উপস্থাপনা :
বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পর মাইকেল ফ্যারাডে বলেছিলেন- Electricity is itself a great power that could easily vibrate the whole universe. বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর আবিষ্কার হলো বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ ছাড়া বর্তমান সভ্যতা অচল। কারণ বিদ্যুৎই আধুনিক সভ্যতা বিনির্মাণ করেছে। কলকারখানা ও যানবাহন থেকে শুরু করে নিভৃত গৃহকোণ পর্যন্ত বিদ্যুতের ব্যবহার বিস্তৃত। বিদ্যুৎ মানবজীবনকে সহজ, সুন্দর ও সুখময় করেছে। তাই বিদ্যুৎ না থাকলে মানবজীবনে সংকটের সৃষ্টি হয় । নিচে বিদ্যুৎ সংকট ও এর প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা হলো-
বিদ্যুৎ :
বিদ্যুৎ একপ্রকার শক্তি। এ শক্তি যান্ত্রিক কলাকৌশলে এনে দিয়েছে সাফল্যজনক অধ্যায়। বিদ্যুৎ শক্তি হলো এ বৈজ্ঞানিক যুগের বিস্ময়কর আবিষ্কার। বৈজ্ঞানিক ভোল্টার বিদ্যুৎ শক্তি আবিষ্কার করে মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক কালজয়ী অধ্যায়ের সূচনা করেছেন ।
আরও পড়ুন : বিদ্যুৎ ও আধুনিক জীবন – বাংলা প্রবন্ধ রচনা
লোডশেডিং বা বিদ্যুৎ সংকট কী :
লোডশেডিং বা বিদ্যুৎ সংকট বলতে বোঝায় চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের অপর্যাপ্ততা এবং বিদ্যুৎপ্রাপ্তিতে নানামুখী অনিয়ম, হয়রানি ও দুর্নীতি। চাহিদার তুলনায় উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ কম হলে দিন-রাতের কিছু সময় গ্রাহককে বিদ্যুৎ সরবরাহ থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। একে বলা হয় লোডশেডিং। অন্যদিকে জরাজীর্ণ বিদ্যুৎ লাইন, দুর্ঘটনা, সংযোগপ্রাপ্তিতে হয়রানি, দুর্নীতি প্রভৃতি কারণে মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সংকট :
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকট খুব বেশি। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে এ তীব্র বিদ্যুৎ ঘাটতি আমাদের জনজীবন বিপন্ন করে তোলে। প্রাত্যহিক জীবনযাপন থেকে শুরু করে শিল্পোন্নয়ন, কৃষি উৎপাদন প্রভৃতি ক্ষেত্রেই মানুষ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো), পল্লি বিদ্যুতায়ন বোর্ড (পবিবো), ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ (ডেসা) এবং জিসিবি-প্রতিটি সংস্থা বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত।
২০০৭ সালে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৩৮১২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়েছে এসব সংস্থা থেকে এবং ২০০৭-০৮ অর্থবছরে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৫২৬২ মেগাওয়াট। চাহিদার তুলনায় এ পরিমাণ অত্যন্ত কম। ফলে লোডশেডিং আমাদের দেশে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরও পড়ুন : প্রবন্ধ রচনা : বিজ্ঞান ও আধুনিক সভ্যতা
বিদ্যুৎ সংকটের প্রতিক্রিয়া :
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাপন থেকে শুরু করে জীবনের সকল ক্ষেত্রেই বিদ্যুৎ একটি অপরিহার্য উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুতের সাহায্যে মানুষ ঘরবাড়ি আলোকিত করে, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানা পরিচালনা করে, পরিবারের গৃহস্থালি কাজকর্ম করে, কৃষকেরা জমিতে সেচের ব্যবস্থা করে, শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করে। বিদ্যুতের অভাবে শহর-নগর ভুতুড়ে পল্লিতে পরিণত হয়। অপহরণ ও ছিনতাই বৃদ্ধি পায়। লেখাপড়ার ক্ষতি হয়। এতে সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ। ফলে তারা বিদ্যুতের দাবি নিয়ে রাজপথে নেমে আন্দোলনও শুরু করে।
লোডশেডিং-এর কারণ :
প্রধানত দুটি কারণে বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটকের আগমন কম এবং বিদেশি বিনিয়োগও আশানুরূপ নয়। এর প্রথমটি অস্থিতিশীল রাজনীতি, দ্বিতীয়টি হলো বিদ্যুৎ ঘাটতি। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ঘাটতির জন্য যেসব কারণ রয়েছে তা নিচে উপস্থাপন করা হলো-
প্রথমত, নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে মূলধন ও বিদেশি সাহায্যের অভাব। পুরনো কেন্দ্রগুলোও সময়মত মেরামত করা হয় না ।
দ্বিতীয়ত, পানিবিদ্যুৎ ও তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ কাঁচামালের যোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
তৃতীয়ত, সরকারের পরনির্ভরশীল মনোভাবও এর জন্য দায়ী। চতুর্থ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও প্রশাসনিক জটিলতা।
পঞ্চমত, বিদ্যুৎ গ্রাহকদের বিদ্যুৎ অপচয় করাও এর জন্য চরমভাবে দায়ী। ষষ্ঠত, বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীদের যোগসাজসে বিদ্যুৎ গ্রাহকরা কম বিল পরিশোধ করে বিধায় সরকারের এ খাতে রাজস্ব আয় কম এবং বিনিয়োগও কম ।
আরও পড়ুন : রচনা : মানব সভ্যতার বিকাশ ও বিজ্ঞান
বিদ্যুৎ সংকটের প্রতিকার :
বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ১৭০০-১৮০০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে চাহিদা ২৩০০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ নিয়মিত বিদ্যুৎ ঘাটতির পরিমাণ ৫০০ মেগাওয়াট। এছাড়া উৎপাদন কেন্দ্রে যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে নিয়মিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে ৫০০ মেগাওয়াট ঘাটতির সাথে আরো নতুন ঘাটতি যোগ হচ্ছে। এ তীব্র বিদ্যুৎ ঘাটতির প্রতিকার আনতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেওয়া প্রয়োজন :
১। নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন এবং সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করা।
২। উৎপাদিত বিদ্যুৎ যাতে অপচয় না হয় সেদিকে লক্ষ রাখা ।
৩। বিদ্যুৎ চুরি রোধ করা।
৪। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দোকানপাট ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান চালু রাখা।
৫। অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা।
৬। উৎপাদিত বিদ্যুৎ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা।
৭। দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ করা।
৮। স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক মহলের কবল থেকে বিদ্যুৎ সেক্টরকে মুক্ত করা ।
আরও পড়ুন : রচনা : ছাত্র রাজনীতি/ ছাত্র সমাজ ও রাজনীতি
উপসংহার :
আধুনিক সভ্যতার যুগে বিদ্যুতের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। মানবজীবনে বিদ্যুৎ দেয় সচলতা ও গতিশীলতা। আর লোডশেডিং দেয় গতিহীনতা। তাই লোডশেডিং দূর করতে হবে সবার আগে । কেননা বিদ্যুৎ ছাড়া উন্নত ও সভ্য জীবনের কল্পনা করা যায় না।