হোম পদার্থ রসায়ন জীব ইসলামিক

প্রবন্ধ রচনা : শিক্ষা ব্যবস্থা ও নৈতিকতা

উপস্থাপনা :

শিক্ষা একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া। মানুষের জীবনকে সুন্দর ও অর্থবহ করার উদ্দেশ্যেই শিক্ষার আবিষ্কার। মানুষকে মানবীয় গুণাবলিতে বিকশিত করার মাধ্যমে পাশবিকতা থেকে মুক্ত রেখে শিক্ষা উন্নত নৈতিকতা, চরিত্র ও মানসিক উন্নয়ন ঘটায়। এ কারণে শিক্ষাকে আলোক এবং মূর্খতাকে অন্ধকার হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। শিক্ষা ও নৈতিকতা একে অন্যের পরিপূরক। উন্নত নৈতিকতা ছাড়া শিক্ষার অস্তিত্ব অর্থহীন।

শিক্ষার সংজ্ঞা :

শিক্ষা হলো এমন প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানুষের দেহ, মন, আত্মা ও আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং বিকাশ সাধিত হয়। ইংরেজি Education শব্দের বাংলা, প্রতিশব্দ শিক্ষা । Education শব্দটি ল্যাটিন শব্দ Eden এবং Ducer Duc থেকে এসেছে। এগুলোর উৎপত্তিগত অর্থ হলো যথাক্রমে বের করা, বিকশিত করা, পথপ্রদর্শন করা।

এ পর্যন্ত Education বা শিক্ষার যত সংজ্ঞা প্রদত্ত হয়েছে তার সারকথা হলো প্রবৃদ্ধি দান করা, উন্নত করা, পূর্ণতা আনয়ন করা, জাগিয়ে তোলা, অভ্যাস করানো, উপদেশ দেওয়া, অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ থেকে নিবৃত্ত রাখা, সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করা, সম্প্রসারিত করা, পথ প্রদর্শন করা, প্রেরণা দান করা, সন্ধান দান করা, নিয়মানুবর্তী করা, সৌজন্য শেখানো, বিনয়ী ও অমায়িক বানানো, আদব-কায়দা শিক্ষা দেওয়া, উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী বানানো, প্রথাসিদ্ধ করা, মানসিক ও শারীরিক যোগ্যতা বৃদ্ধি করা, বিবেচনা বোধ ও বিচার- শক্তি বৃদ্ধি করা, উদ্ভাবন করা, গবেষণামুখী করা ইত্যাদি ।

আরও পড়ুন : কর্মমুখী শিক্ষা বা কারিগরি শিক্ষা -রচনা [Class – 6, 7, 8 ,9 ,10]

শিক্ষা সম্বন্ধে মনীষীদের অভিমত :

শিক্ষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন মনীষী মূল্যবান বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। মহাকবি আল্লামা ইকবালের মতে, “মানুষের ‘খুদী” বা রূহের উন্নয়ন ঘটানোর প্রক্রিয়ার নামই শিক্ষা।” আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সাইয়েদ মুহাম্মদ কুতুব-এর মতে, “শিক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামি আদর্শের কাজ হলো পরিপূর্ণ মানব সত্তার লালন করে এমনভাবে গড়ে তোলা, যা এমন একটি পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি যে, মানুষ তা দেহ, বুদ্ধিবৃত্তি এবং আত্মা তার বস্তুগত ও আত্মিক জীবন এবং পার্থিব জীবনের প্রতিটি কার্যকলাপের কোনোটিই পরিত্যাগ করে না।”

কতিপয় পশ্চিমা শিক্ষাবিদ উপরিউক্ত সংজ্ঞার সাথে সংগতিপূর্ণ সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। দেহ, মন ও আত্মার সমন্বিত উন্নয়ন সাধনই শিক্ষা। Herman. H. Horne বলেছেন, “শিক্ষা হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে বিকশিত, মুক্ত, সচেতন মানবসত্তাকে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে উন্নত যোগসূত্র রচনা করার একটি চিরন্তন প্রক্রিয়া;

যেমনটি প্রকাশিত রয়েছে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক, আবেগগত এবং ইচ্ছাশক্তি সম্বন্ধীয় পরিবেশে।” ড. জন পার্ক বলেন, “শিক্ষা হচ্ছে নির্দেশনা ও অধ্যয়ন বা Study-র মাধ্যমে জ্ঞান ও অভ্যাস অর্জন বা প্রদানের কলাকৌশল বা প্রক্রিয়া।”

উপরিউক্ত সংজ্ঞাসমূহ বিশ্লেষণ করলে এ কথা স্পষ্ট হয় যে, দৈহিক, বস্তুগত, প্রযুক্তিগত বা ভাষাগত ব্যুৎপত্তি অর্জনের পাশাপাশি একজন মানুষের দেহ, মন, আত্মা ও আধ্যাত্মিক বিকাশ ও উন্নতির নামই শিক্ষা ।

