উপস্থাপনা :
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মহান আল্লাহ মানুষের বসবাসের উপযোগী করেই এ পৃথিবীকে সাজিয়েছেন। কিন্তু সৃষ্টির সেরাজীব মানুষের অদূরদর্শীতা ও স্বার্থপরতার কারণে বিশ্ব পরিবেশ আজ ধ্বংসের মুখে। তাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার ও যুদ্ধংদেহী মনোভাব এ বিশ্বকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। এ ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বিশ্ব পরিবেশবাদীরা পরিবেশ সংরক্ষণে উদ্যোগী হন। অবশেষে পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে জাতিসংঘ ৫ই জুনকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।
পরিবেশ দূষণ কী :
‘পরিবেশ’ ও ‘দূষণ’ শব্দ দুটির সমন্বয়ে পরিবেশ দূষণ ধারণাটি গঠিত। দূষণ হচ্ছে এমন কিছু যা স্বাভাবিক অবস্থাকে বিঘ্নিত করে। আর পরিবেশ দূষণ হচ্ছে প্রাকৃতিক ব্যবস্থার কোনো একটি বা একাধিক অবস্থার বিঘ্নিত রূপ। প্রাকৃতিক সমুদয় উপাদান একটি নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করে। যখন কেউ উক্ত সীমারেখা অতিক্রম করে তখন পরিবেশ দূষণ ঘটে। Natural Environmental Research council (NERC) (১৯৭৬) এর মতে পরিবেশ দূষণ হলো— প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষের বিবিধ কার্যক্রমের ফলে বর্জ্য হিসেবে নির্গত পদার্থ ও জ্বালানীর সারাংশ যার পরিণতি হলো দূষণ ।
আরও পড়ুন : প্রবন্ধ রচনা : বিশ্বস্বাস্থ্য দিবস
পরিবেশ দূষণের কারণ :
পরিবেশ দূষণমুক্ত না থাকলে আমাদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবন বিপন্ন হয়। মানুষের স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই পানি, বায়ু, মাটি সবই আজ দূষিত হচ্ছে। পাশাপাশি শব্দদূষণের মাত্রা শহরাঞ্চলে ব্যাপক। শিল্প-কারখানার বর্জ্য, গ্যাস, জীবাশ্ম, জ্বালানী ইঞ্জিনের কালো ধোঁয়া, পারমাণবিক চুল্লির বিস্ফোরণ, পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা বা সামরিক মহড়া ইত্যাদি কারণে বিশ্ব পরিবেশ দিন দিন বিষাক্ত হচ্ছে। এর পরিণতিতে প্রতিবছর প্রায় ২০ কোটি টন কার্বন মনোক্সাইড বায়ুমণ্ডলে সঞ্চিত হচ্ছে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন- ডাই-অক্সাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি গ্যাসের আনুপাতিক হার ক্রমশ বাড়ছে ৷
বায়ুদূষণের পরিণাম :
এভাবে বায়ু দূষণের ফলে বৃষ্টির পানিতে এসিডের পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষিজমি ও ফসল, ধ্বংস হচ্ছে সবুজ বনানী। সারা বিশ্বের মোট ৮০ শতাংশ ছিল গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অরণ্য। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী গড়ে প্রতি মিনিটে ২০ হেক্টর অরণ্যের ধ্বংস প্রক্রিয়া চলছে। প্রতিবছর মরু হচ্ছে ৭০ লাখ হেক্টর জমি । ২০ হেক্টর কৃষিযোগ্য জমি মানুষ ও প্রকৃতির কারণে উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। বনভূমি ধ্বংস ও বিষাক্ত গ্যাসের কারণে বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন কমে গেছে।
পরিবেশ দূষণের ফলে মানুষ উদ্ভিদ জগতের পাশাপাশি প্রাণিজগতেও ধ্বংস ডেকে এনেছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মাত্র ৬০ বছরে প্রাণিজগতের ৭৬টি প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটেছে। মানুষ শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য জমিতে সার ও কীটনাশক ব্যবহার করছে। এতে শস্যের উৎপাদন বাড়লেও কৃষি জমির উর্বরতা হ্রাস এবং পানি দূষণ হচ্ছে। পরিবেশের জন্য উপকারী কীট-পতঙ্গ বিলুপ্ত হচ্ছে এবং জলজ প্রাণির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের অনুপ্রবেশ ঘটছে মানুষের শরীরে। বলা হয়ে থাকে, ৮০ শতাংশ নতুন রোগ সৃষ্টি হচ্ছে পরিবেশ দূষণের কারণে।
আরও পড়ুন : আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস – রচনা [ Class- 6, 7, 8 ,9 ,10, HSC ]
বিশ্ব পরিবেশ বিষয়ে সাম্প্রতিক তথ্য :
