর জীবনের কার্যকলাপের জন্য রেখে গিয়েছেন অধ্যবসায়ের অপূর্ব নিদর্শন।
কোনো কাজকে তিনি অসম্ভব বলে মনে করতেন না। তাই তিনি একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও ফরাসি জাতির ভাগ্যবিধাতা হতে পেরেছিলেন। শুধু অধ্যবসায়ের বলেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, জগদীশচন্দ্র বসু ও নজরুল ইসলাম বিশ্ববিখ্যাত হতে পেরেছিলেন।
আরও পড়ুন : স্বদেশ প্রেম – রচনা : [ ২০ পয়েন্ট ]
অধ্যবসায় ও প্রতিভা :
অসাধারণ প্রতিভা ছাড়া কোন কঠিন কাজে সফলতা সম্ভব নয় বলে অনেকের ধারণা। কিন্তু নিরলস পরিশ্রম ও অধ্যবসায় ছাড়া শুধু প্রতিভার দ্বারা কোন কাজে সাফল্য অর্জন করা যায় না। এ প্রসঙ্গে বৈজ্ঞানিক নিউটন বলেছেন, “আমার আবিষ্কারের কারণ প্রতিভা নয়, বহু বছরের চিন্তাশীলতা ও পরিশ্রমের ফলে দুরুহ তত্ত্বগুলোর রহস্য আমি ধরতে পেরেছি।”
মানব সভ্যতায় অধ্যবসায় :
একসময় আমাদের মতো মানুষকে বর্বর অসভ্য বলা হতো। আমাদের সৌভাগ্য, আমরা আধুনিক সভ্যতার যুগের অধিবাসী। সে অসভ্য বর্বর জাতি থেকে সভ্য হতে আমাদের অনেক যুগ লেগে গেছে। এ দীর্ঘ যুগ-পরিক্রমায় মানুষ বসে থাকেনি। চেষ্টা করেছে এ পর্যায়ে আসার জন্য। সফল হয়েছে তাদের প্রচেষ্টা। মানবজাতিকে উপহার দিয়েছে এক স্বর্ণযুগ।
অধ্যবসায় ও সাফল্য:
অধ্যবসায় ও সাফল্য মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। কারণ যেখানে অধ্যবসায়, সেখানেই সাফল্য। অধ্যবসায় ছাড়া সাফল্য সম্ভব নয়। ব্যর্থতায় নিরাশ না হয়ে যারা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন, তারা স্বক্ষেত্রে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন।
জাতীয় জীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব :
জাতীয় জীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। কোনো জাতিকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সেই জাতির প্রতিটি নাগরিককে অধ্যবসায়ী হতে হবে। জাতির স্বার্থে সবাই যদি একনিষ্ঠভাবে ও সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করে, তবেই সে জাতি বিশ্বে মর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারবে। অবশ্য ব্যক্তিজীবনে অধ্যবসায়ের ফল জাতীয় জীবনের বৃহত্তম কল্যাণে আসে। বিশ্বের জ্ঞানী, মনীষী, আবিষ্কারক, ধর্মপ্রবর্তক, রাষ্ট্রনায়ক, কবি-সাহিত্যিক, সমাজ-সংস্কারক সকলেই অধ্যবসায়ের মাধ্যমে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। একেবারেই ক্ষুদ্র অবস্থা থেকে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জনের পেছনে অধ্যবসায় কেমন কাজ করেছে তার নিদর্শন বিশ্বের বহু মনীষীর জীবনে বিদ্যমান। ব্যক্তি, জাতি এবং বিশ্বের কল্যাণসাধনের জন্য অধ্যবসায় খুবই প্রয়োজন।
অধ্যবসায়হীন মানুষের অবস্থা :
যাদের জীবনে অধ্যবসায় নেই, তাদের জীবন ব্যর্থতায় পূর্ণ। শত শত মানুষের জীবন অধ্যবসায়ের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। পৃথিবীতে কোনো কাজই সহজ নয়। যেকোনো কাজ প্রাথমিক অবস্থায় কঠিন মনে হয়। কর্মক্ষেত্রে নানা প্রকার বাধাবিপত্তি আসবেই। দৃঢ় সংকল্প নিয়ে কাজে অগ্রসর হলে হাজারও বাধা অতিক্রম করা সম্ভব। অধ্যবসায়হীন মানুষ জীবনে সাফল্য লাভ করতে ব্যর্থ হয়। এক সময় তাদের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যায়। একমাত্র অধ্যবসায়ের গুণেই মানুষ পৃথিবীতে অমরত্ব লাভ করতে পারে।
