রচনা : বৃক্ষরোপণ ( ২০ পয়েন্ট )

(toc) Table Of Contens

উপস্থাপনা :

বৃক্ষ মানুষের পরম বন্ধু। বৃক্ষ একদিকে যেমন প্রকৃতির শোভা বৃদ্ধি করে, অপরদিকে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে। এ জন্যই বনায়ন বা বৃক্ষরোপণ আমাদের জাতীয় এবং সামাজিক জীবনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আধুনিককালে তাই কবির কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে, “দাও ফিরিয়ে সে অরণ্য, লও এ নগর।

রোপণের উপযুক্ত সময় :

জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বৃক্ষরোপণের উপযুক্ত সময়। কারণ, এ সময় প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হয় যা চারা গাছকে টিকে থাকতে সহায়তা করে।

বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ :

এদেশের সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি আমাদের বিমোহিত করে। কিন্তু বৃক্ষ নিধনের কারণে এখন আর সে সবুজ শ্যামলিমা প্রকৃতি দেখা যায় না। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য কোনো দেশের মোট ভূখণ্ডের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা দরকার। সেখানে আমাদের রয়েছে মাত্র ১৭ শতাংশ বনভূমি। কিন্তু বেসরকারি হিসাবে আরও অনেক কম। এ বনভূমি প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই কম।

বনভূমির প্রয়োজনীয়তা :

বনভূমির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বনভূমির অভাবে কোনো ভূখণ্ড মরুভূমিতে রূপান্তরিত হতে পারে। গাছ আমাদেরকে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, চিকিৎসাসহ নানা কাজে সহায়তা করে আসছে। কিন্তু মানুষের অবহেলা ও অজ্ঞতার কারণে বনভূমি আজ ধ্বংসের মুখোমুখি । নিম্নে বনভূমির প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করা হলো-

ঘরবাড়ি ও প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের উৎস :

ঘরবাড়ি আমাদের আশ্রয়স্থল। ঘরবাড়ি তৈরি করার জন্য প্রয়োজন কাঠ, বাঁশ, বেত, গোলপাতা ইত্যাদি। এ সবই বনভূমি থেকে আসে। ঘরের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র তৈরির জন্যও কাঠ দরকার। এ কাঠ আমরা বনভূমি থেকেই পেয়ে থাকি ।

আরও পড়ুন :- বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য -  রচনা : ২০ পয়েন্ট

ঔষধ তৈরির উপকরণ :

অতি প্রাচীনকালে বিভিন্ন প্রকার গাছ, লতাপাতা ইত্যাদির রস খেয়ে মানুষ আরোগ্য লাভ করত। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে এগুলোকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শোধন করে তৈরি করা হয় জীবন রক্ষাকারী ঔষধ। তাছাড়া বিভিন্ন প্রকার সুগন্ধি, রাসায়নিক দ্রব্য তৈরির উপকরণ গাছগাছালি থেকে সংগ্রহ করা হয় ।

মোম ও মধু :

সুন্দরবনে প্রচুর মৌচাক পাওয়া যায়। এসব মৌচাক থেকে মোম ও মধু সংগ্রহ করা হয়। মোম ও মধু আমাদের খুবই প্রয়োজনীয় বস্তু । মধু খুব সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। তাছাড়া মধু ও মোম সংগ্রহ করে অনেক লোক জীবিকা নির্বাহ করে ।

জ্বালানি :

আমাদের জ্বালানি কাঠের খুব প্রয়োজন। এসব কাঠ বনভূমি থেকে আসে। কিন্তু আমরা অসচেতনতাবশত প্রয়োজনের অতিরিক্ত কাঠ জ্বালিয়ে বনভূমি ধ্বংস করি। প্রয়োজনীয় জ্বালানি মওজুদ রাখার জন্য এক্ষেত্রে আমাদের সুষ্ঠু নীতিমালা মেনে চলা উচিত ।

বন্যা নিয়ন্ত্রণ :

বনভূমি বন্যা নিয়ন্ত্রণে বিরাট ভূমিকা পালন করে। বন্যার প্রকোপ থেকে ঘরবাড়ি, ফসল ইত্যাদি রক্ষা করার জন্য বনভূমির প্রয়োজন অত্যধিক। প্রচুর পরিমাণে বনভূমির অভাবে বন্যার সময় মাটি ক্ষয় হয়ে যায়। তাই বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বনভূমির প্রয়োজন ।

আবহাওয়ার ভারসাম্য :

একটি দেশের প্রয়োজনীয় বনভূমি না থাকলে সেখানকার আবহাওয়ার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে উত্তপ্ত হয়ে যায়। বিরূপ প্রভাব পড়ে। বৃষ্টিপাত কম হয় এবং মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ঋতু পরিবর্তনের চিরাচরিত পদ্ধতি পরিবর্তন হয়ে সেখানকার আবহাওয়ার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। 

