শীতের সকাল - রচনা : ২০ পয়েন্ট

(toc) Table Of Contens

উপস্থাপনা :

শেষ রাতে শিশিরের টুপ-টুপ শব্দে মনে হয় বাইরে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। অদূরে মসজিদ থেকে ভেসে আসা মুয়াযযিনের সুমধুর আহ্বান জানিয়ে দেয় ভোরের আগাম বার্তা। সাথে সাথে পাখিদের কলকাকলি ঘোষণা করে সোনালি প্রভাত। কুয়াশার চাদরে ঢাকা প্রকৃতি, কনকনে হিমেল হাওয়া প্রমাণ করে এটা শীতের সকাল ।

সূর্যোদয়ের পূর্বের শীতের সকাল : 

লেপের তলা থেকে উঠি উঠি করেও উঠতে ইচ্ছে হয় না। শিয়রে হিংস্র শীত কেশর ফুলিয়ে থাবা পেতে বসে থাকে। গরম বিছানার আরামদায়ক উত্তাপ ছেড়ে উঠতে গেলে দুর্নিবার আলস্য সমস্ত চেতনাকে ঘিরে ধরে। কর্মের আহ্বান সত্ত্বেও এক সুন্দর জড়তায় মানুষ আরামের শয্যায় পড়ে থাকে ।

কুয়াশাবৃত সকাল : 

তীব্র শীতের কামড় উপেক্ষা করে মসজিদ পানে ছোটে ধর্মপ্রাণ মুসল্লি। সাথে অন্যদের তাড়া দিয়ে যান বিছানা ত্যাগ করার। কিন্তু কাঁথার ভেতর থেকে উঠি উঠি করেও উঠতে ইচ্ছে করে না। 

তন্দ্ৰা বিজড়িত চেতনায় দূর বনান্তরাল হতে পাখিদের কলতান শোনা যায়, শোনা যায় বাতাসে ভেসে আসা পথচারীদের দু'একটি বিচ্ছিন্ন সংলাপ । আলোক-পিয়াসী প্রাণ চঞ্চল শিশুদের কল কোলাহলে আর বিছানায় থাকা যায় না। বাইরে এসে দেখি কুয়াশার চাদরে মুখ লুকিয়ে আছে গোটা প্রকৃতি ।

শীতের সকালের আকর্ষণ : 

শীতের সকালে গ্রামে বা শহরে সর্বত্র খেজুরের রস এবং রসের পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। ভোরের রোদে বসে দল বেঁধে মুড়ি-মুড়কি খাওয়া, পিঠা-পায়েসের স্বাদ নেয়া অতুলনীয়। গাছি সকালে খেজুর গাছ থেকে হাঁড়ি নামায়। টাটকা রসের স্বাদ শীতের সকালের অন্যতম আকর্ষণ । কবি সুফিয়া কামাল শীতের সকালে পিঠা খাওয়ার আনন্দ প্রকাশ করেন এভাবে-

“পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশিতে ভীষম খেয়ে

আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।”

আরও পড়ুন :- শীতের সকাল - রচনা [ Class - 6, 7, 8, 9 ,10 ]

আলোকিত শীতের সকাল : 

পূর্বদিগন্তে ধীরে ধীরে আলো ফুটতে থাকে। উত্তরে হিমগর্ভ বাতাস একটি দীর্ঘশ্বাসের মতো বনের গাছগুলোর পাতার ফাঁক দিয়ে বয়ে যায়। টুপ টুপ করে ঝরে পড়ে ভোরের শিশির। ঘাসে ঘাসে শিশির বিন্দু ঝলমল করতে থাকে প্রভাত রবির কিরণ স্পর্শে। দূর থেকে ভেসে আসছে জ্বাল-দেয়া খেজুর রসের লোভনীয় মিষ্টি মধুর গন্ধ।

গ্রামের রাস্তায় কৃষাণেরা বলদ নিয়ে চলছে মাঠের দিকে ক্ষেত প্রস্তুত করতে। এদিকে সর্ষের ক্ষেতে মৌমাছিদের গুঞ্জরণ শুরু হয়ে গেছে। দূরে গ্রামের মক্তবে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এক বিচিত্র সুরে সূরা-কেরাত ও দোয়া-দরূদ মুখস্থ করছে।