অধ্যবসায়ের প্রতিবন্ধকতা :
অধ্যবসায়ের মূল প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে আলস্য। এছাড়াও সৎসাহস ও মনোসংযোগের অভাব অধ্যবসায়ের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে । আলস্য, সৎসাহস ও মনোসংযোগের অভাবে মানুষ সাধনায় নিমগ্ন হতে পারে না অধ্যবসায়ের ক্ষেত্রে ইচ্ছাশক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । কেননা ইচ্ছা থাকলেই কোনো না কোনো উপায় বের হয়ে আসে। কেবল ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমেই মানুষ প্রতিকূল পরিবেশকে অনুকূলে আনতে পারে ।
অধ্যবসায়ই সাফল্যের চাবিকাঠি :
যেকোনো কাজে সফলতা অর্জনের জন্য চাই অধ্যবসায় । অধ্যবসায় ছাড়া কোনো কাজে সফল হওয়া যায় না । ইতিহাসের পাতায় যারা আজও অমর হয়ে আছেন, তারা অধ্যবসায়ের মাধ্যমেই সফল হতে পেরেছিলেন । তারা ব্যর্থতাকে জয় করে কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়কেই জীবনের একমাত্র অনুষঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন । স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস ইংল্যান্ডের রাজা এডওয়ার্ডের সঙ্গে ছয়বার যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে বিষণ্ন মনে বন-জঙ্গলে ঘুরছিলেন । তখন একদিন এক গুহায় একটি মাকড়সাকে সাতবার চেষ্টা করে সুতা জড়াতে দেখে তিনি অদম্য উৎসাহ নিয়ে সপ্তমবারের মতো শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেন । আবার মহাকবি ফেরদৌসী দীর্ঘ তিরিশ বছর সাধনা করে রচনা করেন অমর মহাকাব্য ‘শাহানামা’ । তাই বলা যায়, একমাত্র অধ্যবসায়ই মানবজীবনে সোনালি অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে এবং অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে ।
বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অধ্যবসায়ের ভূমিকা:
অধ্যবসায়ের উজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে পৃথিবীর প্রতিটি বৈজ্ঞানিকের আবিষ্কারের পেছনে । মানুষ রকেটের সাহায্যে অর্জন করেছে চন্দ্রবিজয়ের গৌরব, বিমান আবিষ্কার করে জয় করেছে আকাশ, বিদ্যুৎ আবিষ্কার করে দূর করেছে আঁধার, আর টেলিফোন এবং মোবাইল ফোন আবিষ্কার করে যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ বিশ্বকে নিয়ে এসেছে হাতের মুঠোয়। মানুষের যুগ-যুগান্তরের সাধনা কাজ করেছে এসব সাফল্যের পেছনে , তার অবিরাম অধ্যবসায়।
অধ্যবসায়হীনতার কুফল :
অধ্যবসায়ের অভাবে অনেক সম্ভাবনাময় জীবন অকালে শেষ হয়ে যায় । অধ্যবসায়হীন ব্যক্তি জগতের কোন কাজেই সফলতা লাভ করতে পারে না। তার জীবন ধ্বংস হয়, ব্যর্থ হয় । তার স্মৃতি বিস্মৃতির অতল গর্ভে হারিয়ে যায়। সামজের আস্তাকুড়ে নির্ধারিত হয় তার ঠিকানা।
অধ্যবসায়ী মহাপুরুষ :
যারা প্রেম, করুণা ও সহিষ্ণতার মাধ্যমে জাতিকে ভালবেসেছেন, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সহ্য করে কর্তব্য পালনে অটল ছিলেন তাঁরাই মহাপুরুষ । ইসলাম ধর্ম প্রচারে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) অসহনীয় নির্যাতন বার বার সহ্য করে ধর্ম প্রচার করেছেন ও অক্ষয়কীর্তি লাভ করেছেন ।
অধ্যবসায়ের অভাবে কী হয় :