আরও পড়ুন :- বাংলা প্রবন্ধ রচনা : বৃক্ষরোপণ অভিযান

বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা : 

বৃক্ষ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। অথচ পর্যাপ্ত বৃক্ষের অভাবে আমাদের দেশে আজ প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। দেখা দিচ্ছে অনাবৃষ্টি। গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া বেড়ে যাচ্ছে। বন্যা, জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। আর এসব কারণেই বৃক্ষরোপণ অভিযানের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

বৃক্ষরোপণ ব্যবস্থাপনা : 

দেশের প্রাকৃতিক বন ব্যতিরেকে বৃক্ষের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে বসতবাড়ি, রাস্তা, বাঁধ, খাস ও প্রাতিষ্ঠানিক জমিতে বিজ্ঞানসম্মত ও পরিকল্পিতভাবে ব্যাপকভিত্তিতে গাছ লাগানো, পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিকে বৃক্ষরোপণ বলে। 

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বন দিন দিন কমছে। ক্রমহ্রাসমান এ প্রাকৃতিক বন আমাদের আর্থসামাজিক সর্বোপরি প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষেত্রে যে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করেছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য ব্যাপক হারে গাছ লাগানো উচিত।

বৃক্ষহ্রাসের কারণ : 

এককালে এদেশের বনমর্মরে কূজিত হতো বিহগকণ্ঠ। এখানে ছিল ফলবান বৃক্ষের বাগানে শ্যামল শোভা, ছিল অরণ্যে বিপুল বৃক্ষরাজি। তবে আধুনিক জীবন ও সভ্যতার ক্রমাগত বিকাশে সবুজ বাংলার সেই শ্যামল সুন্দর রূপ আজ বিলুপ্ত। বিভিন্ন প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে নির্বিচারে প্রতিনিয়ত প্রচুর গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। 

বৃক্ষ হ্রাসের অন্যতম কারণ হলো- ক্রমবর্ধমান বিপুল জনসংখ্যার আবাসস্থলের প্রয়োজনে বন কেটে ঘরবাড়ি তৈরি করা, ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গাছ কেটে ফসলি জমি সম্প্রসারণ করা, জ্বালানি চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে বন থেকে অধিক হারে গাছ কাটা, নির্মাণকাজে ব্যবহারের জন্য গাছ কাটা, আবাসিক প্রয়োজনে আসবাবপত্র তৈরির জন্যও মূল্যবান গাছ কেটে ফেলা। 

তা ছাড়া ঝড়-ঝঞ্ঝার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় অধিকসংখ্যক গাছপালা বিনষ্ট হচ্ছে। বন্যায় বিনষ্ট হচ্ছে মাঝারি, উঁচু ও নিচু জমির গাছ। ভূমিক্ষয়ে বনভূমি নষ্ট হচ্ছে। বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর নিধনযজ্ঞ বেড়ে গিয়ে বন ধ্বংস হচ্ছে। বন সংরক্ষণ আইনে ত্রুটি থাকা ও যথাযথ তার প্রয়োগ না হওয়ায়ও বন ধ্বংস হয়ে বৃক্ষ হ্রাস পাচ্ছে।

বৃক্ষহ্রাসে স্বাস্থ্যহানি : 

জীবজগৎ ও তার পরিবেশের মধ্যে প্রতিনিয়ত জীবনরক্ষাকারী উপকরণের আদান-প্রদান চলে। এ আদান- প্রদানের ভারসাম্যের ওপর জীবের স্বাস্থ্য তথা অস্তিত্ব সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। পরিবেশের এ ভারসাম্য রক্ষায় গাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই মানুষ ও জীবজগতের অস্তিত্বের প্রশ্নে প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত বৃক্ষের ঘাটতি হলে মানবসভ্যতা চরম হুমকির সম্মুখীন হবে। 

অর্থাৎ প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের নির্গত কার্বন ডাইঅক্সাইড গাছপালা শোষণ করে যে অক্সিজেন ত্যাগ করে, মানুষ তা শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে। এভাবে গাছ মানুষের জীবন রক্ষায় যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বৃক্ষ হ্রাসের ফলে তার সম্পূর্ণ প্রভাব পড়বে জনস্বাস্থ্যের ওপর । দেখা দেবে বিভিন্ন দুরারোগ্য ও জটিল রোগব্যাধি । মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী আক্রান্ত হবে নানা জানা-অজানা রোগে ।

বৃক্ষহ্রাসে  অর্থনৈতিক বিপর্যয় :

