উপস্থাপনা :
পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকেই নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাজ সভ্যতা বর্তমান পর্যায়ে এসে-পৌছেছে। বিশ্ব জনগোষ্ঠীর অর্ধেকই হচ্ছে নারী। তাই বিশ্বের উন্নয়নের জন্য আবশ্যক নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন। নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন বলতে বোঝায় নারীর মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিতকরণ। সাংবিধানিক গ্যারান্টিসহ রাষ্ট্রীয়, শাসনযন্ত্রের সকল স্তরে তথা পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও অধিকার নিশ্চিতকরণ।
নারীর ক্ষমতায়ন কী :
‘ক্ষমতায়ন’ শব্দটি দ্বারা মূলত বোঝায় স্বাধীনতা, মত প্রকাশ, সকল ক্ষেত্রে অধিকার প্রতিষ্ঠা, বিশেষ করে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা। নারীর ক্ষমতায়ন বলতে বোঝায় ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সর্বজনীনতা সংরক্ষণ করে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে নারীর স্বাধীন ও সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণ ।
দেখুন এটি : জাতি গঠনে নারী সমাজের ভূমিকা – রচনা ( ২০ পয়েন্ট )
সুতরাং উন্নয়নের সাথেই নারীর ক্ষমতায়ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নারী-উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন এ দুটি বিষয়কে সংশ্লিষ্ট করে সাংবিধানিক গ্যারান্টিসহ রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার সকল স্তরে নারীর অংশগ্রহণ, মত প্রকাশের সুযোগ ও অধিকার নিশ্চিত করাই হলো প্রকৃত অর্থে নারীর ক্ষমতায়ন ।
বিশ্ব প্রেক্ষাপট ও বাংলাদেশ :
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে নারী-উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের পথ প্রতিনিয়ত প্রশস্ত হচ্ছে। সত্তরের দশকে নারীর মর্যাদা ও অধিকারের বিষয়টি জাতিসংঘের নীতিতে বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালকে জাতিসংঘ ‘বিশ্ব নারী বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে। জাতিসংঘের সহায়তায় ১৯৭৫ সালে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নারীরা এসব সম্মেলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে নিজ নিজ দেশের সমস্যা ও দাবি-দাওয়ার কথা তুলে ধরেন। বর্তমানে সিডও-র প্রধান কর্মকর্তা বাংলাদেশেরই ফারদৌস আরা বেগম ।
এছাড়া ১৯৯২ সালে রিও ডি জেনিরিওতে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলনে গৃহীত পরিবেশ ও উন্নয়ন পরিকল্পনা, ১৯৯৩ সালে ভিয়েনা মানবাধিকার ঘোষণা, ১৯৯৪ সালে কায়রোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত জনসংখ্যা ও উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা এবং ১৯৯৫ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব সামাজিক শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত কর্মপরিকল্পনায় নারী ও শিশু উন্নয়ন এবং তাদের অধিকারের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এসব সনদ ও কর্মপরিকল্পনায় বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেছে এবং এগুলো বাস্তবায়নে অঙ্গীকার প্রদান করেছে।
নারার ক্ষমতায়নে সাংগঠনিক পদক্ষেপ :
মহিলাদের উন্নয়নে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৭৮ সালে মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে ১৯৯৪ সালে তা মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় নামকরণ করা হয়। এর আগে স্বাধীনতার পর পরই ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ নারী পুনর্বাসন বোর্ড এবং ১৯৭৬ সালে জাতীয় মহিলা সংস্থা গঠন করা হয়। পরে নারীর কল্যাণে সমন্বিত পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৯০ সালে ‘মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর গঠন করা হয়।
দেখুন এটি : রচনা: নারী শিক্ষা/নারী শিক্ষার গুরুত্ব (২০ পয়েন্ট)
যার অধীনে রয়েছে- জাতীয় মহিলা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন একাডেমি, কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, নারীদের কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বেগম রোকেয়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ১৯৯৫ সালে জাতীয় মহিলা পরিষদ গঠন করা হয় যা পরবর্তীতে ২০০৯ সালে জাতীয় মহিলা ও শিশু উন্নয়ন পরিষদ নামকরণ করা হয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এই পরিষদের সভাপতি ।
সামাজিক অবস্থা :
