ভাবসম্প্রসারণ: দুঃখের মতো এমন পরশ পাথর আর নেই(২টি)

উৎস : সুখ-দুঃখ সহোদর ভাই। সুখ-দুঃখের হাত ধরেই মানুষ পৃথিবীতে আসে। আঁধারের পর যেমন আলো থাকে তেমনি দুঃখের পরও সুখ থাকে ।

মূলভাব : দুঃখের আঘাতে মানুষের ভেতরের মনুষ্যত্ব বেরিয়ে আসে। দুঃখের পরশ ছাড়া পৃথিবীতে কেউ সুখী হতে পারে না। দুঃখ এক পরশ পাথর যার ছোঁয়ায় জীবন সঠিক ও সুন্দর হয় ।

সম্প্রসারিত ভাব : সোনা যেমন পুড়ে পুড়ে খাঁটি হয় মানুষও তদ্রূপ দুঃখের অনলে পুড়তে পুড়তে খাঁটি হয় । দুঃখের পরশে মানুষ হয় অনুপম প্রজ্ঞার অধিকারী । মানব চরিত্র পূর্ণ বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান দুঃখ । দুঃখ-কষ্ট, ত্যাগ-তিতিক্ষা ছাড়া প্রকৃত সুখ অর্জন সম্ভব নয় । পরশ পাথরের ছোঁয়ায় লোহা যেমন সোনায় পরিণত হয়। তেমনি দুঃখের পরশ পাথরের ছোঁয়ায় মানুষ হয় খাঁটি মানুষ । দুঃখের সংস্পর্শে এসেই মানুষ লাভ করে জীবনের চূড়ান্ত সার্থকতা। পৃথিবীতে যতো বড় সাফল্য আছে তার পেছনে ততো বড় দুঃখ ওঁৎ পেতে থাকে। বিখ্যাত ব্যক্তিগণের সাফল্যের পেছনে ছিল সীমাহীন দুঃখের করুণ ইতিহাস ।

মন্তব্য : বাংলা প্রবাদে বলে- 'কষ্ট ছাড়া কেষ্ট মেলে না।' দুঃখের আগুনে না পুড়লে সুখ ধরা দেয় না। দুঃখের আলোতে সুখ হয় উজ্জ্বল মহিমান্বিত ।

আরও পড়ুন : যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই যাহা পাই তাহা চাই না: ভাবসম্প্রসারণ

একই ভাবসম্প্রসারণের ভিন্ন প্রতিলিপন

মুলভাব : দুঃখের স্পর্শেই মানবসত্তা জাগ্রত হয়, জীবন হয় মানবিক বোধে আলোকিত। দুঃখের পরশেই মানুষের বিবেক মহান হয় এবং মানুষ সত্যিকার মনুষ্যত্ব লাভ করে।

সম্প্রসারিত ভাব : দুঃখ ও সুখ জীবনের কঠিন বাস্তবতার এপিঠ- ওপিঠ। দুঃখের পরে সুখ আসে এটাই জগতের চিরায়ত নিয়ম। দুঃখ ছাড়া প্রকৃত সুখ অর্জনের বিকল্প কোনো পথ নেই। দুঃখ ও সংগ্রামের মধ্যে মানুষ যখন সামনের দিকে এগিয়ে যায়, দুঃখকে জয় করে অগ্রসর হয়, তখন তার মধ্যে থাকে আনন্দ। দুঃখ যেন মানবজীবনের এক কঠিন পরীক্ষা। দুঃখের স্পর্শ মানুষকে দুঃখ-জয়ী হওয়ার শিক্ষা দেয়, সাহসী হওয়ার ভরসা দেয়, জীবনযুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার দীক্ষা দেয়। দুঃখই মানুষের সকল দৈন্য দূর করে তাকে খাঁটি মানুষে পরিণত করে। মনীষীগণ দুঃখকে পরশপাথরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। পরশপাথরের ছোঁয়ায় লোহা যেমন সোনায় পরিণত হয়, তেমনি দুঃখরূপ পরশপাথরের ছোঁয়ায় মানুষের সব গ্লানি দূর হয়ে যায়। বাংলা প্রবাদে আছে— “কষ্ট ছাড়া কেষ্ট মেলে না।' দুঃখ-কষ্ট, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অধ্যবসায় ছাড়া জীবনে প্রার্থিত স্বর্ণশিখরে আরোহণ অসম্ভব। প্রসঙ্গত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য- 'দুঃখই জগতে একমাত্র সকল পদার্থের মূল। মাতৃস্নেহের মূল্য দুঃখে, পতিব্রত্যের মূল্য দুঃখে, বীর্যের মূল্য দুঃখে, পুণ্যের মূল্য দুঃখে।' 

বস্তুত মানুষের জীবনে সুখ- দুঃখ পাশাপাশি বিরাজ করে। অনেকেই দুঃখে ভেঙে পড়ে। দুঃখবোধের যন্ত্রণায় কারো জীবন ব্যর্থ হয়ে যায়। কিন্তু সাহসী মানুষ দুঃখকে মোকাবিলা করে। তারা দুঃখকে দুঃখই মনে করে না; বরং দুঃখ দেখে সুখের সাধনায় নিয়োজিত হয়। বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে দুঃখকে জয় করে সুখকে ছিনিয়ে আনে। দুঃখ মোকাবিলা করার শক্তি দিয়েই মানুষ আপন শক্তির পরিচয় দিতে পারে। বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিবর্গের জীবনী পর্যালোচনা করলে এ সত্যের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। রুটির দোকানের নজরুল দুঃখ-দারিদ্র্যের এক বাস্তব উদাহরণ। জীবন চলার প্রতিটি পর্যায়ে দুঃখ-দারিদ্র্য তাঁকে কুরে কুরে খেয়েছে। বিনিময়ে তাঁকে দিয়েছে প্রতিষ্ঠা। তাই তাঁর মুখে ফুটে উঠেছে— 'হে দারিদ্র্য। তুমি মোরে করেছ মহান/তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিষ্টের সম্মান।' পৃথিবীর বহু মনীষী দুঃখকে বরণ করে নিয়েছিলেন বলেই আজও তাঁরা স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে আছেন ।

মন্তব্য : দুঃখ মানুষের সকল জড়তা ও দৈন্য দূর করে তাকে করে সুন্দর। দুঃখের ভেতর দিয়েই মানুষ জীবন-সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে। সুতরাং জাগতিক সকল প্রাপ্তির পূর্বশর্ত দুঃখের পরশ।

Post a Comment

0 Comments