দীনের সত্যপন্থি মুজতাহিদগণ স্বীয় জ্ঞান, বুদ্ধি ও একনিষ্ঠ গবেষণার মাধ্যমে মুসলিম মিল্লাতের জন্য আল কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে যে জীবনবিধান প্রণয়ন করেছেন, তা-ই হলো ইলমে ফিকহ তথা ফিকহশাস্ত্র। ইসলামী শরীয়তের পরিপূর্ণ ও নির্ভেজাল অনুসরণের লক্ষ্যেই ফিকহশাস্ত্রের উৎপত্তি। ইসলামের আবির্ভাবের শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অগণিত মহামনীষী ইসলামী মূলনীতির আলোকে বাস্তবতার নিরিখে যুগ জিজ্ঞাসার সমাধান প্রদানের লক্ষ্যে অক্লান্ত পরিশ্রম ও গবেষণার ফলে কালের পরিক্রমায় এটি একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্রে পরিণত হয়। নিম্নে ফিকহ শাস্ত্রের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো ।
ইলমুল ফিকহ বা ফিকহ শাস্ত্রের উৎপত্তি :
মানবজাতির মুক্তির জীবনবিধান হিসেবে কুরআনুল কারীমের অবতরণ। হাদীসে নববী হলো তার ব্যাখ্যাগ্রন্থ। আর এতদুভয়ের সারনির্যাস হলো ইলমুল ফিকহ। আল্লাহ তায়ালা বলেন- কুরআন হলো মানবজাতির জন্য হেদায়াত, সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী।
সুতরাং কুরআনের মূল উদ্দেশ্য হলো মানবজাতির হেদায়াত তথা আল্লাহর বিধিবিধানের বাস্তবায়ন। আর যা একমাত্র ফিকহশাস্ত্রের মাধ্যমেই সম্ভব। তাই কুরআন অবতরণের সাথে সাথে ইলমুল ফিকহের উৎপত্তি ঘটে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন- فَلَوْ لَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرقَةٍ مِنْهُم طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَهُوا فِى الدِّينِ وَلِيُنذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ
অর্থাৎ, তাঁদের প্রত্যেক দল থেকে একটি উপদল বের হয় না কেন, যাতে তারা দীন সম্বন্ধে জ্ঞানানুশীলন করতে পারে এবং তাঁদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে? যখন তারা তাদের নিকট ফিরে আসবে, যাতে তারা সতর্ক হয়।
আরো পড়ুন : ফিকহ শব্দের অর্থ কি?কাকে বলে। গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
তবে উৎপত্তিকালীন ইলমুল ফিকহের পরিভাষা বর্তমান অবস্থা থেকে ভিন্নতর বোঝাত। রাসূল (স)-এর আমলে ইলম ও ফিকহ শব্দ দুটি পৃথক অর্থে ব্যবহার হতো। ইলম বলতে কুরআন ও এর তাফসীর এবং রাসূল (স) ও সাহাবীগণ হতে প্রাপ্ত আইন সংক্রান্ত সিদ্ধান্তসমূহের নির্ভুল জ্ঞান অর্জন বোঝাত ৷ পক্ষান্তরে ফিকহ শব্দ দ্বারা জ্ঞান বুদ্ধির স্বাধীন প্রয়োগ বোঝাত। ক্ষেত্রবিশেষে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে পবিত্র কুরআন ও হাদীসের বিধান বিদ্যমান না থাকলে নিজ বিচার বুদ্ধির সাহায্যে আইনঘটিত ব্যাপারসমূহের সমাধান করাকেও ফিকহরূপে গণ্য করা হতো। এরূপ স্বাধীন বিচার বিবেচনার ফলে ফিকহের উৎপত্তি হয়।
ইলমুল ফিকহের ক্রমবিকাশ :
ইলমুল ফিকহের ক্রমবিকাশ সম্পর্কিত আলোচনা নিম্নে প্রদত্ত হলো-
ক্রমবিকাশের প্রেক্ষাপট : খোলাফায়ে রাশেদার তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রা)-এর হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ইসলামী সাম্রাজ্যে ফেতনার সূচনা হয়। এরপর হযরত আলী (রা) শাহাদাতবরণ করেন। পর্যায়ক্রমে হযরত হোসাইন (রা)-এর শাহাদাত ও অপরাপর হিংসাত্মক এবং ষড়যন্ত্রমূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশের ফলে ইসলামে নানাবিধ ফেরকা ও মতবাদের সৃষ্টি হয়।