বাংলাদেশে নারী-উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর অধিকার পুরোপুরি সংরক্ষিত হয়নি। এখনো নারী-নির্যাতন, যৌতুকলোভী স্বামী কর্তৃক স্ত্রী হত্যা, নারী অপহরণ ও পাচার, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ, নারীর প্রতি এসিড নিক্ষেপ এবং স্কুল-কলেজের মেয়েদেরকে উত্ত্যক্ত করা ইত্যাদি অপরাধ অনেকটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অথচ অপরাধকারীর সঠিক বিচার করতে সরকার বারবারই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। নারী অধিকার সংরক্ষণের যে আইন রয়েছে, তা কাগজ-কলমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তদন্তের যেমন নেই অগ্রগতি, তেমনি নেই আইনের কঠোর প্রয়োগ । ফলে অপরাধের মাত্রা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসরতা :
পরিবারের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষার মান উন্নয়ন ও সমাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার জন্য নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু নারীশিক্ষার অগ্রগতি আশানুরূপভাবে হচ্ছে না। নারীশিক্ষা বিস্তারে সরকার বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিলেও গ্রামে বসবাসকারী দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর নারীরা অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। তারা স্কুলে ভর্তি হলেও মূলত দারিদ্র্য ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে অধিকাংশই উচ্চশিক্ষার দ্বার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না। ফলে নারীর ক্ষমতায়নে তারা কোনো অবদানও রাখতে পারছে না ।
দেখুন এটি : রচনা : সংবাদপত্র (২০ পয়েন্ট) – PDF
সচেতনতার অভাব :
নারীর ক্ষমতায়নের একটি বড় বাধা হচ্ছে নারীদের সচেতনতার অভাব। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে তাদেরও যে অধিকার আছে, এ সত্য উপলব্ধি করতে তারা প্রায়ই ব্যর্থ হয়। পরিণত বয়সে পদার্পণের পূর্বেই পিতা-মাতারা বিয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়। তাই তারা লেখাপড়ায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং উচ্চশিক্ষা লাভ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না ।
ধর্মীয় গোঁড়ামি :
ধর্মীয় গোঁড়ামিও নারীর ক্ষমতায়নে একটি বড় বাধা। ইসলাম ধর্মে “মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেস্ত” বলে নারীর মর্যাদা কে সর্বোচ্চ গৌরবের ভূষিত করা হয়েছে। হিন্দু পানে বলা হয়েছে ‘নারীরা শক্তির মূল আধার।’ কিন্তু গোঁড়াপন্থীরা ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীদের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নারী :
সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ সত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ষাটের দশক থেকে বেশ কয়েকটি দেশের সরকারপ্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচিত হয়েছেন নারী।
যেমন- বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী ও সোনিয়া গান্ধী, পাকিস্তানের বেনজীর ভুট্টো, ফিলিপাইনের কোরাজন একুইনো, গ্লোরিয়া অ্যারোইয়ো, শ্রীলঙ্কার শ্রীমাভো বন্দরনায়েক ও চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা, গ্রেট ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের ‘রানি এলিজাবেথ (দ্বিতীয়), ব্রিটেনের মার্গারেট থ্যাচার, আফ্রিকার এলিজাবেথ ডোমিশিয়েন, নেদারল্যান্ডের ব্রিয়েটিচ, ডেনমার্কের রানি মার্গারেট (দ্বিতীয়), বার্মার অং সান সুচি, আর্জেন্টিনার ইসাবেলা পেরন, যুক্তরাষ্ট্রের কন্ডলিসা রাইস, ইন্দোনেশিয়ার মেঘবতী সুকর্নপুত্রী প্রমুখ।
অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের নারীরা রাজনীতিতে পশ্চাৎপদ নয়; বরং অনেক অগ্রসর। তাছাড়া বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে দীর্ঘদিন যাবৎ সরকারি ও বিরোধী- দুই দলেরই প্রধান নারী ।
দেখুন এটি : কর্মমুখী শিক্ষা / বৃত্তিমূলক শিক্ষা- রচনা (২০ পয়েন্ট)
প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নারীর অবস্থান :
আমাদের দেশে প্রশাসনে নারীদের অংশগ্রহণ ধীর গতিতে এগিয়ে চলছে । প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণের লক্ষ্যে সরকার নানাবিধ পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ১৯৭২ সালে সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হয়। ১৯৭৬ সালে পুলিশ বিভাগে নারীদের নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। এভাবে ক্রমে পুলিশ, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে সচিব পদেও রয়েছে মহিলা।