সাধারণত অধ্যবসায়ের অভাবে আমরা বহু ক্ষেত্রে কৃতকার্য হতে পারি না। লক্ষ করলে দেখব, একটি শিশু বারবার চেষ্টা করে দাঁড়াতে শেখে, কথা বলতে শেখে, চলতে শেখে। পরবর্তীতে আরও অনেক কিছু চেষ্টা করে শেখে। কয়েকবার বিফল হয়ে সে যদি চেষ্টা থেকে বিরত থাকত, তবে কখনো কোনো কিছু সে শিখতে পারত না, কোনো কাজ সম্পন্ন করতে পারত না।
আরও পড়ুন : অধ্যবসায় – রচনা Class – 6, 7, 8 ,9 ,10 এবং hsc| সাথে pdf ৪টি
নেপোলিয়ানের উৎসাহ :
বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিদের উদাহরণ :
অধ্যবসায় এবং জীবনের উন্নয়ন :
আমাদের কর্মশীল দৈনন্দিন জীবনে উন্নয়ন ঘটাতে হলে অধ্যবসায়ের কোনো বিকল্প নেই। কেননা কোনো কাজ প্রথমবারেই সফল হবে, একথা কখনোই নিশ্চিত করে বলা যাবে না, আর তা আশা করাও বোকামি। একবার না পারলে বারবার চেষ্টা করা, এটাই জীবনে উন্নয়নের পথকে সুগম করে।
অধ্যবসায়ের দৃষ্টান্ত :
ক. পৃথিবীতে যেসব মহাপুরুষ জন্মলাভ করেছেন তাঁরা সবাই অধ্যবসায়ের দৃপ্ত দৃষ্টান্ত। আমাদের মহানবি (স) আপন জন্মভূমি মক্কায় ব্যর্থ হয়ে কৌশলগত কারণে মদিনায় চলে গেলেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি মক্কা জয় করলেন।
খ. স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস ইংরেজ সৈন্যদের সাথে পর পর ছয়বার পরাজিত হয়ে পলায়ন করে একটি গুহায় আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি দেখতে পেলেন অধ্যবসায়ের দৃষ্টান্ত। একটি মাকড়সা বারবার কড়িকাষ্ঠে একটি সূতা বাঁধতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়, সপ্তম বারে সে সফল হয়। রবার্ট ব্রুস আনন্দে আতহারা হয়ে পুনরায় ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ করে বিজয়ী হন।
গ. অধ্যবসায়ের মূর্ত প্রতীক কলম্বাস মাত্র কয়েকজন সহচর নিয়ে ডিঙ্গিতে সমুদ্র পথে আমেরিকা যাত্রা করলেন। সবাই ভাবল যে, এটাই কলম্বাসের শেষ যাত্রা। খাদ্যসামগ্রী ক্রমান্বয়ে শেষ হয়ে আসল। সহচরদের সকলেই বিভ্রান্ত হয়ে প্রত্যাবর্তনের সংকল্প করল। কিন্তু কলম্বাস কিছুতেই হতাশ হলেন না। অবশেষে তিনি আমেরিকা আবিষ্কার করতে সক্ষম হন।
অধ্যবসায়ের শিক্ষা:
প্রকৃতি থেকে আমরা অধ্যবসায় শিখতে পারি। বিন্দু বিন্দু পানি থেকে সিন্ধুর সৃষ্টি, ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ে সুকঠিন পাথরের ক্ষয়- এসব থেকে আমরা অধ্যবসায়ের শিক্ষা নিতে পারি।
উপসংহার :
আমাদের সবাইকে হতে হবে কঠোর অধ্যবসায়ী। যখনই কোনো ব্যর্থতা, কোনো দুঃখ, কোনো বিপদ এসে আমাদের জীবনকে বিষময় করে তোলে, তখনই অধ্যবসায়ী মহৎপ্রাণ ব্যক্তিদের কথা স্মরণ করে তাদের আদর্শ অনুকরণ করা উচিত। মনে রাখতে হবে, আল্লাহ তাদেরই সাহায্য করেন, যারা অধ্যবসায়ী ও পরিশ্রমী।
"অধ্যবসায়" এমন একটি গুণ যা মানুষকে জীবনের প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে সাফল্যের পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। অধ্যবসায়ের মাধ্যমে মানুষ তার লক্ষ্যে অবিচল থেকে কঠোর পরিশ্রম ও মনোবল দিয়ে যেকোনো বাধাকে পরাস্ত করতে পারে। এটি শুধুমাত্র ব্যক্তির নিজস্ব উন্নতির জন্য নয়, সমাজ ও দেশের উন্নতির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অধ্যবসায়ই মানুষকে তার পরিশ্রমের ফল স্বরূপ সাফল্য এনে দেয়।