উপস্থাপনা :
মহানবি (স) তাঁর জীবনের শেষ হজ পালন করলেন দশম হিজরিতে। ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর দায়িত্ব তখন রাসূল (স)-এর শেষ পর্যায়ে। এ হজে তিনি তাঁর জীবনের শেষ আনুষ্ঠানিক ভাষণ দান করেন । এটি মহানবি (স) এর জীবনের শেষ ভাষণ হওয়ায় এ ভাষণকে বিদায় হজ এর ভাষণ নামে অভিহিত করা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে পরিচিত হয়ে আছে।
বিদায় হজের ভাষণের পটভূমি :
আরবের লোকেরা যখন দলে দলে ইসলাম গ্রহণ শুরু করল তখন মহানবি (স) মনে করলেন তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে। তাই তিনি হজ পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন। দশম হিজরী সনের ৯ই জিলহজ শুক্রবার আরাফার দিন দুপুরের পর আরাফাতের জাবালে রহমত পাহাড়ের শীর্ষে দাঁড়িয়ে মহানবি (স) প্রায় দু’লাখ সাহাবির সমাবেশে যে বিখ্যাত ভাষণ দেন, তাই বিদায় হজের ভাষণ নামে পরিচিত।
কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসের মূলোৎপাটন :
রাসূলুল্লাহ (স) তাঁর ভাষণের প্রারম্ভেই তাঁর বিরোধীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং জাহেলি যুগের যাবতীয় কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস, অনাচার রহিত ও বাতিল ঘোষণা করেন। তিনি মানুষকে এক আল্লাহর পথে ফিরে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, একদিন অবশ্যই আল্লাহর দরবারে হাজির হতে হবে এবং সকল কৃত কর্মের হিসাব দিতে হবে।
আরও পড়ো : মহানবী সাঃ এর জীবনী-রচনা: ৫০০,৭০০,১০০০ শব্দ- PDF (৩টি)
বিদায় হজের ভাষণ :
বিদায় হজের ভাষণে মহানবি (স) ঘোষণা করলেন, আজকের এ দিন তোমাদের কাছে যেমন পবিত্র, এ মাসটিও তোমাদের কাছে তেমনি পবিত্র। একদিন তোমরা আল্লাহর কাছে হাজির হবে এবং প্রতিটি কাজের হিসাব দিতে হবে। তোমরা ক্রীতদাস- ক্রীতদাসীদের প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করো না। তিনি আরও বললেন, সকল মানুষ এক আল্লাহর বান্দা, সকলেই সমান।
এছাড়া বিদায় হজের ভাষণে নারীর অধিকার, শ্রমিকের অধিকারের কথা বলা হয়। মহানবি (স) বিদায় হজের ভাষণে বলেন, দুটি জিনিস আমি দুনিয়ায় রেখে যাচ্ছি- ১. আল্লাহর বাণী অর্থাৎ কুরআন ও ২. আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ রাসুলের জীবনের আদর্শ অর্থাৎ তাঁর রাসুলের সুন্নাহ। এতেই রয়েছে সকল সমস্যার সমাধান। যতক্ষণ তোমরা তা আঁকড়ে ধরে থাকবে ততক্ষণ তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা :
রাসূলুল্লাহ (স) তাঁর বিদায় হজের ভাষণে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বমানবতাকে আহ্বান করেন। তিনি ঘোষণা করেন, প্রতিটি মানুষের জীবন ও সম্পদ আজকের হজের দিনের মতোই পবিত্র। তাই কারো জীবন, ধন-সম্পদ ও ইজ্জত-সম্মানের ওপর অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। ইসলাম যে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সম্পদের সার্বিক নিরাপত্তা, সর্বোপরি মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দেয়, মহানবি (স)-এর এ ঘোষণায় তা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
আরও পড়ো : রচনা- দেশ গঠনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা(২০ পয়েন্ট)
ইসলামে নারীর অধিকার :
ইসলামে নারীর পরিপূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, নারীকে সুউচ্চ মর্যাদায় আসীন করা হয়েছে। বিদায় হজের দিন তাই রাসূল (স) ঘোষণা করেন, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর যেরূপ অধিকার রয়েছে, স্বামীর ওপরও স্ত্রীর তদ্রূপ অধিকার রয়েছে। তাই নারীদের প্রতি সদয় হতে হবে।
জবাবদিহিতার ঘোষণা :