তৎকালীন মুজতাহিদগণ আল কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আইন সংকলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং সম্পাদন করেন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সেদিনের ইসলামের ধারক বাহক মুজতাহিদগণের বাস্তব পদক্ষেপের ফলেই মুসলিম উম্মাহর সামগ্রিকভাবে ইসলামের ওপর চলা সহজ হয়েছে; পেয়েছে জীবনবিধানের সঠিক ব্যাখ্যা তত্ত্ব, তথ্য আর পূর্ণাঙ্গ ফিকহশাস্ত্র ।
ফিকহ সংকলনের সময়কাল : ফিকহশাস্ত্র সংকলন ও সম্পাদনা তথা এর ক্রমবিকাশের সময়কালকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। যথা-
১. প্রাথমিক যুগ : সর্বপ্রথম ১১০ হিজরী থেকে হযরত ইবরাহীম ইবনে ইয়াযিদ নখয়ী (র)-এর নেতৃত্বে ফিকহ সম্পাদনার কাজ শুরু হয়। নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শুরু হয় প্রকৃতপক্ষে ইমাম আযম আবু হানীফা (র)- এর নেতৃত্বে ১৩০ হিজরী থেকে। তিনি চল্লিশজন বিশিষ্ট ফকীহ নিয়ে ফিকহ সম্পাদনা পরিষদ গঠন করে সর্বপ্রথম সম্পাদনা করেন। ইমাম আবু হানীফা (র)-এর এ ফিকহ সংকলনকে ٱلْكُتُبُ ٱلْحَنَفِيَّةُ বলা হয়। এতে সর্বমোট তিরাশি হাজার সংকলনকে মাসয়ালা স্থান পেয়েছে।
আরো পড়ুন : ফিকহ শাস্ত্রের উৎস কয়টি? ফিকহ এর আলোচ্য বিষয় ও উদ্দেশ্য কি
এর পরপরই ইমাম আহমদ, মালেক ও শাফেয়ী (র)সহ অনেক মুজতাহিদ ফিকহশাস্ত্রের ওপর গবেষণা চালান এবং স্বতন্ত্রভাবে ফিকহ সংকলিত হতে থাকে। অবশেষে এ যুগের শেষপ্রান্তে এসে চারটি ফিকহী মাযহাবের গোড়াপত্তন হয়। সমগ্র মুসলিম জাহানে গৃহীত মাযহাব এ যুগেই প্রতিষ্ঠিত হয়। হিজরী তৃতীয় শতাব্দী নাগাদ এ যুগের ব্যাপ্তি ধরা হয়।
২. দ্বিতীয় যুগ : ফিকহ সম্পাদনার দ্বিতীয় যুগকে পূর্ণতার যুগ বলা হয়। তৃতীয় শতাব্দীর শেষ তথা হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর শুরু থেকে আব্বাসীয় বংশের পতনকাল তথা হিজরী সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ এ যুগের ব্যাপ্তি। এ যুগে অনুসরণের প্রচলন হয়। লোকজন চারটি মাযহাবের যে কোনো একটি মাযহাব অনুসরণ করতে থাকে। এ যুগের আলেমগণ পূর্ববর্তী ফকীহগণের অনুসরণে মাসয়ালাসমূহের সমাধান দিতে থাকেন। এ যুগকে ٱلِاجْتِهَادُ فِي ٱلْمَسَائِلِ-এর যুগও বলা হয় ।
৩. তৃতীয় যুগ : ফিকহে ইসলামী সম্পাদনার তৃতীয় যুগকে নিরেট অনুসরণের যুগ বলা হয় । সপ্তম হিজরীর প্রথম মতান্তরে মাঝামাঝি সময় থেকে এ যুগের সূচনা। অদ্যাবধি এ যুগ অব্যাহত রয়েছে। এ যুগে ইজতেহাদের তেমন কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। এ সময়ে প্রথম ও দ্বিতীয় যুগের সংকলিত ফিকহ গ্রন্থসমূহের অসংখ্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রণীত হয়। মূলত এ যুগই হচ্ছে ফিকহশাস্ত্রের যথার্থ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের যুগ ।
আরো পড়ুন : ইমাম শাফেয়ী রহঃ এর জীবনী ও ফিকহে শাফেয়ীর বৈশিষ্ট্যাবলি-pdf