উপস্থাপনা :
বিশ্বের গোটা মানবগোষ্ঠী ধারা পরম্পরায় এক আদম ও হাওয়া (আ) হতে জন্মলাভ এবং প্রতিটি মানবসন্তান অভিন্ন উপাদানে অস্তিত্ব লাভ করলেও সবাই এক সম্প্রদায়ভুক্ত নয়। চিন্তা-বিশ্বাস, নীতি-আদর্শ, স্বভাব-প্রকৃতি এবং ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে মানুষ বিভিন্ন জনপদে বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এসব সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্ন কারণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মানসিকতা জন্মলাভ করে।
সাম্প্রদায়িকতা বিশ্ব শান্তি ও প্রগতির পথে এক মারাত্মক প্রতিবন্ধক। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, মুসলমানরা কখনোই সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে মানব সমাজে অনাসৃষ্টি করেনি বরং বিদেশি শাসক ও বিধর্মীরাই সংকীর্ণ স্বার্থে যুগে যুগে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশ সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত ছোবলে বহুবার রঞ্জিত হলেও বাংলাদেশ অদ্যাবধি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে।
দেখুন এটি : বাংলা প্রবন্ধ রচনা : যুদ্ধ নয় শান্তি চাই
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি :
জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষে মানুষে প্রীতি ও মৈত্রীর শান্তিময় বন্ধন হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। সামাজিক প্রশান্তি লাভের জন্য সকল অসাম্প্রদায়িকতা দূর করে সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা আবশ্যক। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আইনের চোখে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার এবং প্রত্যেকেই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকারী- এ সাংবিধানিক নীতিই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রক্ষাকবচ।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি :
বিশ্বের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রায় সকল দেশেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি লক্ষণীয়। প্রায় ৯০ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত, বাংলাদেশও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার এ ঐতিহ্য ধরে রেখেছে আবহমানকাল ধরে। হাজার বছরের ইতিহাসে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ মিলেমিশে এদেশে গড়ে তুলেছে এক সৌহার্দপূর্ণ ও সহনশীল সমাজ। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান বিভিন্ন ধর্ম ও জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ পারস্পরিক নির্ভরশীলতায় একে অপরের জন্য অপরিহার্যরূপে পাশাপাশি অবস্থান করে একান্ত আপনজনের মতো। এখনো পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের তুলনায় বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক আদর্শ স্থান।
দেখুন এটি : রচনা : ছাত্র রাজনীতি/ ছাত্র সমাজ ও রাজনীতি
সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ রোপণ :
চিরশান্তি ও সম্প্রীতির এ দেশে সম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষটি রোপিত হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলে। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী যে Divide and Rule Policy (বিভেদ ও শাসননীতি) গ্রহণ করেছিল তাতেই সম্প্রীতির ঐতিহ্য বিনষ্ট হয়। সুকৌশলে তারা হিন্দু ও মুসলমানের পারস্পরিক আস্থা বিনষ্ট করে দেয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় হিন্দু-মুসলমান দু’মেরুতে অবস্থান নেয়। পরবর্তীতে বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে সম্প্রদায়গত দূরত্ব আরো বৃদ্ধি পায় এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে সংঘটিত হয় মারাত্মক দাঙ্গা, যাতে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট কোলকাতায় মুসলমানদের শান্তিপূর্ণ সভায় হিন্দুদের আক্রমণে উভয়পক্ষে বহু হতাহত হয়।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় এ সাম্প্রদায়িকতা আরো মারাত্মক আকার ধারণ করে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কোনো ঘটনা পরিলক্ষিত হয়নি। এমনকি ১৯৯২ সালে ভারতের কট্টরপন্থি হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি অযোধ্যার ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেললেও বাংলাদেশের মুসলমানরা চরম সহিষ্ণুতা ও উদারতা প্রদর্শন করে। সম্প্রতি অতি উৎসাহী ও আবেগপ্রবণ কিছু লোক সম্প্রীতি বিনষ্টের পাঁয়তারা করলেও এ দেশের আলেম-ওলামা, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র-শিক্ষকসহ সর্বস্তরের জনতা এ সময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে।