জলবায়ুর পরিবর্তন সম্পর্কে একটি উদ্বেগজনক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে— United Nations Inter Government Panel on Climate Change. জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক প্রোগ্রামের (UNEP) তত্ত্বাবধানে প্যানেলটি ২রা ফেব্রুয়ারি ২০০৭ তারিখে রিপোর্টটি প্রকাশ করে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১.৮° সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে এবং আগামী একশ বছরের মধ্যে সমুদ্রের উচ্চতা ৮৯ সে.মি. পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।
ফলে পৃথিবীর বহু জায়গা বন্যায় ভেসে যাবে বা প্রচণ্ড তুষারপাতে জমাট বেঁধে যাবে। বায়ুমণ্ডলের ওজোনস্তর ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে সূর্যের মারাত্মক অতি বেগুনি রশ্মি গোটা প্রাণিজগৎকে বিপন্ন করে তুলবে। এর ফলে এ পৃথিবী মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর বসবাসযোগ্যতা হারাবে।
বিশ্ব পরিবেশ দিবসের গুরুত্ব :
জনসাধারণকে সচেতন করার মাধ্যমে পৃথিবীতে মানুষের বাসোপযোগী অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা আজ অতি জরুরি। এক্ষেত্রে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কিত এ দিনটি তাই নিছক আনুষ্ঠানিকতার দিন নয়। শুধু বক্তৃতা বা আলোচনাও এর একমাত্র লক্ষ্য নয়। আমাদের উচিত, দিবসটির গুরুত্ব উপলব্ধি করা, পরিবেশ দূষণমুক্তির নতুন উপায় উদ্ভাবনে ব্রতী হওয়া। আর এতে শুধু সরকারই নয়, দেশের সচেতন জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। স্বার্থান্বেষী পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের অবিমৃষ্যকারিতার ফলে সমগ্র প্রাণিজগতে যে ভয়াবহ বিপদের সূচনা হয়েছে, তার প্রতিকার করতে না পারলে খুব শীঘ্রই মানবসভ্যতা ধ্বংসের মুখোমুখি হবে।
আরও পড়ুন : স্বাধীনতা দিবস – রচনা ১০০, ২০০ এবং ৫০০ শব্দ
১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রাজধানী রিও-ডি-জেনেরিওতে জাতিসংঘ ও পরিবেশ উন্নয়ন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যা ধরিত্রী সম্মেলন নামে পরিচিত। এতে বিশ্বের ১৭৮টি দেশের ১০ হাজার প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করে। উক্ত সম্মেলনে পরিবেশ বিপর্যয়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় এবং পরিবেশ সংরক্ষণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ২০০৫ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি ১৪৭টি দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ‘কিয়োটা প্রটোকল’, কিন্তু বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ পরিবেশ দূষণকারী যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ‘কিয়োটা প্রটোকল’-এ স্বাক্ষর করেনি। সুতরাং পরিবেশ দূষণ রোধ করতে হলে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক ও সুচিন্তিত কর্মসূচি গ্রহণ এবং তা কার্যকর করতে হবে।
ধনতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, উন্নত, অনুন্নত সব দেশকেই সমবেত উদ্যোগে পরিবেশ রক্ষায় ব্রতী হতে হবে। ভয়াবহ এই পরিবেশ দূষণের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপনের আহ্বান প্রকৃতপক্ষে, সমবেতভাবে বিশ্ববাসীকে দূষণমুক্তির কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ারই আহ্বান। আর যুদ্ধ নয় শান্তি, প্রকৃতির ধ্বংস নয় তাকে শ্যামল-সবুজ করে তোলা- এ হলো বিশ্ব পরিবেশ দিবসের তাৎপর্য ও গুরুত্ব । তাই বিশ্ব পরিবেশ দিবসের দাবির আলোকে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে।
বিশ্ব পরিবেশ দিবসের কর্মসূচি :