মানুষের নাগরিক, সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবনে গাছের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাকৃতিক ভাবে গাছ থেকে জীবন যাপনের অত্যাবশ্যক চাহিদা উপকরণ হিসেবে যেসব জিনিস আমরা সংগ্রহ করি বৃক্ষহ্রাস পেলে সেগুলো নগদ মূল্যে আমদানি করতে হবে। 

দালান, ঘরবাড়ি, দরজা, জানালা, সেতু ইত্যাদি। মানুষের কর্মজীবনে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় প্রয়োজনে যে কাঠ ব্যবহৃত হয়ে থাকে বৃক্ষহ্রাসে সেসবের জন্য অর্থনীতির উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। 

আরও পড়ুন :- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি - রচনা ( ২০ পয়েন্ট )

বৃক্ষরোপণ অভিযান :

বনজ সম্পদকে টিকিয়ে রাখা ও এর সম্প্রসারণের জন্য আমাদের দেশে প্রতিবছর বৃক্ষরোপণ অভিযান পরিচালনা করা হয়। সপ্তাহ, পক্ষকাল বা মাসব্যাপী এ অভিযান চলে। এ সময় পরিকল্পিত উপায়ে বৃক্ষরোপণ করা হয় । সাধারণত প্রতিবছর বর্ষাকালে সরকারের বনবিভাগের উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ অভিযান চালানো হয়। 

এ সময় জনগণ নিকটস্থ নার্সারী থেকে বিনামূল্যে অথবা স্বল্প মূল্যে গাছের চারা সংগ্রহ করতে পারে। অভিযান চলাকালে আমাদের জীবনে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা ও চারা রোপণের পদ্ধতি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া হয়। নিঃসন্দেহে বৃক্ষরোপণ অভিযান একটি মহৎ প্রচেষ্টা। 

“বৃক্ষরোপণ একটা সদকা জারিয়ার ন্যায় সৎকাজ। আজ যে একটা বৃক্ষরোপণ করলেন- ইহার ফুল, ছায়া, শোভা, কাঠ ইত্যাদির কথা বিবেচনা করিলে ইহার মধ্যে একটা আনন্দের ছোঁয়া পাওয়া যায়।” –কাশতাকার ।

বৃক্ষরোপণ অভিযান সফল করার উপায় : 

বৃক্ষ রক্ষা মানে নিজেদের জীবনকে রক্ষা করা। বৃক্ষরোপণ অভিযানকে সফল করতে হলে সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বনবিভাগ বৃক্ষের চারা উৎপাদন করে বিনামূল্যে তা জনগণের মাঝে সরবরাহ করবে। গাছ লাগানোর জন্য জনমনে চেতনা সঞ্চার করতে হবে। 

এ ব্যাপারে রেডিও টেলিভিশন, মিনিপর্দা, মাইকে প্রচার, পোস্টার বিলি এবং সভাসমিতি ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে। আমাদের দেশে বারো কোটি সক্ষম লোক আছে । আমরা প্রত্যেকে যদি কমপক্ষে একটা করে গাছ লাগাই তাহলে সহসাই আমাদের এ অভিযান সফল হবে। তাই একটি সুখী ও সুন্দর জীবনের ন্য সকলকে এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হওয়া উচিত। 

বনভূমি রক্ষার উপায় :

ক. সরকারি উদ্যোগে গাছ লাগাতে হবে এবং তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

খ. বেসরকারি সমাজকল্যাণমূলক সংস্থাগুলোকে এ মহৎ কাজে উৎসাহিত করতে হবে।

গ. আইনের মাধ্যমে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করতে হবে।

ঘ. নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে এবং তার পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণে যত্নশীল হতে হবে। ঙ. সরকারি উদ্যোগে ভালো বীজ সংগ্রহ করে জনসাধারণের মাঝে বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে।

চ. ইট তৈরিতে কাঠের পরিবর্তে কয়লা ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে।

সরকারি ব্যবস্থা :

বাংলাদেশ সরকার বৃক্ষরোপণ অভিযান সফল করার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের বনবিভাগ প্রতি বছর জুন-জুলাই মাসে বৃক্ষরোপণ পক্ষ উদ্‌যাপন করে থাকে। এ সময় বৃক্ষরোপণে জনগণকে আগ্রহী করার জন্য বিনামূল্যে বৃক্ষের চারা সরবরাহ করা হয়।

উপসংহার : 

বৃক্ষরোপণ অভিযান সফল করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে গাছ লাগানো এবং তা সংরক্ষণের প্রচেষ্টা করা উচিত । বৃক্ষ আমাদের প্রতি উদার, তাই আমাদেরকেও তার প্রতি যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন ।

Post a Comment

0 Comments