হোম পদার্থ রসায়ন জীব ইসলামিক

প্রবন্ধ রচনা : বিজ্ঞান ও আধুনিক সভ্যতা

উপস্থাপনা :

আধুনিক সভ্যতার গোড়াপত্তনে বিজ্ঞানের রয়েছে বিস্ময়কর শক্তি। হাক্সালি তার Brave New World গ্রন্থে বিজ্ঞানের এমন বিস্ময়কর অগ্রগতি কল্পনা করেছেন, যখন যন্ত্রে মানুষ সৃষ্টি হবে। তার কল্পিত ভবিষ্যৎ কোনোদিন বাস্তবে পরিণত হবে কিনা, তা চিন্তা না করে আমরা একথা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, আদিম যুগের অরণ্যচারী ও গুহাবাসী মানুষ বিজ্ঞানের মধ্য দিয়েই বর্তমান সভ্যতা বিনির্মাণ করেছে।

বিজ্ঞানের অতীত ও বর্তমান :

অরণ্যচারী আদিম মানব ছিল অসহায় এবং প্রকৃতির খেয়ালের অধীন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মানুষ আজ আপন প্রয়োজনে, উদ্ভাবনী শক্তির কল্যাণে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের বাধা অতিক্রম করেছে, প্রতিটি রহস্যকে করেছে উন্মোচিত। জীবনের পথ চলার প্রতিটি মুহূর্তকে বিজ্ঞান পরিপূর্ণ করেছে নিজের আশীর্বাদে।

আরও পড়ুন : রচনা : মানব সভ্যতার বিকাশ ও বিজ্ঞান

প্রাত্যহিক জীবন ও বিজ্ঞান :

জীবনের সকল স্তরে স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিয়েছে বিজ্ঞান। একটি ব্যস্তদিনের কথাই ধরা যাক। আপনার ঘুম ভেঙেছে। হাতমুখ ধুয়ে তৈরি হচ্ছেন। বিজ্ঞান আপনার হাতে তুলে দিল টুথব্রাশ আর চমৎকার সৌরভের টুথপেস্ট। অফিসে যাওয়ার জন্য বিজ্ঞান আপনার জন্য তৈরি করেছে দ্রুতগামী বিলাসবহুল যানবাহন। অফিসে পৌঁছেও আপনি বিজ্ঞানের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হননি। আপনার মাথার উপর ঘুরছে ফ্যান, হাতের কাছে রয়েছে টেলিফোন। এছাড়াও কম্পিউটার, ফ্যাক্স ইত্যাদির উপস্থিতিতে আপনার অফিসের যে দৃশ্য তা হয়তো প্লেটোর দার্শনিক রাজ্যকেও হতবুদ্ধি করে দেবে।

আমাদের দেশ ও বিজ্ঞান :

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের বিজ্ঞান তার সম্ভাবনাময় আশীর্বাদে জাতীয় জীবনকে করেছে সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যময়। দেশের জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ বাস করে দারিদ্র্যসীমার নিচে। তারাও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিজ্ঞানের কোনো না কোনো আশীর্বাদ উপভোগ করছে প্রাত্যহিক জীবনে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞান তাদের জীবনে কোনো বৃহত্তর কল্যাণ বয়ে আনতে পারেনি।

সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশনসহ বিজ্ঞানের অনেক প্রাত্যহিক আশীর্বাদ এখনো তাদের নাগালের বাইরে। বিজ্ঞান নয় বরং দু’মুঠো অন্ন জোগাড় তাদের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য তাদের এই দুর্দশার জন্য বিজ্ঞান দায়ী নয়; বরং বিজ্ঞানের সর্বাত্মক প্রয়োগের মাধ্যমে এ দুর্দশা থেকে মুক্তিলাভ সম্ভব ।

আরও পড়ুন : প্রবন্ধ রচনা : প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক

মানবজীবনে বিজ্ঞানের বহুমাত্রিক অবদান :

মানুষের সূর্যোদয় হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্রতিটি কর্মকাণ্ডের সাথে বিজ্ঞান জড়িত। বিজ্ঞান আর মানবজীবন একই সূত্রে গ্রথিত। শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, যাতায়াত, প্রকৌশলসহ জীবনের হাজারো ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। নিচে এর কয়েকটি দিক তুলে ধরা হলো :