জাতিসংঘ প্রতিবছর এ দিবসটিতে পরিবেশ সম্পর্কে পৃথিবীর মানুষকে জেগে ওঠার আহ্বান জানায় । এ লক্ষ্যে দেশে দেশে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। দিবসটি উদ্যাপন উপলক্ষে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, র্যালিসহ বিভিন্ন জনসচেতনমূলক প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়। প্রতি বছরই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে অগণিত মানুষ মারা যাচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে ফসল। ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, খরা, বন্যা একের পর এক লেগেই আছে। জাতিসংঘ ঘোষিত পরিবেশ দিবসের আলোচ্যসূচিতে দুর্যোগকবলিত মানুষের জানমালের বিষয়টি যুক্ত হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম সংবাদ দিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দেওয়ার ব্যাপারেও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন : জাতীয় দিবস : বাংলা প্রবন্ধ রচনা
বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও বাংলাদেশ :
বাংলাদেশেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো প্রতিবছর ৫ই জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ পালিত হয়। পরিবেশ দূষণ রোধে বাংলাদেশ সরকার পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় নামে একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় গঠন করেছে। তারপরও অবশ্য বাংলাদেশ পরিবেশ রক্ষায় অনেক পিছিয়ে পড়েছে। এখনো এদেশের মানুষের মধ্যে পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। পরিবেশ রক্ষায় এদেশের মানুষ উদাসীন। তাই অবাধে চলছে বৃক্ষ নিধন ও পাহাড় কাটা । যত্রতত্র কলকারখানা গড়ে উঠছে। ফলে বায়ু দূষিত হচ্ছে। পানিতে দূষণের পরিমাণ বাড়ছে। পাহাড় কাটার ফলে মাটি ধসে শত শত লোক মারা যাচ্ছে। তাই সুষ্ঠু জীবনযাপন নিশ্চিত করতে দূষণমুক্ত পরিবেশ অত্যন্ত জরুরি। পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো-
ক. বন-বনানী ধ্বংস বন্ধ করা।
খ. ভূমিক্ষয় রোধ করা ।
গ. পাহাড় কাটা বন্ধ করা ।
ঘ. পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা।
কিন্তু বাংলাদেশে বনাঞ্চল অনেক কম থাকা সত্ত্বেও প্রতিবছর যে পরিমাণ বন ধ্বংস করা হচ্ছে, তার পরিবর্তে মাত্র ৫০ শতাংশ ভূমিতে নতুনভাবে বৃক্ষ রোপণের কাজ হচ্ছে। বাকি অর্ধেক পরিণত হচ্ছে বিরান ভূমিতে। তাই বিশ্ব পরিবেশ দিবসকে সামনে রেখে বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন ।
পরিবেশ দূষণ রোধে বাংলাদেশে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ :
বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণ রোধকল্পে ইতোমধ্যে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা হলো-
- বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফাণ্ড নীতিমালা প্রণয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফাণ্ড আইন ২০১০ প্রবর্তন।
- ২০১১ সালে দাতা দেশ/সংস্থাসমূহের সহায়তায় Bangladesh Climate Change Resilience Fund (BCCRF) গঠন।
- পরিবেশ রক্ষায় সরকার ১লা জানুয়ারি, ২০০২ ঢাকা শহরে এবং ১লা মার্চ, ২০০২ সারাদেশে পলিব্যাগ নিষিদ্ধকরণ।
- পরিবেশ দূষণ রোধে সিএনজি জ্বালানির ব্যবহার শুরু ।
- কালো ধোঁয়ার মাধ্যমে বায়ুকে দূষিত করার অন্যতম উৎস টু-স্ট্রোক যানবাহন । সরকার কর্তৃক তাই টু-স্ট্রোক যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করণ ।
- মেয়াদ উত্তীর্ণ যানবাহন নিষিদ্ধকরণ ।
- পরিবেশ ও বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ ।
- পরিবেশ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন ।
- পরিবেশ আদালত স্থাপন ।
- বুড়িগঙ্গা বাঁচাও কর্মসূচি গ্রহণ ।
- খাল পুনরুদ্ধার কর্মসূচি গ্রহণ ।
- পরিবেশ বিষয়ে গণমাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি ।
- পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদি ।
উপসংহার :
পরিবেশগত সমস্যা পৃথিবীতে মানুষের বসবাসযোগ্যতাকে অসম্ভব করে ফেলবে। এ সমস্যা ভৌগোলিক ও প্রজন্মগত সীমারেখা অতিক্রম করে। তাই পরিবেশ ঝুঁকি মোকাবিলায় বিশ্বের সকল দেশের মানুষকে একযোগে কাজ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্ব পরিবেশ দিবস সকলের মনে যেন এমন চেতনাই সৃষ্টি করে। তাই সকলের উচিত নিজেকে বিশ্ব পরিবেশের এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করা।
আরও পড়ুন : প্রবন্ধ রচনা : বিজ্ঞান ও আধুনিক সভ্যতা