বিদায় হজের ভাষণে নবিজি বলেন, প্রত্যেক মানুষই তার কৃতকর্মের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে দায়ী। প্রতিটি মানুষকেই একদিন তার সৃষ্টিকর্তার সামনে উপস্থিত হয়ে নিজ কাজের কৈফিয়ত দিতে হবে। আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার ভয় থাকলে মানুষ পাপ কাজ থেকে দূরে থাকে।
ইসলামের এ পরকাল বিশ্বাসকে এখানে জোরদার করা হয়েছে। কৃত অপরাধের জন্য ব্যক্তি নিজেই দায়ী। এতে অন্য কাউকে দায়ী করা যাবে না। রাসূলের এ ঘোষণা দ্বারা ইসলামে সামাজিক সুবিচারের ঘোষণা উচ্চারিত হয়।
ইসলাম সাম্যের ধর্ম :
ইসলামই ঘোষণা করেছে, সব মানুষ সমান। মহানবি (স)-এর বিদায় হজের ভাষণে তা উচ্চারিত হয়েছে। কৃত দাসদাসীকে সে খাদ্য-বস্ত্রই দিতে হবে, যা তার মালিক আহার ও পরিধান করে। ইসলাম কৃত দাসদাসীদের অপরাধ ক্ষমার চোখে দেখতে বলেছে। কারণ তারাও আল্লাহর বান্দা। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন। রাসূল (স) বিদায় হজের ভাষণে দাসদাসীদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করতে নিষেধ করেছেন। কারণ ইসলাম সাম্যের নীতিতে বিশ্বাসী।
আরও পড়ো : ইসলাম ধর্ম – বাংলা রচনা
ইসলামে ভ্রাতৃত্ববোধ :
ইসলাম ভ্রাতৃত্ববোধের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। তাই রাসূল (স) তাঁর বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন, “নিশ্চয় এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই , আর সকল মুসলমানকে নিয়ে এক অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃসমাজ।” ধনী, গরিব, আমীর, ফকির, সব মুসলমান পরস্পরের ভাই। ইসলামের পতাকাতলে মৌলিক অধিকারের দিক থেকে সাদা-কালো, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই সমান । রাসূলের ভাষণে এ মৌলিক অধিকার গুরুত্ব লাভ করেছে।
পাপাচার থেকে দূরে থাকা :
হযরত মুহাম্মদ (স) সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় রোধ করার লক্ষ্যে তাঁর বিদায় হজের ভাষণে বলেন- অন্যায়, পাপ ও জুলুম-উৎপীড়ন থেকে সর্বদা দূরে থাকতে হবে। পাপ যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, তাকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। কেননা মানুষের প্রতিটি কাজের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব আল্লাহর কাছে দিতে হবে।
সবারই ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে :
ইসলাম ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলেছে। তাই মহানবি (স) বিদায় হজের ভাষণে ধর্মের ব্যাপারে কোনো বাড়াবাড়ি না করতে এবং কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে নিষেধ করেছেন। প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। যারা অন্য ধর্ম পালন করে, তাদের ওপর তোমার ধর্ম চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে না। কারণ ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে অতীতে অনেক জাতি ধ্বংস হয়েছে।
নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যের নির্দেশ :
মহানবি (স) সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে নেতার প্রতি আনুগত্য বাধ্যতামূলক বলে ঘোষণা করেছেন তাঁর বিদায় হজের ভাষণে। তিনি বলেছেন, নাক-কাটা কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসও যদি তোমাদের নেতা মনোনীত হয় তবুও তার আনুগত্য করা তোমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য।
শাশ্বত মূলনীতি ঘোষণা :
বিদায় হজের ভাষণে মহানবি (স) সমবেত সাহাবীদের উদ্দেশে ইসলামের চারটি শাশ্বত মূলনীতি ঘোষণা করেন, যা মানব সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে। মূলনীতিগুলো হলো-