আরও পড়ুন : শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড – বাংলা রচনা [ Class – 6, 7, 8 ,9 ,10]

শিক্ষা ব্যবস্থা ও নৈতিকতা :

একটি রাষ্ট্র বা জাতির শিক্ষাপদ্ধতি, মূলনীতি, লক্ষ্য, ভাষা, কারিকুলাম, সিলেবাস, বাস্তবায়ন পদ্ধতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসন সবকিছু মিলে গড়ে উঠে সে দেশ বা জাতির শিক্ষাব্যবস্থা। যে কোনো দেশ বা জাতির বিশ্বাস, ইতিহাস-ঐতিহ্য, তাহজীব-তমদ্দুন ও জাতীয় প্রয়োজন এসবই সে দেশ বা জাতির শিক্ষাব্যবস্থার মূলভিত্তি। এসব মূল উপাদানের ভিত্তিতে উক্ত দেশ ও জাতির শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়।

মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে মানুষের শিক্ষাব্যবস্থায় এমনসব শিক্ষা উপাদান থাকা জরুরি যার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষ পবিত্র আত্মা ও চরিত্রবান হিসেবে গড়ে ওঠার দীক্ষা পেতে পারে। এজন্য শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্ম, নৈতিকতা, আল্লাহর অস্তিত্ব, তাঁর ঐশী হেদায়াত, যার মাধ্যমে ঐতিহাসিকভাবে মানুষ ভালোমন্দ বা হক-বাতিলের জ্ঞানার্জনের সুযোগ পেয়েছে, এসবকিছুর সম্মিলন থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । প্রাগৈতিহাসিক যুগের দার্শনিক প্ল্যাটো বলেছেন, “কোনো মানুষ বা জাতির বিশ্বাস বা Commitment এবং তার দেশ পরিচালনার জন্য রচিত সংবিধানই হওয়া উচিত শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি।”

শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতার গুরুত্ব :

১। নৈতিক পরিশুদ্ধিই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য : শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো, মানুষের মানবীয় মূল্যবোধের বিকাশ সাধন ও তার আচরণ থেকে পাশবিক প্রবৃত্তির উচ্ছেদ সাধন করা। শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষের নৈতিক চরিত্রকে পাশবিকতামুক্ত, উন্নত ও পবিত্র করা সম্ভব। যুগে যুগে এ উদ্দেশ্যেই নবি-রাসুলগণের আবির্ভাব ঘটেছিল। মহান আল্লাহ বলেন, “তিনিই মহান সত্তা যিনি উম্মীদের মধ্যে তাদেরই একজনকে রাসুল হিসেবে পাঠিয়েছেন, যিনি তাদেরকে তাঁর আয়াত পাঠ করে শোনান এবং তাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেন অথচ ইতঃপূর্বে তারা সুস্পষ্ট গোমরাহিতে নিমজ্জিত ছিল।”(সূরা জুমুয়া- ২)

২। নৈতিকতাবর্জিত শিক্ষা বর্বরতার নামান্তর : শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো মানুষকে খাঁটি মানুষে পরিণত করা। পাপাচার, শঠতা, প্রতারণা, দুর্বৃত্তপনা, সন্ত্রাস, রাহাজানি, মিথ্যাবাদিতা, পাশবিকতা ইত্যাদি অসৎ গুণাবলি থেকে মানবাত্মাকে পবিত্র রেখে উন্নত চরিত্র-বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করা শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য। অথচ ধর্মীয় নৈতিকতাবিবর্জিত শিক্ষা বর্বরতার নামান্তর। বিখ্যাত শিক্ষাবিদ Stanly Hull বলেছেন- If you teach your children the three R’s (Reading, Writing and Arithmetic), and leave the fourth ‘R’ (Religion), you will get a fifth ‘R’ (Rascality).

আরও পড়ুন : রচনা : যুব সমাজের অবক্ষয় ও তার প্রতিকার

৩। আদর্শহীন শিক্ষা ব্যর্থ শিক্ষাব্যবস্থা : আদর্শ-বিবর্জিত শিক্ষা একটি ব্যর্থ শিক্ষাব্যবস্থা । যে শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো নৈতিক আদর্শ নেই, মানবতার কল্যাণের মাধ্যমে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার চূড়ান্ত লক্ষ্য নেই, তার যত ডিগ্রিই থাকুক, তার শিক্ষা ও জীবন দুটোই ব্যর্থ। M.V.C Jaffreys অভিযোগ করে বলেছেন, “আধুনিক পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে এর লক্ষ্যের অনিশ্চয়তা।” তথাকথিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় তাই মানুষকে বস্তুগত লালসা নিবৃত্তির প্রচেষ্টারত হিংস্র একেকজন দানবীয় মানবে রূপান্তর করে ।

