হোম পদার্থ রসায়ন জীব ইসলামিক

প্রবন্ধ রচনা: দূষিত পরিবেশ ও বিপন্ন পৃথিবী

উপস্থাপনা :

মানবজীবনের জন্য পরিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মানুষের জীবনের বিকাশকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে পরিবেশ । ভালো পরিবেশ সুস্থ মানুষ আর খারাপ পরিবেশ অসুস্থ মানুষ তৈরি করে। পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্বের জন্য প্রথম ও প্রধান পূর্বশর্ত হচ্ছে সুস্থ প্রশান্ত পরিবেশ, কিন্তু নানাবিধ কারণে প্রতিনিয়ত আমাদের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।

বেঁচে থাকার জন্য যে সুস্থতার প্রয়োজন পরিবেশ ক্রমেই তা হারিয়ে ফেলছে। তাই সঙ্গত কারণেই বিশ্বব্যাপী মানুষ পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে; পাশাপাশি পরিবেশের সুস্থতা রক্ষার জন্য উদ্যোগী হয়ে উঠেছে। এ উদ্দেশ্যে সম্প্রতি ধরিত্রী সম্মেলন সমাপ্ত হলো।

পরিবেশের স্বরূপ :

আমরা যে স্থানে বসবাস করি সে স্থান এবং তার আশপাশের অবস্থাকে পরিবেশ বলা হয়। ঘরবাড়ি, দালানকোঠা, গাছপালা, নদীনালা, মাটি, বায়ু, বিষয়-সম্পত্তি এ সবকিছু মিলেই তৈরি হয় পরিবেশ। মানুষের আচার-ব্যবহার ও জীবনধারণ পদ্ধতি পরিবেশ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। আবার বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির ব্যবহারে সমাজ দ্বারাও পরিবেশ প্রভাবিত হয়।

আরও পড়ুন : পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার রচনা ( ২০ পয়েন্ট ) – PDF

পরিবেশ দূষণের কারণ :

পরিবেশ দূষণের নানাবিধ কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো- জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বনজসম্পদ হ্রাস, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহার, বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের অপব্যবহার, যুদ্ধ ও সংঘর্ষ এবং গ্রিন হাউস ইফেক্ট ইত্যাদি।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি :

জনসংখ্যা বৃদ্ধি পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। কারণ অপরিকল্পিতভাবে জনসংখ্যা বেড়ে চললে বাসস্থান, খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে সংকট দেখা দেয়। বাড়তি মানুষের চাহিদা মেটাতে বনজসম্পদ ধ্বংস, অবকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদির ফলে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাপ পড়ে। যার ফলে পরিবেশ দূষিত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটিরও বেশি যা স্বাধীনতার সময়কার জনসংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি। মাত্র ৪৫ বছরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণে উন্নীত হয়েছে।

শুধু রাজধানী ঢাকাতেই প্রায় দুই কোটি জনগণের বসবাস। যা ধারণক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি। ক্রমবর্ধমান মানুষের চাপ একটি লোকালয়ের প্রকৃতি ও পরিবেশ কতখানি বিনষ্ট করতে পারে তার উজ্জ্বল উদাহরণ আমাদের রাজধানী ঢাকা। পরিসংখ্যানবিদদের মতে এ শহরে অতিরিক্ত জনসংখ্যার পরিমাণ ১ কোটিরও বেশি। ঘর-বাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন, যাতায়াত, অবসর ও চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা এগুলো পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

আরও পড়ুন : শব্দ দূষণ ও তার প্রতিকার – বাংলা রচনা

কিন্তু রাজধানীর শতকরা ৯০ জনের জন্য তা নেই। বস্তুত দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও অভাব অনটন আমাদের পরিবারকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা ভেঙে ফেলেছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, শুধু রাজধানীর জীবনই নয়, গোটা বাংলাদেশের পরিবারকেন্দ্রিক সমাজজীবন এক বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। ফলে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।

