উপস্থাপনা :
বিংশ শতাব্দীর বর্তমান প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র একটি কাঙ্ক্ষিত ও জনপ্রিয় শব্দ। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে গণতন্ত্র চালু আছে। তাই এটি নিঃসন্দেহে জনপ্রিয় মতবাদ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। নাম হয়েছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। অপ্রিয় হলেও সত্য এই যে, বাস্তবতার নিরিখে বাংলাদেশের গণতন্ত্র অদ্যাবধি পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রেক্ষাপট একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়।
গণতন্ত্রের পরিচয় :
গণতন্ত্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ Democracy। এটি গ্রিক শব্দ Demos ও Kratia থেকে উদ্ভূত। Demos অর্থ- জনগণ এবং Kratia অর্থ— শাসন বা কর্তৃত্ব । সুতরাং Democracy মানে জনগণের শাসন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ গণতন্ত্রের বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। যেমন-
অধ্যাপক শেলী বলেন– Democracy is a government in which every one has a share. C. F. Strong এর মতে, “শাসিতের সক্রিয় সম্মতির ওপর যে সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত তাকে গণতন্ত্র বলে।”
গণতন্ত্র সম্পর্কে আব্রাহাম লিংকন বলেছেন- Democracy is a government of the people by the people and for the people.
আরও পড়ুন : রচনা : বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য – Class 6, 7, 8, 9, 10
গণতন্ত্রের ধরন :
গণতন্ত্র সাধারণত দু’ধরনের হতে পারে । যথা- ১। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র, ২। পরোক্ষ গণতন্ত্র ।
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র : যে শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সমবেত ও প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করে, তাকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বলা হয়। প্রাচীন গ্রিসে এ ধরনের গণতন্ত্র চালু ছিল।
পরোক্ষ গণতন্ত্র : যে শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রের নাগরিকরা নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধিদের হাতে দেশের শাসনক্ষমতা হস্তান্তর করে এবং এ সকল প্রতিনিধি জনগণের পক্ষ হতে ক্ষমতা প্রয়োগ করেন, তাকে পরোক্ষ গণতন্ত্র বলে। আমাদের দেশে এ ধরনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত।
গণতন্ত্রের গুণাবলি :
১ । ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, ধনী, দরিদ্র, নারী, পুরুষ সবাইকে একই দৃষ্টিকোণ হতে দেখা হয় ৷
২। সকলের সমান অধিকার সুনিশ্চিত করা হয় ।
৩। সরকার জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে ।
৪ । আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
৫। জনগণ ও সরকারের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকে ।
৬। মানুষ হিসেবে সবাই প্রকৃত মর্যাদা লাভ করে।
৭। নাগরিকের প্রতিভা ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযোগ বিদ্যমান থাকে ।
আরও পড়ুন : বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প রচনা (২০ পয়েন্ট) SSC, HSC- pdf
গণতন্ত্রের ত্রুটি :
ক. জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধি যদি অযোগ্য ও দুর্নীতি পরায়ন হয়, তাহলে দেশ পরিচালনায় বিপত্তি দেখা দেয়।
খ. নির্বাচকমণ্ডলী ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে না ওঠে বিত্তবান, অযোগ্য ও স্বার্থপর ব্যক্তিকে নির্বাচিত করলে গণতন্ত্র ব্যাহত হয় ।
গ. অশিক্ষিত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অসচেতনতা এবং গণতন্ত্রের মর্ম উপলব্ধি না করার ফলে তাদের অধিকাংশ ভোটে অযোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
গণতন্ত্রের সুফল :
গণতন্ত্র এমন এক ধরনের সরকার যা জনগণের কল্যাণে জনগণ কর্তৃক পরিচালিত জনগণের জন্যই গঠিত হয়। তাই গণতন্ত্রের সুফল সুদূরপ্রসারী। গণতন্ত্রে জনগণের জীবনমান উন্নয়ন, দেশের সমৃদ্ধি সাধন, পরিকল্পনা গ্রহণ ও প্রণয়ন এবং নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে জনগণের সুযোগ-সুবিধার দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখা হয় ।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র চর্চা :