৪। নৈতিক আদর্শ-বিবর্জিত শিক্ষার পরিণতি : শিক্ষাব্যবস্থার সাথে নৈতিক আদর্শের সংযোগ একান্তই অপরিহার্য। নৈতিক আদর্শ-বিবর্জিত শিক্ষাব্যবস্থায় ভয়াবহ এক দানবীয় পরিবেশ-পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আমাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ ডাকাতদের গ্রাম; ছাত্র নামধারী দানবেরা সেখানে মানুষের সবকিছু লুণ্ঠন আর খুন করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে; মা-বোনদের ইজ্জত হরণ করে ধর্ষণের সেঞ্চুরি পালন করে। শিক্ষকদেরকে বেধড়ক মারধর করতেও তারা বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করে না। মহান আল্লাহ মানবরূপী এসব হায়েনাদেরকে পশুর চেয়েও অধম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এসবই নৈতিক আদর্শ-বিবর্জিত শিক্ষার স্বাভাবিক পরিণতি ।

৫। নৈতিকতাপূর্ণ সুশিক্ষার সুফল : অজ্ঞতার অমানিশা থেকে মানব সভ্যতাকে আজকের উন্নতির শীর্ষমার্গে উত্তরণের পথপ্রদর্শক নিঃসন্দেহে শিক্ষা। এক্ষেত্রে শিক্ষার মূল আদর্শ ও লক্ষ্য তথা মানবতা, সহমর্মিতা, সহযোগিতা, কল্যাণ, উন্নত নৈতিক আদর্শ, বৈষয়িক উন্নতির পাশাপাশি পরকালীন সাফল্য অর্জন, মূল্যবোধ সৃষ্টি- এসব আদর্শই সক্রিয় থাকে। সভ্যতার বিকাশ, বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতি ও বিভিন্ন আবিষ্কার, বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ ব্যবস্থার উদ্ভাবন, বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্যে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক সৃষ্টি এসবই শিক্ষার প্রত্যক্ষ অবদান। বিশ্বের ইতিহাসে যুগে যুগে নৈতিকতার বলে বলীয়ান শত সহস্র নবি-রাসুল এবং বিজ্ঞ ব্যক্তি মানবজাতিকে সভ্য ও সামাজিক হিসেবে গড়ে তুলতে ঐতিহাসিক অবদান রেখেছেন।

আরও পড়ুন :চনা : ইসলামে মানবাধিকার / ইসলাম ও মানবাধিকার

৬। সুশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা : নৈতিকতাপূর্ণ সুশিক্ষার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। আমাদের মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স) একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর শিক্ষকতার মূল বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে তিনি বলেছেন, “নৈতিক চরিত্রের পরিপূর্ণতা দানের জন্যই আমি প্রেরিত হয়েছি।” হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা) থেকে বর্ণিত, এক দীর্ঘ হাদীসে মহানবি (স) বলেন, “তোমরা জ্ঞান অর্জন কর। কেননা জ্ঞান হচ্ছে অজ্ঞানতা থেকে হৃদয়কে রক্ষা করার উপায়, অন্ধকারে আলো জ্বালানোর প্রদীপ। জ্ঞানের দ্বারাই বান্দা দুনিয়া ও আখেরাতে শ্রেষ্ঠ ও মহৎ লোকদের মর্যাদায় উন্নীত হয়। জ্ঞানই কাজের পথপ্রদর্শক। কাজ জ্ঞানকেই অনুসরণ করে। সৌভাগ্যশালীরাই জ্ঞান অর্জন করে আর হতভাগারাই তা থেকে বঞ্চিত হয় ।”

উপসংহার :

শিক্ষাব্যবস্থা ও নৈতিকতা পরস্পর পরিপূরক শব্দ। আকৃতিগত একজন মানুষকে মহান সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্য অনুসারে প্রকৃত অর্থে মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য নৈতিকতাপূর্ণ ও আদর্শিক শিক্ষাব্যবস্থা অপরিহার্য। প্রকৃত মানুষ, সময়ের সাথে খাপ খাওয়ানোর যোগ্য মানুষ, সংস্কৃতিমান বা রুচিশীল মানুষ, সৃষ্টিকর্তার সাথে যোগাযোগ ও তাঁর ইচ্ছা পূরণের যোগ্য মানুষ, শত সহস্র বছরের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভিত রচনা করার যোগ্য মানুষ তৈরি হয় শুধুমাত্র নৈতিকতাপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে। এ কারণেই মহানবি (স) শিক্ষা অর্জন করাকে প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরয হিসেবে ঘোষণা করেছেন ।

আরও পড়ুন : প্রবন্ধ রচনা : শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস ও প্রতিকার

Leave a Comment