বনজ সম্পদ হ্রাস :

বাঁচার পথ খুঁজতে গিয়ে মানুষ প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর নির্মম হস্তক্ষেপ করছে। পৃথিবীর সর্বত্রই এটা হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের অধিবাসীরা শিল্পায়নের জন্য বায়ুর ওজোনস্তরের মহাক্ষতি করছে, যা নিয়ে সারা বিশ্বই শঙ্কিত। অন্যদিকে অনুন্নত দেশের মানুষেরা জ্বালানির জন্য এবং বসতবাড়ি ও আসবাবপত্র নির্মাণের জন্য বনজ সম্পদের বিনষ্টি সাধন করছে। ফলে প্রতিনিয়ত পরিবেশ ভারসাম্য হারাচ্ছে।

রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহার :

ভালো ও উন্নত জাতের ফসল ফলানো এবং কীটপতঙ্গের হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য কৃষকেরা অপরিকল্পিত এবং ব্যাপক হারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করছে। এসব ব্যাপক হারে ব্যবহারের ফলে মাটি, পানি ও ফসল দূষিত হচ্ছে এবং জীবজগৎ, প্রাণিজগৎ এবং পরিবেশ দারুণ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।

আরও পড়ুন : প্রবন্ধ রচনা: বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও বাংলাদেশ

রাসায়নিক দ্রব্যের অপব্যবহার :

আমাদের পরিবেশ দূষণকারী দ্রব্যগুলোর মধ্যে সীসা, পারদ, সালফার-ডাই-অক্সাইড, কার্বন-মন-অক্সাইড ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে কতকগুলো আবার আমাদের মলমূত্র ও শরীরের পচন থেকে উৎপন্ন। এগুলো প্রতিনিয়ত বায়ু দূষিত করছে। এ বায়ুদূষণ চলছে সারা বিশ্ব জুড়ে। কার্বন থেকে শুরু করে ভারী ধাতু, জটিল জৈব যৌগ, জীবাশ্ম জ্বালানি, নিউক্লিয় আবর্জনা, ক্লোরোফ্লুরোমিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, আলোক রাসায়নিক ধোঁয়া ইত্যাদি বায়ুদূষণের প্রধান কারণ। এর ফলে আবহাওয়ার তাপমাত্রা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ফলে পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে।

যুদ্ধ ও সংঘর্ষ :

যুদ্ধ ও সংঘর্ষ জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি পরিবেশও দূষিত করে। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক অস্ত্রের জীবাণু মানবজীবন ও পরিবেশকে দারুণ প্রভাবিত করে। এর প্রমাণস্বরূপ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকির ওপর নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক বোমার কথা বলা যায়। তা ছাড়া ইরান ও ইসরায়েল যুদ্ধ । সিরিয়া, আফগানিস্তান ও ইরাকের ওপর ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী কর্তৃক ক্লাস্টার বোমা নিক্ষেপের কারণেও পরিবেশ দূষিত হয়েছে।

গ্রিন হাউস ইফেক্ট :

‘গ্রিন হাউস’ বা ‘সবুজ ঘর’ বলতে কাচে ঘেরা ঘরকে বোঝায়, যার ভেতরে সবুজ গাছপালা, শাকসবজি ইত্যাদি সীমিতভাবে চাষ করা হয়। কাচঘেরা ঘরে সূর্যের কিরণ সহজেই প্রবেশ করে, কিন্তু ভেতর থেকে বিকিরণ কাচ ভেদ করে বাইরে আসতে পারে না। ফলে গ্রিন হাউজের ভেতরে উত্তাপ বৃদ্ধি পায়। একইভাবে সূর্যরশ্মি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভেদ করে পৃথিবীপৃষ্ঠে সহজে পৌঁছে, কিন্তু পৃথিবী থেকে সব বিকিরণ সহজে মহাকাশে ফিরে যেতে পারে না। ফলে বায়ুমণ্ডলের উত্তাপ বৃদ্ধি পায়।