বাংলাদেশের মানুষ অধিকার আদায়ে অঙ্গীকারবদ্ধ। ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০-এর নির্বাচন, ‘৭৩-এর নির্বাচন, ‘৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন এসবই গণতান্ত্রিক মানসিকতারই প্রতিফলন।
স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক চেতনা শাণিত হচ্ছে। ‘৯০-এর দশকের স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের দিকে তাকালে গণতন্ত্রের চারাগাছ শাখা-প্রশাখায় ফুলে ফলে সুশোভিত হতে যাচ্ছে বলে আশার আলো পরিলক্ষিত হয়।
আরও পড়ুন : বাংলাদেশের ঐতিহাসিক নিদর্শন – প্রবন্ধ রচনা
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাস :
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর এদেশবাসী প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ করেও তা বজায় রাখতে পারেনি। যার ফলে সৃষ্টি হয় স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। একপর্যায়ে জনগণের রায় উপেক্ষা করলে গণতন্ত্রের অপমৃত্যু হয়। কিন্তু গণতন্ত্রপ্রেমী জনগণ বসে থাকেনি। ১৯৪৭ সালের পর থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলন তারই সাক্ষী। এরপর ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ সালে স্বাধীন ভোট প্রয়োগের মাধ্যমে আবার এ দেশে গণতন্ত্রের পথ চলা শুরু।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের রূপরেখা :
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু নির্ভেজাল গণতন্ত্র বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। রক্তে কেনা গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে। ব্যালটের পরিবর্তে বুলেট হয়ে পড়ে ক্ষমতার চাবিকাঠি। স্বাধীন মত প্রকাশের মাধ্যম ভোটব্যবস্থা হয় দারুণভাবে উপেক্ষিত। কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারে না জনগণ। সুষ্ঠু নির্বাচন নির্বাসিত হয় বাংলাদেশের মাটি থেকে ।
গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণ :
বাংলাদেশের মানুষ অধিকার আদায়ে বার বার সচেতন হয়ে উঠেছে। স্বৈরাচারী সরকারের অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভিত নড়ে ওঠে এ দেশের মানুষের স্লোগানে, সংগ্রামে। রাজপথে রক্ত ঝরে। সেই রক্তবীজের অঙ্কুর থেকেই গণতন্ত্রের বিজয়বৃক্ষ বেড়ে ওঠে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ :
বাংলাদেশের গণতন্ত্র অনেক রক্তে কেনা। কিন্তু অসংখ্য সমস্যা আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে পর্যুদস্ত করে দিয়েছে। অতীতের তিক্ত ও রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা থেকে এ দেশের মানুষের অর্জিত গণতন্ত্রকে মর্যাদা দিতে হবে। যে কোনো স্বৈরাচারী ও সুবিধাবাদী অশুভ শ্রেণির অপতৎপরতা রোধ করতে পারলে এ দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ আশাদীপ্ত।
আরও পড়ুন : বাংলাদেশের লোকশিল্প : প্রবন্ধ রচনা
অর্থ ও সন্ত্রাসের কবলে গণতন্ত্র :
অপ্রিয় হলেও সত্য, বাংলাদেশে গণতন্ত্র আজ অর্থ ও সন্ত্রাসের কবলে জিম্মি হয়ে আছে। নির্বাচনের প্রাক্কালে অর্থের ছড়াছড়ি, অস্ত্রের ঝনঝনানি, হত্যা, রাহাজানি, পেশীশক্তির দাপট, ব্যালট ডাকাতি ইত্যাদি গণতন্ত্রের বুকে ছুরিকাঘাত করে যাচ্ছে।
গণতন্ত্রের সফলতার উপায় :
প্রথমত : গণতন্ত্র সফল করতে হলে জনগণকে অবশ্যই গণতান্ত্রিক মানসিকতা পোষণ করতে হবে ।
দ্বিতীয়ত : গণতন্ত্র চর্চার জন্য জাতিকে সুশিক্ষিত করতে হবে ।
তৃতীয়ত : আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রতিটি নির্বাচন সুষ্ঠু করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
চতুর্থত : জনগণসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে ।
পঞ্চমত : গঠনমূলক সমালোচনা ও পরমত সহিষ্ণুতা গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য অপরিহার্য বিষয় ।
উপসংহার :
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার অনাবিল ও সুন্দর মাধ্যম। শুধু গণতন্ত্রের বুলি আওড়ালেই গণতন্ত্রের স্বাদ আস্বাদন করা যাবে না; বরং এর জন্য চাই গণতন্ত্র চর্চা ও অনুশীলন। তাই আমাদের শাণিত উচ্চারণ হোক ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক ।
আরও পড়ুন : লোডশেডিং – বাংলা প্রবন্ধ রচনা