শীতের সকালের রূপ : 

পূর্বদিকে ধীরে ধীরে আলো ফুটতে থাকে।গ্রামের কৃষকরা চাদর গায়ে দিয়ে বলদ নিয়ে মাঠে যায়। ধীরে ধীরে শীতের সকাল কর্মব্যস্ত হয়ে ওঠে। পূর্ব দিগন্তে সূর্যের রথ আকাশ পরিক্রমায় বের হয়ে পড়ে। শীতের সকাল যেন এক প্রৌঢ়া কুলবধূ। তার মুখখানি দিগন্তবিস্তৃত কুয়াশার অবগুণ্ঠনে ঢাকা ।

শীতের সকালের অবগুণ্ঠন উন্মোচন : 

পূর্বদিগন্তে ইতোমধ্যে কুয়াশার আবরণ ভেদ করে সূর্যের রথ আকাশ পরিক্রমায় বের হয়ে পড়েছে। মাঠের মাঝখানে রিক্তপত্র বাবলার ডালে রোদ পোহায় একটি নীলকণ্ঠ পাখি। একজোড়া ফিঙে মনের আনন্দে সকালের আলোয় হাবুডুবু খায়। বেলা বাড়তে থাকে। শীতের সকালও তার অবগুণ্ঠন ধীরে ধীরে উন্মোচন করতে থাকে ।

ত্যাগের মূর্তি : 

হাতে তার বৈরাগিণীর একতারা। সে তার সেই একতারার নিঃসঙ্গ তারে হানে নির্মম আঘাত। ফলে বনের শুষ্ক পাতাগুলো করুণ বেদনায় একে একে ঝরে পড়ে। বনের ভেতর শুষ্ক ঝরা পাতার জীর্ণ কবর রচিত হয়। তার ওপর দিয়ে উত্তরের হিমেল হাওয়া হাহাকার করে কেঁদে যায়। 

কোথাও আমের মুকুল ছুঁইয়ে ঝরে শিশিরের কান্না, কোথাও বাতাসের বুক চিরে আর্তনাদ করে যায় একটি নিঃসঙ্গ শঙ্খচিল। এদিকে পাকা ধান কেটে দিগন্ত প্রসারিত মাঠখানিকে কৃষাণেরা রিক্ত করে তোলে। মাঠে মাঠে কলাইয়ের সবুজ ঘ্রাণ, কুয়াশার গন্ধ, পাকা ধানের গন্ধ, খেজুর রসের গন্ধ যেন ধরণীর মাটির পাত্রটিকে ভরে তুলছে কানায় কানায়।

আরও পড়ুন :- বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য - বাংলা প্রবন্ধ রচনা : ২০ পয়েন্ট

শীতের সকালে কৃষাণ-কৃষাণীরা : 

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। বিশেষ করে এ দেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষগুলো কৃষির ওপরই নির্ভরশীল। শীতকাল ফসল ফলানোর উপযুক্ত সময়। কৃষকেরা ভোরে শীতের কনকনে ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে ছুটে যায় ফসলের মাঠে। অক্লান্ত পরিশ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে ফলায় শস্যদানা ভুরি ভুরি। এদিকে কৃষাণীরাও বসে নেই। ক্ষেতে কর্মব্যস্ত মানুষগুলোর জন্য তারা তৈরি করেন নানা পিঠা-পুলি কিংবা খেজুর রসের পায়েস।

শীতের রূপ বদল প্রক্রিয়া : 

শীতকালে সময়ের আবর্তন এবং প্রকৃতির রূপ বদল প্রক্রিয়া কিছুটা বিচিত্র ধরনের। সাধারণত সূর্য উদয়ের মধ্য দিয়ে ভোর হয়। কিন্তু শীতকালে ভোর হয় বটে, সূর্য থাকে কুয়াশার আড়ালে মুখ লুকিয়ে। তারপর আস্তে আস্তে কুয়াশার ঘোর কেটে বেলা বাড়তে থাকে।

