উপস্থাপনা :
গ্রন্থাগার হলো গ্রন্থ বা বইয়ের আগার বা বই রাখার স্থান। যেখানে নদীর স্রোতের মতো জ্ঞান থাকে, গ্রন্থ থাকে, বই থাকে। মানুষের জন্য তিনটি বিষয় খুবই প্রয়োজনীয়। আর সেগুলো হচ্ছে- বই, বই এবং বই। সুতরাং বইয়ের আধার লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগারের গুরুত্ব অপরিসীম।
গ্রন্থাগারের পরিচয় :
‘গ্রন্থাগার’ শব্দটি সংস্কৃত ‘গ্রন্থ’ ও ‘আগার’ শব্দযুগলের সমন্বয়। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Library’ যার শাব্দিক অর্থ গ্রন্থ রাখার স্থান। আর পারিভাষিক অর্থে ‘গ্রন্থাগার’ বলতে এমন একটি স্থানকে বোঝায়, যেখানে জ্ঞানরাজ্যের বহু শাখার বিচিত্র গ্রন্থরাজি সংগৃহীত থাকে। গ্রন্থ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয় সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে এখানে সুচয়িত বইগুলো পাঠকের হাতের নাগালের মধ্যেই থাকে । গ্রন্থাগারে পাঠকের জন্য পাঠের অনুকূল ব্যবস্থাও থাকে ।
আরও পড়ুন : প্রবন্ধ রচনা : ছাত্র সমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্য
গ্রন্থাগারের ইতিহাস :
গ্রন্থাগারের ইতিহাস অতি প্রাচীন। মূলত গ্রন্থের উদ্ভবের সাথে সাথেই গ্রন্থাগারের উদ্ভব ও বিকাশ হয়। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের দিকে রোমে গ্রন্থাগারের যাত্রা শুরু হয়। এ ছাড়াও মিসর, গ্রিক, ব্যাবিলন ও চীনের প্রাচীন সভ্যতায় গ্রন্থাগার থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় । ইসলামের আবির্ভাবের পর লাইব্রেরিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়। আব্বাসীয় শাসনামলে বাগদাদে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ লাইব্রেরি গড়ে উঠেছিল। প্রাচীনকালে মুদ্রণ যন্ত্রের অভাবে হাতে লেখা গ্রন্থ পঠিত হতো। গ্রন্থের অনুলিপির দুষ্প্রাপ্যতার কারণেই লাইব্রেরির জন্ম হয়।
বর্তমানে আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রের কল্যাণে গ্রন্থবিপ্লব সূচিত হলেও গ্রন্থাগারের গুরুত্ব কমেনি। গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ হচ্ছে এবং বর্তমানে গ্রন্থাগারে পুস্তক সংরক্ষণ, সংগ্রহ ও বিতরণ ব্যবস্থা ডাটাবেইজ পদ্ধতিতে করা হচ্ছে। অনেক গ্রন্থের ডিজিটাল সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছে বিধায়, আধুনিক গ্রন্থাগারসমূহে সর্বাধুনিক তথ্য প্রযুক্তির সুবিধা সংযুক্ত করা হয়েছে।
গ্রন্থাগারের শ্রেণিবিভাগ :
লাইব্রেরি বলতে বোঝায় বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থের সংগ্রহশালাকে। এ সংগ্রহ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সাংগঠনিক ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বাধীনেও হতে পারে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক গ্রন্থাগার সীমিত পরিসরের। কিন্তু সাধারণ বা রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগার অনেক বড়। আজকাল ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগারেরও প্রচলন ঘটেছে। ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও জ্ঞানচর্চার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে ।
আরও পড়ুন : প্রবন্ধ রচনা : প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক
গ্রন্থাগারের বৈশিষ্ট্য :
জ্ঞান-বিজ্ঞানের মহাসমুদ্র হলো গ্রন্থাগার। জ্ঞানপিপাসুদের জ্ঞানের চর্চার অন্যতম প্রিয় স্থান এটি। লাইব্রেরিতে রয়েছে চিন্তাশীলদের জন্য খোরাক, আছে দুরূহ জিজ্ঞাসার উত্তর। জ্ঞানের ক্ষুধা নিবৃত্তির বিপুল আয়োজন কেবল গ্রন্থাগারেই লাভ করা যায়। বিশ্বের মানুষের অফুরন্ত ভাবরাশি অবলম্বনে রচিত হয়েছে অসংখ্য গ্রন্থ। যেসব গ্রন্থ কোনো মানুষের একার পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব নয় গ্রন্থাগার সে প্রয়োজন সাধন করে এবং বহু মানুষের যৌথ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয়।
সেখানে অসংখ্য মানুষের প্রয়াসে সংগৃহীত গ্রন্থ পাঠের সুযোগ পায় নানা বয়সের, নানা রুচির মানুষ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গ্রন্থাগারের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছেন, “মহাসমুদ্রের শত বছরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত, যেন সে ঘুমন্ত শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত তবে সেই নীরব মহাশব্দের সাথে এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এইখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে। মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়িয়া আছে।