এক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার গ্যাস গ্রিন হাউজের কাচের মতো কাজ করে। শিল্প বিপ্লবের পর বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে এবং পৃথিবী ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। বিজ্ঞানীদের মতে, এ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ পৃথিবীর তাপমাত্রা ১.৫ থেকে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। এর ফলে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে।

আরও পড়ুন : পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার -রচনা [ Class – 6, 7, 8 ,9 ,10]- PDF

পৃথিবীর উপকূলভাগ প্লাবিত হবে। বাংলাদেশ, মালদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়ার মতো নিম্নাঞ্চল ডুবে যাবে। গ্রিন হাউস ইফেক্ট বৃষ্টিপাত, বায়ুমণ্ডল, মৌসুমি বায়ু, ঘূর্ণিঝড়, জোয়ার ও জলোচ্ছাস, কৃষি পদ্ধতি, শস্য উৎপাদন, বনাঞ্চল, মৃত্তিকার অবস্থা, ভূমি ব্যবহার, মৎস্য চাষ ইত্যাদির ওপর বিরুপ প্রভাব ফেলবে। এ অবস্থা চলতে থাকলে পৃথিবী একদিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।

প্রতিকার :

বস্তুত পরিবেশ দূষণরোধে এখনই জরুরিভিত্তিতে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কারণ গ্রিন হাউস গ্যাসসমূহের নির্গমন রোধ করা যেমন প্রয়োজন, তেমনি এগুলো সার্বক্ষণিক পরিমাপের পদ্ধতি এবং পৃথিবীতে এর প্রতিক্রিয়া নির্ণয়ের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। বস্তুত পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে হলে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। এজন্য পরিবেশ দূষণ-নিয়ন্ত্রণ বিভাগকে আরো শক্তিশালী করে প্রস্তাবিত পরিবেশ বিভাগের আওতায় পরিবেশগত ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাকে জোরদার করা দরকার।

এ ব্যাপারে গণসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচার মাধ্যম ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। এজন্য একটি পরিবেশ মনিটরিং সেল ও তথ্য কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে, গ্রহণ করা যেতে পারে একটি জাতীয় পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা, যাতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনাও থাকবে। তাছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল স্তরে পরিবেশ শিক্ষা অন্তর্ভুক্তির কথাও বিবেচনা করা যেতে পারে। তবেই আমরা পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে সক্ষম হব।

বিশ্ব পরিবেশ রক্ষার অঙ্গীকার :

২০১৫ সালের ৩০শে নভেম্বর থেকে ১১ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ সেন্টিগ্রেডের কম রাখার বিষয়টিকে সমর্থন করে। তবে দেশগুলো বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ সেন্টিগ্রেডের উপরে যাতে বৃদ্ধি না পায় সে লক্ষ্যে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ গ্রহণে সম্মত হয়।

উপসংহার :

আশার কথা, বাংলাদেশ সরকার এবং বিশ্ববাসী ধরিত্রী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার জন্য শুভ প্রতীতি ব্যক্ত করেছে এবং মতপার্থক্য থাকলেও এ ব্যাপারে যথাযথ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। সকল শ্রেণীর মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আমরা এর সুফল পেতে শুরু করব।

শিক্ষাগার

প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে

মাহমুদুল হাসান

শিক্ষাগত যোগ্যতা
গণিতে অনার্স ও মাস্টার্স

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

ফাজিল সম্পন্ন

গোপালপুর দারুল উলুম কামিল মাদ্রাসা

বিশেষ দক্ষতা

বাংলা সাহিত্য • গণিত • ইসলামিক শিক্ষা

অভিজ্ঞতা

শিক্ষকতা ও ৫+ বছর কন্টেন্ট রাইটিং

আমাদের লক্ষ্য

শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা সামগ্রী প্রদান করা। ২০২৩ সাল থেকে লাখো শিক্ষার্থী শিক্ষাগার থেকে উপকৃত হচ্ছে।

Leave a Comment