উপস্থাপনা : সপ্তদশ শতকের অন্যতম প্রগতিশীল কবি আবদুল হাকিম ছিলেন স্বদেশ ও স্বভাষার প্রেমিক কবি। কবি কাব্যনির্ভর মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে, নিজ ভাষার প্রতি অকৃত্রিম দরদ প্রকাশ করেছেন তার অবিস্মরণীয় ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি’ কবিতার মাধ্যমে।
এ কবিতায় কবি তাঁর মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি সুগভীর অনুভূতি ও আন্তরিক বিশ্বাসের কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। কালের বিচারে আবদুল হাকিম মধ্যযুগীয় হলেও মেধা ও মননে তিনি আধুনিকতার ছোঁয়ায় সিক্ত করেছেন তাঁর ‘নূরনামা’ কাব্যগ্রন্থটি। এ কাব্যগ্রন্থেরই শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি ।
যে সবে বঙ্গেত জন্মি কবিতার মূলভাব/সারমর্ম
মূল ভাব/সারমর্ম : আবদুল হাকিমের আলোচ্য কবিতাটিকে বিষয়বস্তু ও সারমর্মের বিচারে নিম্নোক্তভাবে আলোচনা করা হলো :
বাংলা ভাষার প্রতি ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন : বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম যখন বাংলা কাব্যচর্চা শুরু করেন, তখন এ উপমহাদেশে আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষার প্রচলনই বেশি ছিল।
আরো পড়ো : বঙ্গভাষা কবিতার মূলভাব এবং প্রতি লাইনের ব্যাখ্যা
একশ্রেণির লোক বাংলা ভাষাকে হিন্দুয়ানী ভাষা বলে অবহেলা করতো; কিন্তু কবির মতে, ধর্মীয় ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। ভাষা মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। ভিন্ন ভিন্ন দেশের মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করে থাকে। এই ভাষা মহান স্রষ্টারই দান। কবির ভাষায়-
যেই দেশে যেই বাক্যে কহে নরগণ ।
সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন।।
এভাবে কবি তাঁর উদার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষার প্রতি ভ্রান্তধারণা ও অযৌক্তিক হিংসা- বিদ্বেষের অপনোদন ঘটিয়েছেন।
সব ভাষার প্রতি কবির শ্রদ্ধাবোধ : ভাব প্রকাশের প্রধান বাহন ভাষা আল্লাহর দান । দেশভেদে ও কালভেদে ভাষার পার্থক্য সূচিত হয়েছে। সাধারণ মানুষের বোধগম্যের জন্য কবি বাংলা ভাষার চর্চা করলেও আরবি, ফারসি, হিন্দি বা অন্যান্য ভাষার প্রতি তিনি কোনোরকম অবজ্ঞা প্রকাশ করেননি; বরং অকৃত্রিম শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন এভাবে-
আরবি ফারছি শাস্ত্রে নাই কোন রাগ ।
দেশী ভাষে বুঝিতে ললাটে পুরে ভাগ।।
পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা ও মহানবি (স)-এর গুণকীর্তন করা হয়েছে আরবি, ফারসি ভাষায় । তাই কবি এসব ভাষার প্রতিও শ্রদ্ধাশীল।
আরো পড়ো : খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কবিতার- মূলভাব/সারমর্ম/বিষয়বস্তু
স্বদেশি ভাষার প্রতি কবির গভীর অনুরাগ : স্বভাষা ও স্বভূমির প্রতি গভীর অনুরাগ এবং মমত্ববোধের কবি আবদুল হাকিম মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন অনেক বেশি বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলতে ও সাহিত্যচর্চা করতে যারা লজ্জাবোধ করে, তাদের প্রতি কবি তীব্র ক্ষোভ ও কটাক্ষ প্রকাশ করেছেন । কবির ভাষায়-