বাংলাদেশে নারী শ্রমশক্তির পরিমাণ প্রায় ২৫ মিলিয়ন। এর মধ্যে মাত্র ১০,০০০ জন নিয়োজিত প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা পেশায়। প্রায় ৭৯% নারী কাজ করে কৃষিখাতে (মৎস্য ও বনায়নসহ), ৯.৯% নারী কাজ করে ম্যানুফ্যাকচারিং ও পরিবহন খাতে। ২.২% নারী বিপণন শ্রমিক ও ০.৬% নিয়োজিত করণিক পর্যায়ের কাজে। সীমিত সংখ্যক নারী জড়িত আছেন সরকারের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ স্তরে ।
নারীর ক্ষমতায়নে সরকারের কর্তব্য :
যে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করলে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হতে পারে, তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
১। নারীদের ব্যাপকহারে শিক্ষিত করতে হবে। নারী শিক্ষার বর্তমান নগণ্য হার বৃদ্ধি করতে হবে উল্লেখযোগ্যভাবে।
২। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিলেবাসে নারীর আইনগত ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক তথ্য সংযুক্ত করতে হবে।
৩। সকল স্তরের নারীদের শিক্ষিত করার লক্ষ্যে গণশিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা, নৈশ বিদ্যালয়ে শিক্ষা ইত্যাদি নিশ্চিত ও সম্প্রসারিত করতে হবে।
৪। আইনবিধি ও দলিলাদি থেকে নারীদের জন্য মর্যাদাহানিকর বক্তব্য ও মন্তব্য অপসারণ করতে হবে।
৫। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, আইন ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা, নীতি নির্ধারক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তা এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নারীদের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সাধিত করতে হবে এবং তাদের ব্যাপারে হতে হবে সচেতন।
৬। নারী পুরুষের সম্পর্ক, অধিকার ও নারী উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়াবলি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে তা প্রচার ও চর্চার ব্যবস্থা করতে হবে।
দেখুন এটি : মাতা পিতার প্রতি কর্তব্য – রচনা ( ২০ পয়েন্ট )
নারীর প্রশাসনিক ক্ষমতায়ন :
নারী ক্ষমতায়নের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে নারীর জন্য ‘লেটারেল এন্ট্রি’ বা সরাসরি প্রবেশের সুযোগ থাকতে হবে। বাংলাদেশের দূতাবাস, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে অথবা পরিকল্পনা কমিশনে বা বিচার বিভাগের উচ্চতর পদে যোগ্য নারীদের প্রবেশের সুযোগ থাকতে হবে। প্রয়োজনে চাকরি কোটা বৃদ্ধি করতে হবে।
রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন :
রাজনীতিতে নারীর অধিক হারে অংশগ্রহণ এবং সংসদীয় ও অন্যান্য নির্বাচনে কোটাভিত্তিক ও সাধারণভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। মন্ত্রিপরিষদে প্রয়োজনে অধিক সংখ্যক নারী নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন:
অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে একজন নারীর জরুরী বিষয়াদি যথা- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণ, কারিগরি শিক্ষা, জীবনব্যাপী শিক্ষা, তথ্য, উপার্জনের সুযোগ, উত্তরাধিকার, সম্পদ, ঋণ প্রযুক্তি এবংঅর্জিত সম্পদ সহ বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভূমির উপর অধিকার ইত্যাদির ক্ষেত্রে একজন নারীর পূর্ণ ও সমান সুযোগ এবং নিয়ন্ত্রণের অধিকার দেয়া এবং এ লক্ষ্যে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সকল নতুন আইন প্রণয়ন করা।
দেখুন এটি : মানব জীবনে / মানব কল্যাণে বিজ্ঞান রচনা (২০ পয়েন্ট )- PDF
নারীর ক্ষমতায়নে প্রতিবন্ধকতা :
নারীর ক্ষমতায়নে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা পরিলক্ষিত হয়। এসব প্রতিবন্ধকতা অপসারণ ও রোধ করতে হবে। যেমন-
১। প্রচলিত রীতি-নীতি ও সামাজিক প্রথা দূর করতে হবে।
২। নিয়ম ও আচার দ্বারা নারীকে প্রবোধ ও বাধা দেওয়া থেকে সংশ্লিষ্টদের রোধ করতে হবে।
৩। পুরুষদের একক কর্তৃত্ব সমঝোতার মাধ্যমে দূর করতে হবে।
৪। বিয়ে, বিবাহ বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব ইত্যাদি বিষয়ে নারীদের প্রতি একচেটিয়া প্রভাব বিস্তারের পুরুষালি কর্তৃত্ব খর্ব করতে হবে।
৫। অন্ধ কুসংস্কার এবং দূর করে নারীদের প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
নারীর ক্ষমতায়নে করণীয় :