শীতের সূর্য পূর্বাকাশের কুয়াশার জাল ছিন্ন করে পরম উদাসীনতায় ওপরে উঠতে থাকে। সূর্যের কিরণ বাণে পর্যুদস্ত হয় শীতের তীব্রতা। হঠাৎ নিজের অজান্তেই যেন সূর্যটা চলে যায় পশ্চিম গগনে। মধ্যাহ্নের সমাপ্তিরেখা টেনে ঘোষণা করে নির্জন সন্ধ্যার ।

শীত সকালের উপভোগ : 

শীত সকালে চিড়া-মুড়ি খেতে খুব ভাল লাগে। কোচর ভরা চিড়া-মুড়ি নিয়ে শীতের সকালে রোদকে উপভোগ করার দৃশ্য গ্রাম বাংলায় প্রায়ই দেখা যায়। এ সময় ঘরে ঘরে হরেক রকম পিঠা তৈরি হয় । শীতে গরম পিঠা খেতে ভারী মজা, খেজুর রসের আমদানী খুব বেশি। খেজুর রসের গরম পায়েস মজাদার খাদ্য ।

শীতের সকালের প্রকৃতি : 

শীতের সকাল আসে ধীর লয়ে। যেন তার কোনো ব্যস্ততা নেই। শীতকালে বাংলাদেশে প্রচুর শাকসবজি জন্মে। মাঠে মাঠে সেই শাকসবজি সবুজ শাখা বিস্তার করে প্রকৃতিকে কোমল করে তোলে। ঘাসের ডগায় ও সবজি পাতায় রাতের শিশির কণা সকালের সূর্যালোকে ঝলমল করে হাসতে থাকে। শীতকালে নদীনালা, খালবিল, পুকুরডোবা শুকিয়ে যায়। 

শীতের সকালে নদীকে দেখে মনে হয় যেন শীতের ভয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে এক শান্ত সুবোধ বালিকার মতো। গাছপালা পত্রশূন্য বলে প্রকৃতির সর্বত্রই বৈরাগ্যের ভাব ফুটে ওঠে। শীতের সকালে কুয়াশা থাকায় নদীর বুকে নৌকা চলাচল কম থাকে । চরে আটকে যাবার ভয়ে লঞ্চ, স্টীমার ও ফেরিগুলো চলাচল বন্ধ রাখে  

শীতের সকালে গরিব লোকের অবস্থা :

শীত যেমন আনন্দের ঋতু তেমনি কষ্টেরও। গরিব লোকেরা গরম কাপড় কিনতে পারে না বলে শীতের সকালে তাদের দুঃখকষ্টের সীমা থাকে না। আবার এমনও অনেক লোক আছে যাদের ঘরবাড়ি নেই, শহরে ফুট ফরমাস খাটে আর রাতে ঘুমায় রাস্তার ফুটপাতে। তাদের জন্য শীত এক অভিশাপ ।

আরও পড়ুন :- বাংলা প্রবন্ধ রচনা : বাংলাদেশের কৃষক - ১৫ প্যারা

শীতের সকালের উপকারিতা : 

শীতকালে কোনো খাদ্যই গরমকালের মতো সহজে নষ্ট হয় না। টাটকা শাকসবজি ও বিভিন্ন ফলমূল পাওয়া যায়। শীতের সকালে কাঁধে ভাড় নিয়ে লোকেরা বাড়ি বাড়ি খেজুরের রস বিক্রি করতে আসে। শীতের সময় খেজুরের রস পান করে পরিতৃপ্তি লাভ করা যায়। সকালে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থেকে বেশ আরাম পাওয়া যায়। শীতের সকালে মিষ্টি রোদ দারুণ প্রশান্তি নিয়ে আসে। রোদে বসে গল্পগুজবের মধ্যে দিয়ে শীতের সকাল বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে।

কর্মচঞ্চলতা : 

শীতের সকালটা যেন এক প্রৌঢ়া কুলবধূ। দিগন্ত বিস্তৃত কুজঝটিকা অবগুণ্ঠনে মুখ ঢেকে সে দিগন্তের গাঁ ঘেঁষে স্থির মন্থর পায়ে চলতে থাকে। তার আপাদমস্তক কুয়াশার গাঢ় আস্তরণে ঢাকা। বেলা বাড়তে থাকে। শীতের সকালও তার কুহেলিকার আবরণ ধীরে ধীরে খুলতে থাকে। কর্মচঞ্চলতায় মুখরিত হয়ে ওঠে চারদিক।