ক. কোনোকিছুকে আল্লাহর সাথে শরীক না করা।
খ. অন্যায়ভাবে কোনো মানুষকে হত্যা না করা।
গ. অন্যের সম্পদ অপহরণ না করা।
ঘ. ব্যভিচারে লিপ্ত না হওয়া ।
পরম শান্তির বাণী :
ইসলাম শান্তির ধর্ম। মহানবি (স)-এর বিদায় হজের ভাষণে একথা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি মানুষের ওপর অত্যাচার করতে নিষেধ করেছেন। ‘রক্তের বদলে রক্ত’- আইয়ামে জাহেলিয়ার এ মূলমন্ত্র তিনি রহিত ঘোষণা করেন। ফলে ইসলাম যে শাশ্বত শান্তির ধর্ম তা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যৎ পথনির্দেশনা :
মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যৎ পথনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এ বিদায় হজের ভাষণে । মহানবি (স) বলেছেন, আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। আমার পর তোমরা এ দুটি জিনিস অনুসরণ করলে পথহারা হবে না। একটি হলো মহাগ্রন্থ আল কুরআন আর অপরটি হলো সুন্নাহ বা আল হাদিস।
বিদায় হজে নবীজির মনের অবস্থা :
হিজরী দশম সালে মহানবী (স) জীবনের শেষ হজ পালন করেন। তখন ইসলামের বাণী দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। মহানবি (স)- এর শেষ হজকে ‘বিদায় হজ’ নামে অভিহিত করা হয়। এ হজে মহানবি (স) মুসলমানদের নিয়ে আরাফাত ময়দানে উপস্থিত হলে সেখানে লাখ লাখ মানুষ তার ভাষণ শোনার জন্য একত্রিত হয়।
তিনি লাখ লাখ মানুষ দেখে অত্যন্ত খুশি হন। তার মন আনন্দে ভরে যায়। তার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল আভায় ভরে ওঠে। মহানবি (স) আরাফাত ময়দানে বিপুলসংখ্যক লোক দেখে আবেগতাড়িত হয়ে বললেন, এত মানুষ! এঁরা সবাই ইসলাম গ্রহণ করেছেন ।
ক্রীতদাস সম্পর্কে ঘোষণা :
ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী সম্পর্কে মহানবি (স) বলেছেন, ক্রীতদাস- ক্রীতদাসীদের প্রতি সর্বদা সদ্ব্যবহার কর। তাদের ওপর কোনোরূপ অত্যাচার করো না। তোমরা যা খাবে তাদেরকে তাই খাওয়াবে; যা পরবে তাই পরাবে। ভুলো না, তারাও তোমাদের মতো মানুষ।
ক্রীতদাস যদি নিজের যোগ্যতায় আমির হয়, তাহলে তাকে মেনে চলতে হবে। আর তখন বংশ-মর্যাদার কথা বলা যাবে না। মহানবি (স) বিদায় হজের ভাষণে ক্রীতদাস- ক্রীতদাসীদের সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন, তা আমাদের সকলকে যথাযথভাবে পালন করা উচিত।
সব মানুষ সমান :
বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে মানুষে মানুষে ভেদাভেদের মূলোৎপাটন করা হয়েছে। এ ভাষণে রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। প্রত্যেকেই আদম ও হাওয়া আলাইহিস সালামের সন্তান, আর তারা মাটি থেকে সৃষ্ট; সুতরাং সব আদম সন্তানই মাটি থেকে সৃষ্ট। অতএব তাদের ওপর কারো কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই ।
মহানবির আল্লাহভীতি :
বিদায় হজের ভাষণ শেষ করে মহানবি (স) বলে ওঠেন, ‘হে আল্লাহ! আমি কি তোমার বাণী পৌছিয়েছি? আমি কি আমার দায়িত্ব সম্পাদন করেছি?’
তখন উপস্থিত জনতা বলে ওঠে- “নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, আপনি আপনার কর্তব্য পালন করেছেন।” তখন রাসূলুল্লাহ (স) বললেন, “আল্লাহ, এই লাখো জনতা সাক্ষী থাকলো আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি।”
উপসংহার :
সত্যিই বিদায় হজের দিনে নবিজি (স)-এর ভাষণের তাৎপর্য ও গুরুত্ব অনেক। কারণ এতে সুন্দর ও নিরাপদ জীবন গড়ে তোলার জন্য নারী-পুরুষ, দাস-দাসী, ধনী-গরিব সবার অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে ইসলামের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। তাই পৃথিবীর ইতিহাসে মহানবি (স)-এর বিদায় হজের ভাষণ চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।