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে যারা বাংলা ভাষাকে ঘৃণা করে, তাদের জাতি, বংশ ও জন্য সম্পর্কে কবি সন্দিহান। দেশি ভাষায় বিদ্যার্জন ও সাহিত্যচর্চা করাটা যারা পছন্দ করে না, কবি বলেছেন, এসব লোকের দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যাওয়া উচিত। এ দেশের অন্ন, বস্ত্র, ফল-ফলাদি ও পানীয়তে তাদের কোনো অধিকার নেই ।
দেশি ভাষাচর্চার প্রভূত কল্যাণ ও উপকারিতা : দেশি ভাষাচর্চার কল্যাণ ও উপকারিতা সম্পর্কে কবি বলেছেন-
মাতা-পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।।
মাতা-পিতামহ থেকে যারা বংশানুক্রমে বাংলাদেশে বসবাস করছে, তাদের জন্য দেশি ভাষাচর্চাই হিতকর ও প্রভূত কল্যাণকর। নিজ ভাষায় মনের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করে এবং সাহিত্যচর্চা করে তারা দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদিত হতে পারে।
উপসংহার : কবি আবদুল হাকিমের ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি’ কবিতাটি সপ্তদশ শতকের বাংলা কাব্যজগতে একটি প্রতিনিধিত্বশীল কবিতা। এ কবিতায় কবি বাংলা ভাষায় কাব্য রচনার সপক্ষে জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। এতে কবির স্বদেশ ও স্বভাষার প্রতি গভীর অনুরাগ এবং অকৃত্রিম শ্রদ্ধা অনুরণিত হয়েছে। মোটকথা, মাতৃভাষাই হওয়া উচিত প্রতিটি জাতির সাহিত্যচর্চার মাধ্যম।
আরো পড়ো : ঐকতান কবিতার মূলভাব ও কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা
প্রশ্ন: ৷৷ বঙ্গদেশ ও বঙ্গভাষার প্রতি কবি আবদুল হাকিমের যে প্রগাঢ় মমতা প্রকাশ পেয়েছে তা ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি’ কবিতা অবলম্বনে আলোচনা কর।
অথবা, “কবি আবদুল হাকিম রচিত ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি’ কবিতায় মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি প্রগাঢ় মমত্ব প্রকাশ পেয়েছে” – আলোচনা কর।
অথবা, ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি’ কবিতায় কবির দেশ ও ভাষার প্রতি যে গভীর অনুরাগ প্রকাশ পেয়েছে তার পরিচয় দাও।
অথবা, ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি’ কবিতায় মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি কবির গভীর ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে- আলোচনা কর।
উপস্থাপনা : মধ্যযুগের অন্যতম প্রগতিশীল মুসলিম কবি আবদুল হাকিম বিরচিত ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি একটি অসাধারণ দেশপ্রেমমূলক কবিতা। দেশি ভাষা অনুধাবন ও চর্চাই যে পরম সৌভাগ্যের চাবিকাঠি, এমন আন্তরিক আস্থা ও বিশ্বাসের কবি আবদুল হাকিম।
সপ্তদশ শতকের কবি হয়েও তাঁর চিন্তা-চেতনায় আধুনিক বস্তুনিষ্ঠতার পাশাপাশি। গভীর দেশপ্রেম প্রকাশ পেয়েছে। বাংলাদেশে জন্ম নিয়েও যারা মাতৃভাষা বাংলাকে অবজ্ঞা করে, কবি তাদের প্রতি চরম ঘৃণা উচ্চারণ করেছেন। নিচে প্রশ্নালোকে বিস্তারিত আলোচনা উপস্থাপন করা হলো :
মাতৃভাষা বাংলার প্রতি ভালোবাসা :
নানান দেশে নানান ভাষা
বিনে স্বদেশীয় ভাষা
পুরে কি আশা?