বিশ্বখ্যাত গ্রন্থাগারসমূহ :
আব্বাসীয় খলিফা আল মামুন কর্তৃক বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত ‘বায়তুল হিকমা” নামক গ্রন্থাগারের নাম আজও অবিস্মরণীয়। বর্তমান বিশ্বের বিখ্যাত গ্রন্থাগারসমূহের অন্যতম হচ্ছে-
মাকতাবাতুল আযহার – মিসর।
ডিন লাইব্রেরি- জাপান ।
লেনিন-স্টেট লাইব্রেরি – মস্কো।
বিবলিওটিক ন্যাশনাল- প্যারিস।
ব্রিটিশ মিউজিয়াম – বৃটেন ।
নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি- নিউইয়র্ক।
রয়্যাল লাইব্রেরি- স্টকহোম ।
বাংলাদেশের প্রধান লাইব্রেরিগুলোর মধ্যে রয়েছে এশিয়াটিক সোসাইটি গ্রন্থাগার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি, বাংলা একাডেমি লাইব্রেরি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন গণপাঠাগার ইত্যাদি।
আরও পড়ুন : প্রবন্ধ রচনা : শিক্ষা ব্যবস্থা ও নৈতিকতা
শিক্ষাবিস্তারে গ্রন্থাগারের ভূমিকা :
গ্রন্থাগারের অপর নাম হলো শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অতীত জাতিসমূহের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য সার্বিক কর্মকাণ্ড গ্রন্থাগারের মাধ্যমেই যুগ থেকে যুগান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। যে কোনো ধরনের শিক্ষায় গ্রন্থপাঠ অপরিহার্য। শ্রেণিকক্ষের শিক্ষা পূর্ণভাবে সমৃদ্ধ হয় গ্রন্থাগারকেন্দ্রিক পাঠাভ্যাসে। উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার কাজে গ্রন্থাগারই হয়ে ওঠে প্রধান সহায়ক। পাঠ্যক্রমভিত্তিক কিংবা পাঠ্যক্রম বহির্ভূত বিদ্যাচর্চা উভয় ক্ষেত্রেই গ্রন্থাগার ব্যবহার অত্যন্ত উপযোগী। গ্রন্থাগারের গ্রন্থরাজি স্বশিক্ষিত হওয়ার সাধনাকে সহায়তা করে।
বিশ্বের সকল কবি-সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও ঐতিহাসিকের সৃষ্টির সাথে আজকের মানুষের পরিচয় করিয়ে দেয় গ্রন্থাগার। তাদের অসামান্য সৃষ্টিতে অবগাহন করে পাঠকসমাজ লাভ করে অপরিমেয় আনন্দ। গ্রন্থাগার কৌতূহলী ও জ্ঞানপিপাসু পাঠককে আত্মিক তৃপ্তি দান করে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী বলেন, “গ্রন্থাগারের প্রয়োজন হাসপাতালের চেয়ে বেশি। কারণ হাসপাতালে কেবল দেহের চিকিৎসা হয়, আর গ্রন্থাগার মানুষের সুস্থ মন গড়ে তোলে।” এভাবে গ্রন্থাগার শিক্ষিত, মার্জিত, উন্নত ও সমৃদ্ধিশালী জাতি গঠনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।
জ্ঞানের সর্বাধুনিক প্রতিষ্ঠান :
প্রতিনিয়ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিধি বাড়ছে, বাড়ছে গ্রন্থ, পত্রিকা প্রভৃতি। শিক্ষার্থীদের সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত ও বিশ্ব জ্ঞানভাণ্ডারের সাথে সম্পৃক্ত হতে হলে পড়তে হয় সর্বাধুনিক বইপত্র, সাময়িকী ও জার্নাল। ব্যক্তিগতভাবে সকলের পক্ষে সকল প্রকার বই ও পত্র-পত্রিকা সংগ্রহ করে পড়া অসম্ভব। তাছাড়া শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট রেফারেন্স বই দুষ্প্রাপ্য। প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক লাইব্রেরিগুলো থেকে শিক্ষার্থীরা সহজেই কাঙ্ক্ষিত বই ও পত্র-পত্রিকা সংগ্রহ করে শিক্ষাজীবনকে সফল করে তুলতে পারে। লাইব্রেরিগুলো সর্বাধুনিক ম্যাগাজিন-সাময়িকী, পত্রিকা, বই এবং ইন্টারনেটের সংযোগে জ্ঞানসমুদ্রের সকল শাখার সর্বশেষ তথ্য পেতে সহায়তা করে।
আরও পড়ুন : রচনা : ইসলামে মানবাধিকার / ইসলাম ও মানবাধিকার
উপসংহার :
গ্রন্থাগার অতীত জাতির জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক হিসেবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জ্ঞানের প্রজ্বলিত শিখায় সমগ্র বিশ্বকে আলোকিত করে। অতীত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের যোগসূত্র স্থাপন করে জ্ঞানের সকল শাখাকে বিকশিত করে। যে জাতির গ্রন্থাগার যত উন্নত ও সমৃদ্ধ, বিশ্বের বুকে সে জাতি তত উন্নত ও সমৃদ্ধ। তাই আলোকিত সমাজ ও জাতি গঠনে চাই লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা এবং জ্ঞানের চর্চা ।