ইমাম শাফেয়ী রহঃ এর জীবনী ও ফিকহে শাফেয়ীর বৈশিষ্ট্যাবলি-pdf

ইসলামী শরীয়তের বিধিবিধানসমূহ সন্নিবেশিত করে ইলমুল ফিকহ সংকলন ও মাযহাব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে চারজন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ মুজতাহিদ মুসলিম জাহানে চিরস্মরণীয়, বরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে আছেন, ইমাম শাফেয়ী (র) তাঁদের মধ্যে দ্বিতীয়। তাঁর প্রখর স্মৃতিশক্তি, অপূর্ব মেধা, বিস্ময়কর প্রতিভা আর উদ্ভাবনী ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। নিম্নে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনালেখ্য সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলোচনা উপস্থাপিত হলো।

ইমাম শাফেয়ী রহঃ এর জীবনী :

নিম্নে ইমাম শাফেয়ী (র)-এর বর্ণাঢ্য জীবনী উল্লেখ করা হলো-

১. পরিচিতি : তাঁর নাম মুহাম্মদ, পিতার নাম ইদরীস, কুনিয়াত বা উপনাম আবু আবদুল্লাহ, মাতার নাম উম্মুল হাসান বিনতে হামযাহ, নিসবত আশ শাফেয়ী, পূর্ণ নাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইদরীস আশ শাফেয়ী।

2. বংশ পরম্পরা : রাসূলে মাকবুল (স) যে সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন ইমাম শাফেয়ী (র)-ও সে বংশের সন্তান। ইমাম শাফেয়ী (র)-এর বংশের ঊর্ধ্বতন নবম পুরুষ আবদে মানাফ, যিনি রাসূল (স)-এর ঊর্ধ্বতন চতুর্থ পুরুষ।

৩. শাফেয়ী বলার কারণ : তাঁর পূর্বপুরুষ স্বনামধন্য ওসমান ইবনে শাফে-এর নামানুসারে তাঁকে শাফেয়ী বলা হয়।

৪. জন্ম তথ্য : ১৫০ হিজরী সনে ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক গাজ্জা বা আসকালান শহরে ইমাম শাফেয়ী (র) জন্মগ্রহণ করেন। কারো কারো মতে, তাঁর জন্মস্থান হলো মদিনাতুল মুনাওয়ারা । উল্লেখ্য, তিনি যেদিন জন্মগ্রহণ করেন ইমাম আযম আবু হানীফা (র) সেদিন ওফাতবরণ করেন ।

৫. শৈশবকাল : ইমাম শাফেয়ী (র) জন্মের দু’বছর পরেই তাঁর পিতাকে হারান। ফলে পিতৃহারা দুঃখ নিয়ে মাতৃক্রোড়ে লালিতপালিত হন। পবিত্র মক্কা নগরীতে তাঁর শৈশবকাল অতিবাহিত হয়।

আরো পড়ুন : ইমাম মালেক রহঃ এর জীবনী – pdf

৬. মেধা ও প্রতিভা : তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণ মেধা ও বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী। তিনি যখন ৭ বছরের শিশু, তখন পবিত্র কুরআন হিফয করেন। ১০ বছর বয়সে মুয়াত্তা মালেক মুখস্থ করেন। এরপর মক্কার প্রখ্যাত ফকীহ মুসলিম ইবনে খালেদ এর নিকট পাঁচ বছর যাবৎ ইলমুল ফিকহ অধ্যয়ন করেন। ১৫ বছর বয়সেই তৎকালীন ফকীহগণ তাঁকে ফতোয়াদানের অনুমতি দেন। এরপর তিনি মদিনায় ইমাম মালেক (র)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে তাঁকে ‘মুয়াত্তা’ মুখস্থ শোনান এবং তাঁর কাছে ইলমুল ফিকহ বিষয়ে গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। সেখান থেকে শিক্ষা সমাপন করে তিনি ইরাকে পাড়ি জমান এবং ইমাম আবু হানীফা (র)-এর শ্রেষ্ঠ ছাত্র ইমাম মুহাম্মদের নিকট হাদীস ও অধ্যয়ন করেন। এ ছাড়াও তিনি ৮১ জন মুহাদ্দিসের নিকট থেকে হাদীসের শিক্ষা গ্রহণ করেন ।

৭. কর্মজীবন : অধ্যাপনার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা হয়। শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে বাগদাদে দু’বছর অধ্যাপনা শেষ করে মক্কা শরীফ চলে আসেন।

৮. সরকারি পদে নিযুক্ত : সে সময় বাগদাদের খলিফা হারুনুর রশীদ ইমাম শাফেয়ী (র)-কে মেধা ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন দেখে নাজরানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। অবশ্য বেশিদিন তিনি এ পদে বহাল না থেকে ১৮৪ সালে বাগদাদ ত্যাগ করেন।

৯. মক্কা গমন : ইরাক থেকে ইমাম শাফেয়ী (র) পবিত্র মক্কায় গমন করেন। জ্ঞানের অনুসন্ধানে মক্কায় আগত মিসরীয়, স্পেনীয় ও আফ্রিকান ওলামায়ে কেরাম থেকে জ্ঞানানুসন্ধান করেন ।

১০. পুনরায় ইরাক গমন : ১৯৫ হিজরীতে তিনি মক্কা হতে পুনরায় ইরাক গমন করেন। ওলামায়ে কেরামের বিশাল একটি দল তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে।