সাম্প্রদায়িকতার কুফল :
গোটা দুনিয়া আজ সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে জর্জরিত। রাজনৈতিক হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যই বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধানো হয়। পৃথিবীতে যত যুদ্ধ-বিগ্রহ, হানাহানি এবং ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে তার মূলে রয়েছে সাম্প্রদায়িকতা। গুজরাট, কাশ্মীর, বসনিয়া, চেচনিয়া, ইসরাইল, ফিলিস্তিন, ইরান প্রভৃতি স্থানে যে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চলছে তার মূলে রয়েছে সাম্প্রদায়িকতা। সম্প্রতি মার্কিন মুলুকে বিমান হামলাকে কেন্দ্র করে বিশ্বের খ্রিস্টান সম্প্রদায় আফগানিস্তানসহ কতিপয় মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তা সাম্প্রদায়িকতারই ভয়াবহ প্রভাব।
দেখুন এটি : প্রবন্ধ রচনা – বাংলাদেশের গণতন্ত্র
আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে এ যাবৎ সতেরো’শ-র অধিকবার হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে। গুজরাট, আহমদাবাদ, কাশ্মীরসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে হাজার হাজার মানুষকে বলি হতে হয়েছে এসব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়। নিজ ধর্মকে রক্ষা করতে এ সভ্য যুগেও মানুষকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। অথচ মানুষ এ পৃথিবীতে এসেছে ধর্মের আগে, ধর্ম এসেছে মানুষের কল্যাণের জন্য- মানুষে মানুষে সংঘর্ষের জন্য নয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুষ্ঠু বিকাশের মাধ্যমে মানুষ হতে পারে মানুষের পরম আপনজন ।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার চেষ্টা :
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মহলের বিভিন্ন ধরনের চেষ্টা হয়েছে। বিশেষ করে বাংলার মুসলিম কবি সাহিত্যিকগণ তাঁদের লেখনীর মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছেন। ‘আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক’ গ্রন্থে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান লিখেছেন, “সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সাহিত্যরস উপভোগের বিঘ্নস্বরূপ- একথা অনুভব করেও বঙ্কিমচন্দ্র ‘রাজসিংহ’ রচনায় নিষ্কম্পচিত্ত ছিলেন।”
আধুনিক বাংলা কাহিনি কাব্যের ধারায় রঙ্গলাল, হেমচন্দ্র প্রমুখ কবি হিন্দু বীরের মাহাত্ম্য কীর্তনের জন্য মুসলমানকে প্রতিপক্ষরূপে ও হীন বর্ণে চিত্রিত করেন। এই পরিবেশে মুসলমান কবি কায়কোবাদই প্রথম কাহিনি কাব্যকার যিনি সাম্প্রদায়িক ক্ষুদ্রবুদ্ধিকে প্রশ্রয় না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন ।
দেখুন এটি : রচনা : জাতীয় চেতনায় ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব
হিন্দুরা যখন ‘স্বরাজ’, ‘স্বরাজ’ করে জোর আন্দোলন করছিল এবং কলকাতা ও ঢাকা নগরীতে মুসলমানদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করে তাদের খুন-জখম ও হত্যা করছিল। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি রক্ষায় লিখেছেন-
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ ।
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার ।
উপসংহার :
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সংঘাতমুক্ত সুন্দর পৃথিবী গড়ার এক অপরিহার্য প্রত্যয়, যার গুণে মানুষ আপন-পর ভেদাভেদ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত ভুলে ঐক্যবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিকের উচিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এ বন্ধনকে মযবুত করে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তোলা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলার আলো-বাতাস আমরা যেভাবে ভোগ করছি তেমনিভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে ভুলে দেশের উন্নয়নে সকলকে মনোনিবেশ করতে হবে। তাই বিশিষ্ট চিন্তাবিদ টমাস পাইলের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, “পৃথিবীটা আমার দেশ, সমস্ত মানবজাতি আমার ভাই এবং সবার ভালো করাই আমার ধর্ম।”