নারীসমাজকে সামাজিক পশ্চাৎপদতা হতে বেরিয়ে এসে সামাজিক উন্নয়নের কাজে অংশগ্রহণ করতে হবে। নারীর ক্ষমতায়নের পূর্বশর্ত হলো নারীর ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের অবস্থা ও অবস্থানের পরিবর্তন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। নারীকে বিয়ে, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানধারণে পূর্ণ স্বাধীনতা, সম্পত্তিতে ও কর্মক্ষেত্রে সমঅধিকার, সন্তানের অভিভাবকত্ব প্রভৃতি বিষয়ে সনাতন আইনের পরিবর্তে তাদের প্রকৃত অধিকার দিতে হবে।
শিক্ষায় ব্যাপক সুযোগ করে দিয়ে, আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানে পরিচিত হতে দিতে হবে। যাতে তারা আক্ষরিক অর্থে সামাজিক উন্নয়নের কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে। সমাজ থেকে নারী সম্পর্কে ধর্মীয় কুসংস্কারও দূর করতে হবে। সর্বোপরি ইসলাম নারীকে যে অধিকার ও মর্যাদা দিয়েছে তা আদায়ের জন্য নারীদেরকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তাহলেই নারীর ক্ষমতায়ন সার্থক হবে ।
দেখুন এটি : রচনা : বাংলাদেশের পোশাক শিল্প ( ২০ পয়েন্ট ) – PDF
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীর ক্ষমতায়ন :
বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নের ধারণা প্রথম থেকেই পোষণ করে আসছে । বাংলাদেশ তার সংবিধানে নারী পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করেছে । এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে যেসকল নারী অবদান রেখেছেন ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের পুনর্বাসন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে ‘নারী পুনর্বাসন বোর্ড’ গঠন করা হয় । ১৯৭৮ সালে মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত হয় ।
সরকারের গৃহীত নারী উন্নয়মূলক কার্যক্রম মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৮৪ সালে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর গঠন করা হয় । ১৯৯৪ সালে শিশু বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে ‘মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়’- এ রূপান্তর করা হয় । আমাদের দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় স্পিকার এবং বিরোধী দলীয় নেত্রী সকলেই নারী । বাংলাদেশে নারীর ক্ষতায়নের পথ প্রশস্থ হওয়ার এ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ।
নারীর ক্ষমতায়নে এনজিও’র ভূমিকা :
নারীর ক্ষমতায়নে এনজিও সেক্টরের অবদান গুরুত্বপূর্ণ । নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে এনজিওগুলো বহুমাত্রিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে । এর মধ্যে ৩৮টি এনজিও শুধু নারীদের জন্য কাজ করে এবং তাদের মধ্যে সংগঠন তৈরি, সচেতনতা বাড়ানো, আয়মুখী ও ঋণকার্যক্রমে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো, মৌলিক মানবাধিকার সংরক্ষণে গতিশীলতা বাড়ানো, জীবিকা নির্বাহের জন্য দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ প্রদান, স্বাস্থ্য সেবা বৃদ্ধি ও নারী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি ইত্যাদি কাজ করে আসছে ।
ক্ষমতায়নের পূর্বশর্ত নারীর যোগ্যতা :
নারীর ক্ষমতায়ন ঘটাতে হলে সবদিক থেকে নারীকে আগে যোগ্য হয়ে উঠতে হবে । সময়ের চাহিদা অনুযায়ী গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ার দায়িত্বে নারীর সমানাধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর মর্যাদা প্রদান অপরিহার্য । তবে সেই মর্যাদা লাভে এবং তা প্রতিষ্ঠা করতে নারীকে হতে হবে বিদুষী ।
চিন্তা-চেতনায় নারীরা অনেক পশ্চাতে পড়ে আছে বলেই নারীর ক্ষমতায়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে না । প্রচলিত আইন, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, সামাজিক কাঠামো কোনোটাই নারীর ক্ষমতাকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করে না । তাই দক্ষতা বৃদ্ধির পাশপাশি নারীকে তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে । সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় নারীকে সুদৃঢ় ও সক্ষম হতে হবে ।
উপসংহার :
নারী-পুরুষের ক্ষমতার সুসম বণ্টন ছাড়া দেশের তথা সমাজের সার্বিক উন্নয়ন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সামাজিক উন্নয়ন হবে তখন সোনার হরিণ। তাই দেশ, সমাজ ও জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন নারীর মুক্তি, নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন; জেন্ডার বৈষম্য দূর করে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সকল পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ, তাদের অধিকার সংরক্ষণসহ সাংবিধানিকভাবে তাদের সকল কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি প্রদান ।