১১. মাযহাব প্রবর্তন : ইরাকে অবস্থানকালে তিনি হানাফী ও মালেকী মাযহাবের ফকীহ আলেমগণের সমন্বয়ে মধ্যমপন্থি একটি মাযহাব প্রবর্তন করেন। মাযহাবে শাফেয়ী মাযহাব বলা হয়।

১২. মিসর গমন ও নতুন মাযহাব প্রতিষ্ঠা : ইরাকে স্বীয় মাযহাব প্রতিষ্ঠিত করে তিনি ১৯৮ হিজরীতে মিসর চলে যান। এখানে পারিপার্শ্বিক অবস্থা লক্ষ্য করে তাঁর মাযহাব ও গবেষণায় সংস্কার ও পরিবর্তন সাধন করে একটা সংশোধিত মাযহাব রচনা করেন। এটাকেই শাফেয়ী মাযহাব বলা হয়। সুদীর্ঘ ছয় বছরকাল অবস্থানের মাধ্যমে তিনি তাঁর মাযহাবকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।

১৩. হাদীসে অবদান : ইমাম আহমদ (র) ছিলেন ইমাম শাফেয়ী (র)-এর সুযোগ্য ছাত্র। উস্তাদের উৎসাহ, অনুপ্রেরণা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ইমাম আহমদ মুসনাদে আহমদ নামক গ্রন্থখানা প্রণয়ন করেন।

১৪. রচিত গ্রন্থাবলি : ইমাম শাফেয়ী (র) কিতাবুল উম্মা নামে ফিকহশাস্ত্রের মূলনীতির ওপর একটি প্রসিদ্ধ কিতাব রচনা করেন। এটাকে উসূলে ফিকহের প্রথম কিতাব হিসেবে গণ্য করা হয়। এতে অনেক হাদীসও বর্ণিত আছে। তাঁর রচিত কিতাবের সংখ্যা সর্বমোট ১১৪ খানা ।

আরো পড়ুন : ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এর জীবনী – pdf

১৫. ইন্তেকাল : জীবনভর জ্ঞানসাধনা ও জ্ঞানের বাস্তবায়ন প্রতিষ্ঠা করে ইমাম শাফেয়ী (র) ২০৪ হিজরী মোতাবেক ৮২৬ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মিসরের মাটিতে ইন্তেকাল করেন ।

ফিকহে শাফেয়ীর বৈশিষ্ট্যাবলি :

ইমাম শাফেয়ী (র)-এর ফিকহের বৈশিষ্ট্যাবলি নিম্নরূপ-

  • কুরআনের ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণের দিকে না তাকিয়ে তিনি ظاهر النص কে প্রাধান্য দিতেন ।
  • মহাগ্রন্থ আল কুরআনকে সর্বাগ্রে স্থান দিতেন ।
  • হাদীস দ্বারা দলীল গ্রহণের ক্ষেত্রে বর্ণনাকারীর নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করতেন ।
  • মদিনার হাদীসকে তিনি নিঃশর্তে গ্রহণ করতেন।
  • ইমাম আবু হানীফার মতো হাদীস مشهور হওয়া শর্ত করতেন না ।
  • হাদীসের ক্ষেত্রে مشهور ও متواتر এর দিকে বেশি লক্ষ্য না করে রাবীর বিশ্বস্ততা ও ন্যায়নীতির ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতেন।
  • ইমাম মালেক (র)-এর মতো হাদীসের মর্মানুযায়ী আমল করা শর্ত করতেন না।
  • তাঁর দৃষ্টিতে হাদীসের পর ইজমার স্থান ।
  • তাঁর মতে ইজমা এর স্থান তাবেয়ীদের যুগ পর্যন্ত সীমিত।
  • কেয়াসের নীতি তিনি খুব কমই গ্রহণ করেছেন।
  • তিনি استحسان ও استسحاب الحال-এর দ্বারা দলীল গ্রহণ করতেন না; বরং استدلال পদ্ধতি গ্রহণ করে ফিকহ রচনা করেছেন।
  • ইমাম শাফেয়ী (র)-ই সর্বপ্রথম ফিকহের মূলনীতিকে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করেন।
  • حكم প্রদানের ক্ষেত্রে তিনি অনেকটা কঠিন নীতি গ্রহণ করেছেন ।
  • তাঁর ফিকহের মধ্যে কুরআন ও হাদীসকে واجب العمل রাখা হয়েছে।

সর্বশেষ : ইমাম শাফেয়ী (র) ছিলেন ফিকহশাস্ত্রের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। যাঁর অনুপম ও বর্ণাঢ্য জীবনকর্মের ফলাফল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় অনবদ্য শাফেয়ী মাযহাব। হানাফী মাযহাবের পরে তাঁর মাযহাব ইসলামের শরয়ী বিধান আল ফিকহের দ্বিতীয় বৃহত্তম মাযহাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ফিকহশাস্ত্রে অনন্য অবদানের জন্য ইসলামের স্বর্ণালি ইতিহাসে তিনি চির অম্লান ও চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন।

আরো পড়ুন : কুদুরী গ্রন্থ প্রণেতার জীবনী ও কুদুরী গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য

আমার মূল লক্ষ্য একটাই (Sikkhagar-শিক্ষাগার) ওয়েবসাইটের হাত ধরে “শিক্ষা হবে উন্মুক্ত ও বাণিজ্যমুক্ত”। এই প্লাটফর্মে থাকবে একাডেমিক প্রস্তুতি, ভর্তি প্রস্তুতি, চাকরি প্রস্তুতি, স্পেশাল স্কিল এবং ধর্মীয় শিক্ষাসহ নানাবিধ বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ।

Leave a Comment