কবিয়াল রামনিধি গুপ্তের মতো কবি আবদুল হাকিমও নিজের আত্মতৃপ্তি এবং সাধারণ বাঙালি পাঠকদের মাতৃভাষা চর্চায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য বাংলা কাব্য রচনায় নিবেদিত হওয়ার অভিলাষ ব্যক্ত করেন এভাবে-
তে কাজে নিবেদি বাংলা করিয়া রচন।
নিজ পরিশ্রম তোষি আমি সর্বজন।।
কবি গোঁড়া মাতৃভাষা প্রেমিক নন : মাতৃভাষার প্রতি কবি তাঁর গভীর উপলব্ধি ও মমত্ববোধের কথা ব্যক্ত করলেও আরবি, ফারসি, হিন্দি ভাষাসহ অন্যান্য ভাষার প্রতি তাঁর কোনো রাগ-বিরাগ নেই। কবির ভাষায়-
আরবি ফারছি হিন্দে নাই দুইমত।
যদি বা লিখয়ে আল্লা নবীর ছিফত।।
আরবি, ফারসি ভাষায় আল্লাহ ও মহানবি (স)-এর প্রশস্তি বর্ণিত হলেও আল্লাহ তায়ালা অন্য ভাষা বোঝেন না এমন নয়; বরং সব ভাষাই মহান আল্লাহর দান। মাতৃভাষা ও মাতৃভূমিপ্রেম ঈমানেরই একটি অঙ্গ। কবি আবদুল হাকিম সেই মাতৃভাষা প্রেমই এখানে প্রকাশ করেছেন তাঁর কবিতায় ।
মাতৃভূমির প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা ও মমত্ববোধ : মাতৃভূমি মায়ের মতোই স্নেহময়ী ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল। কবি তাই স্বদেশের প্রতি তার সর্বাত্মক আন্তরিকতা, ভালোবাসা ও মমত্ব প্রকাশ করেছেন মাতৃভাষায় কাব্যচর্চার মাধ্যমে।
আলোচ্য কবিতায় কবি দৃঢ় দেশপ্রেম ব্যক্ত করেছেন, মাতৃভূমিতে বসবাস করেও যারা মাতৃভাষাকে ঘৃণা করে তাদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যমে। মানুষ যে ভূমিতে বা যে মাটিতে ভূমিষ্ঠ হয়, সে ভূমি বা সে মাটিই হচ্ছে তার মাতৃভূমি। মায়ের কোলে শিশুটি যেমন হেসে-খেলে বড় হয়, তেমনি মাতৃভূমির আলো- বাতাস, ধূলিকণা গায়ে মেখেই একটি মানবশিশু পূর্ণাঙ্গ মানুষরূপে গড়ে ওঠে।
মাতৃভূমির এ অকৃত্রিম সম্পর্কের কথা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। মধ্যযুগের এ স্বনামধন্য কবিও স্বদেশ ভূমি এবং স্বদেশ মাতৃকাকে গভীরভাবে ভালোবাসেন ও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। মাতৃভূমির ঋণ পরিশোধ করার জন্যই কবি মাতৃভাষা চর্চায় আত্মনিয়োগ করেছেন ।
যারা বঙ্গদেশে জন্মলাভ করেও বঙ্গবাণীর প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করে, কবি তাদের জন্ম- পরিচয় সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে তাদের নিজ দেশ ছেড়ে অন্য কোনো দেশে চলে যাওয়ার ইঙ্গিত দেন এভাবে-
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায় ।
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়।।
এ সাহসী উচ্চারণের মধ্য দিয়ে কবি আবদুল হাকিম তাঁর গভীর দেশপ্রেমের অনুভূতিকে জীবন্ত করে তুলেছেন।
উপসংহার : কাব্যানুভূতির শেষলগ্নে কবি মাতা-পিতামহসহ বংশানুক্রমে লালিত দেশি ভাষার আধারেই সর্বস্তরের গ্রন্থ রচনা করে সর্বাধিক কল্যাণ ও উপকার লাভ করা যায় বলে দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করেছেন। মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও শ্রদ্ধার বাস্তব দলিল যে সবে বঙ্গেত জন্মি কবিতাটি। এটি মধ্যযুগে আধুনিক বস্তুনিষ্ঠ চেতনার হিপ্রকাশের একটি প্রতিনিধিত্বশীল কবিতা ।