গ্রামে শীতের সকাল : 

বাংলাদেশের দরিদ্র সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই গ্রামে বাস করে। গ্রাম্য জনগণের জন্য শীতের সকালটা বড়ই পীড়াদায়ক। তাদের শীত নিবারণের উপযুক্ত গরম কাপড় নেই, নেই কোনো গরম আশ্রয়স্থল। নাড়ার আগুনই তাদের একমাত্র সম্বল। শীতের তীব্রতা উপেক্ষা করে গ্রামের মানুষ জীবিকার সন্ধানে বের হয় মাঠে-ঘাটে।

শহরে শীতের সকাল : 

শহরে শীতের সকালের ভিন্ন দৃশ্যপট দেখা যায়। কাক-ডাকা ভোরে শহরে শীতের সকালের ঘুম ভাঙে। সেখানেও শিশির পড়ে। তবে গ্রামের অনাবৃত দিগন্ত বিস্তৃত প্রকৃতির শীতের সকাল যে সৌন্দর্য মহিমায় সেজে ওঠে, শহরের ইট- পাথর ঘেরা কৃত্রিম পরিবেশে তার আভাষ নেই। 

নিত্যদিনের কর্মচঞ্চলতা নিয়ে জেগে ওঠে শহরবাসী। তবু কুয়াশার বুক চিরে যখন ভোরের যন্ত্র শকট সশব্দে ক্রমাগত চলতে থাকে তখন সত্যিই অপূর্ব লাগে। রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকান ও ভাঁপা পিঠার দোকানগুলোতে জমে ওঠে ভিড়।

শীতের আগমন : 

পৌষ মাঘ দুমাস শীতকাল। তার তাপবিরল রূপমূর্তির মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে এক মহামৌনী তপস্বীর তপশ্চর্যা এবং অনন্ত বৈরাগ্যের ধূসর অঙ্গীকার। বিবর্ণ কাননবীথির পাতায় পাতায় নিঃশেষে ঝরে যাবার নির্মম ডাক এসে পৌছায়। এক সীমাহীন রিক্ততায় অসহায় ডালপালাগুলো একদিন হাহাকার করে কেঁদে ওঠে। 

তাকে সব দিয়ে দিতে হয়, দিয়ে যেতে হয়। ওদিকে ধান কাটা মাঠে কী সীমাহীন শূন্যতা, কী বিশাল কারুণ্য। ত্যাগের কী অপরূপ মহিমা! এ সময়ে কমলা, কলা, কুল, পেঁপে প্রভৃতি ফল ও গোলাপ, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া প্রভৃতি ফুল পাওয়া যায় ।

মানব মনে শীতের সকালের প্রভাব : 

শীতের সকাল মানব মনে বেশ প্রভাব বিস্তার করে। শীতের তীব্রতা মানুষের দেহকে ক্ষণকালের জন্য আড়ষ্ট করে ফেললেও বাড়িয়ে দেয় মনের সজীবতা। শীতের উষ্ণ সকাল কর্মে অদম্য স্পৃহা যোগায়, সারাদিন মানুষ কাজে ব্যাপৃত হতে তেমন ক্লান্তি অনুভব করে না।

উপসংহার : 

ঋতু বৈচিত্র্যের এ দেশে শীতের সকাল আবির্ভূত হয় তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে। উত্তরের হিমেল হাওয়ার পরশ নিয়ে আসে শীতের সকাল। নিঃশব্দে গাছের পাতা ঝরে, বৃক্ষেরা ধূসর রূপ ধরে নির্জনে দাঁড়িয়ে থাকে। ভোর হয় কুয়াশার চাদর জড়িয়ে। আর শীত যখন তীব্র হয়, আগুনের কুণ্ডলি জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে পোহাতে মানুষ দেখে বসন্তের স্বপ্ন ।

Post a Comment

0 Comments

Bottom Post Ad