মানবকল্যাণে বিজ্ঞান : বিজ্ঞানের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো মানবকল্যাণ সাধন । বিজ্ঞানের জন্ম হয়েছে মানুষের জীবনকে সুখী-সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলার জন্য। কিসে মানুষের জীবন স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়ে ওঠে, কেমন করে গোটা মানবসমাজ মিলেমিশে জীবনযাপন করতে পারে, প্রথম থেকেই বিজ্ঞান সে সাধনায় ব্রতী।

শিল্পক্ষেত্রে বিজ্ঞান : মানবজীবনের কল্যাণ সাধনে আধুনিক বিজ্ঞানের অবদান সর্বাধিক। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বিজ্ঞান নতুন নতুন আবিষ্কার নিয়ে আবির্ভূত হয়। বিভিন্ন উন্নত যন্ত্রপাতি, কলকব্জা আবিষ্কার করে শিল্পজগতে নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করে। নতুন নতুন যন্ত্র আবিষ্কার করে বিশ্ববাসীকে উপহার দেওয়ার জন্য বিজ্ঞানের নিরলস প্রচেষ্টা আজ সফল। এজন্য বর্তমান যুগকে Age of Science বলা হয়।

কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞান : আধুনিক উপকরণ সরবরাহ করে বিজ্ঞান কৃষির উৎপাদন অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সেচ ও চাষাবাদের আধুনিক যন্ত্রপাতি, উন্নতমানের রাসায়নিক সারের আবিষ্কার, উন্নত বীজ ও কীটনাশক আবিষ্কার কৃষিক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।

আরও পড়ুন : চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান- বাংলা প্রবন্ধ রচনা

বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার : আধুনিক বিজ্ঞান সময় ও দূরত্বকে জয় করেছে। বৈজ্ঞানিকগণ তাদের মেধা খাটিয়ে আকাশযানের সাহায্যে বিহঙ্গের ন্যায় শূন্যে উড়ে বেড়াচ্ছে। মাইকেল ফ্যারাডে বিদ্যুৎ আবিষ্কার করলেন, যা কাজে লাগালেন টমাস এডিসন। বিদ্যুৎ ভৃত্যের মতো খেটে আলো জ্বালাল, ট্রাম চালাল, পাখা ঘুরাল। রেডিও, টেলিভিশন, টেলিফোন প্রভৃতি বিদ্যুৎ তরঙ্গের রহস্যময় শক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ।

বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার কম্পিউটার : বিজ্ঞান কম্পিউটার আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষের শ্রম ও সময়কে জয় করেছে। কম্পিউটার আধুনিক বিশ্বের অনন্য বিস্ময়। যানবাহন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ, রেল ও বিমানের আসন সংরক্ষণ, খেলাধুলা, মুভি দেখা থেকে শুরু করে জীবনের সকল ক্ষেত্রে আজ কম্পিউটার ব্যবহৃত হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে ও ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কম্পিউটার বিপ্লব এনে দিয়েছে।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান : বিজ্ঞানের বদৌলতে মানুষ আজ অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুকে জয় করেছে। অধ্যাপক রঞ্জনের আবিষ্কৃত ‘রঞ্জন রশ্মি’, অধ্যাপক কুরী ও মাদাম কুরী আবিষ্কৃত ‘রেডিয়ায় চিকিৎসা বিজ্ঞানে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। রঞ্জন রশ্মি ও আলট্রাসনোগ্রাফির সহায়তায় শরীরের অদৃশ্য অংশ দৃশ্যমান হয়। রেডিয়ামের সাহায্যে ক্যান্সারের মতো ভয়ংকর ক্ষতের মারাত্মক বিষক্রিয়া অনেকাংশে প্রশমিত হয়। পেনিসিলিন, ক্লোরোমাইসিন, • স্ট্রেপটোমাইসিন ইত্যাদি মহৌষধ মানুষকে নানা প্রকার দুরারোগ্য ব্যাধির হাত থেকে বাঁচিয়েছে।

শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তারে বিজ্ঞান : মুদ্রণযন্ত্র, ক্যালকুলেটর, কাগজ, সংবাদপত্র ও পুস্তকাদি সবকিছুই বিজ্ঞানের দান। কম্পিউটার ব্যবহারের মাধ্যমে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় যুক্ত করেছে এক নতুন শিক্ষা পদ্ধতি। তাছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিভিন্ন বিখ্যাত লাইব্রেরির বই, বিখ্যাত শহর বন্দর, বাণিজ্য, দেশ ইত্যাদি বিষয়ে মুহূর্তেই জানা সম্ভব হচ্ছে প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্ত ।

আরও পড়ুন : রচনা সহজ : দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান [ Class 6, 7, 8, 9, 10 ]

আণবিক শক্তির আবিষ্কার :

আণবিক শক্তির আবিষ্কার বিজ্ঞানের আধুনিকতম কৃতিত্ব। আণবিক গবেষণার ভেতর দিয়ে বিজ্ঞানীরা বিশ্বচরাচরের অদৃশ্য শক্তি খুঁজে বের করেছে। এ শক্তি যদি কল্যাণমূলক কাজে লাগানো যায় তাহলে পৃথিবী শস্য, সম্পদ ও প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। আণবিক বা এটমিক রশ্মি নিয়ন্ত্রণ করে মানুষ বহু দুরারোগ্য ব্যাধি হতে নিজেকে রক্ষা করতে সমর্থ হবে বলে আশা করা যায় । আণবিক শক্তির সংযত পরিচালনায় বৈদ্যুতিক শক্তি সরবরাহ করা যাবে- বিজ্ঞানীরা এ আশাও ব্যক্ত করেন।

বিজ্ঞানের সার্থকতা :

জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানকে কল্যাণপ্রসূ করে তোলাই বিজ্ঞানের সার্থকতা। এ সার্থকতার পথ ধরেই বিজ্ঞান অবিচ্ছিন্ন গতিতে এগিয়ে চলেছে সম্মুখপানে। বিজ্ঞানের অপরিসীম ক্ষমতাবলে আজ প্রকৃতির ওপর তার আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে।

বিজ্ঞানের অপকারিতা :

বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য হলেও বিজ্ঞান বিশ্ব মানবের জন্য সর্বক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনেনি। বিজ্ঞান অঢেল স্বাচ্ছন্দ্যের মাঝে দুর্দশাও ডেকে এনেছে। বিজ্ঞান মানবের জীবনযাত্রা জটিল এবং চিন্তাধারাকে কুটিল করেছে। যান্ত্রিক সভ্যতা মানুষকে করেছে নির্দয় ও নিষ্ঠুর। বিজ্ঞানের কল্যাণেই দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা সম্ভব হয়েছিল।

ব্যবসা- বাণিজ্য ও শিল্পের বিস্তারের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বায়ু ও শব্দ দূষণ। জলবায়ুর পরিবর্তনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে রোগ-ব্যাধির প্রকোপ। এ সব কিছুর জন্য দায়ী বিজ্ঞানের প্রয়োগকারী, বিজ্ঞান নয়। তাই বিজ্ঞানের এ ধরনের নিষ্ঠুর ধ্বংসযজ্ঞ দেখে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-

হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবী নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব
ঘোর কুটিল পন্থা তাহার লোভ জটিল বন্ধ ।

উপসংহার:

মানবকল্যাণে বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য। পানি ও বাতাস বাদ দিলে যেমন জীবনের কাজকর্ম স্তব্ধ হয়ে যায়, তেমনি বিজ্ঞানকে বাদ দিলেও সভ্যজগৎ প্রাণহীন ও নিস্পন্দ হয়ে পড়ে। বিজ্ঞানের কল্যাণেই আমরা লাভ করেছি স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন। অন্যদিকে বিজ্ঞানকে যদি কেউ অশুভ কাজে ব্যবহার করে, তাহলে তা মানবজাতির জন্য ধ্বংসও বয়ে নিয়ে আসতে পারে ।

আরও পড়ুন : রচনা : বাংলাদেশে শরৎ / শরৎকাল/শরতে ধরাতল শিশিরে ঝলমল

Leave a Comment