হোম পদার্থ রসায়ন জীব ইসলামিক

প্রবন্ধ রচনা : তথ্য প্রযুক্তির মহাসড়কে বাংলাদেশ

উপস্থাপনা :

বর্তমান বিশ্ব হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিশ্ব। সাবমেরিন ক্যাবল হচ্ছে তথ্য প্রযুক্তির অত্যাধুনিক মাধ্যম। এটি যে কোনো দেশের তথ্য প্রযুক্তির সামগ্রিক উন্নয়নে এক অপরিহার্য হাতিয়ার। ২১শে মে ২০০৬ তারিখে কক্সবাজারে ল্যান্ডিং স্টেশন উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যুক্ত হলো ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ে বা তথ্য প্রযুক্তির মহাসড়কের সঙ্গে। এর ফলে বহির্বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে বাংলাদেশ। যা দেশের টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নে একটি মাইলফলক এবং সেই সাথে জাতির সামনে উন্মুক্ত হয়েছে বিপুল সম্ভাবনার দুয়ার।

সাবমেরিন ক্যাবল :

এটি একটি অপটিক্যাল ফাইবার লাইন, যা সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে স্থাপন করা হয়। এ ক্যাবল টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তির অত্যাধুনিক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। উল্লেখ্য, অপটিক্যাল ফাইবার লম্বা চুলের মতো চিকন কাচের তৈরি এক ধরনের পদার্থ। এটি অত্যন্ত স্বচ্ছ, এর প্রস্তুতে এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, যাতে তরঙ্গ পাঠানোর সময় পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনের মাধ্যমে পুরোটাই ফাইবারের মধ্য দিয়ে চলতে পারে, কোনো সিগন্যালের অপচয় হয় না। চুলের মতো চিকন এক একটি অপটিক্যাল ফাইবার অবিশ্বাস্য রকম তথ্য বহন করতে পারে এবং অনেক বেশি পরিমাণ তথ্য আলোর গতিতে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে দিতে পারে ।

আরও পড়ুন : প্রবন্ধ রচনা : বিজ্ঞান ও আধুনিক সভ্যতা

সাবমেরিন ক্যাবলের ইতিকথা :

সাবমেরিন ক্যাবল প্রযুক্তি আধুনিক বিশ্বের একটি প্রযুক্তি। Trans Atlantic Telephone Cable (TAT) অনেক পুরনো। ১৮৫০ সালে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে প্রথম সংযোগ দেয় সাবমেরিন টেলিগ্রাফ কোম্পানি। তবে তিন দিনের মাথায় ফ্রান্সের জেলেদের কারণে এ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১৮৫১ সালে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করা হয়। ১৮৫২ সালে হলিহেড, ওয়ালস ও আইসল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা হয়। এটিও তিন দিন পর ফল্ট করে। ১৮৫৩ সালে ডেনমার্কে এই প্রযুক্তি আসে। ১৮৫৪ সালে সুইডেন-ডেনমার্কের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়।

১৮৫৫ সালে মিসর, ১৮৫৬ সালে আমাজান নদী, ১৮৫৭ সালে সিলোন (Ceylon)- ভারত, ১৮৫৯ সালে কিউটা-স্পেন, সিঙ্গাপুর-বাটাভিয়া, কানাডা-আলেকজান্দ্রিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা হয়। অবশ্য তখনকার এসব ক্যাবল ফাইবার অপটিকের ছিল না। প্রথম সাবমেরিন ক্যাবল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৬ সালে, যার নাম Trans Atlantic Telephone Cable (TAT-1)। এটি সাধারণ টেলিফোন ক্যাবল, কিন্তু TAT-6 নামে প্রথম ফাইবার অপটিকের সাবমেরিন ক্যাবল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৩ সালে। এটির ফলে আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশ দিয়ে টেলিফোন সংযোগ সম্ভব হয়।

সাবমেরিন ক্যাবলে বাংলাদেশ :

সাবমেরিন ক্যাবল সংযুক্ত হওয়ার প্রথম সুযোগ এসেছে ১৯৯০ সালে। তখন বাংলাদেশকে বিনামূল্যে এ ক্যাবলের সাথে সংযুক্ত হওয়ার অফার দেয় সংযুক্তকারী কোম্পানিটি। এ লাইনটি বঙ্গোপসাগরের তলদেশ দিয়েই যাচ্ছিল। ১৯৯৮ সালে দ্বিতীয়বার অনুরূপ আরেকটি প্রস্তাব পায়। তখন মাত্র ১৬০ কোটি টাকায় লিংক স্থাপন করতে পারত। দীর্ঘসূত্রতার কারণে এ প্রস্তাবটি আর বেশিদূর এগোয়নি। ফলে বাধ্য হয়ে সরকার ২০০০ সালে সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য আমেরিকার কোম্পানি ‘টাইকো সাবমেরিন সিস্টেম লিমিটেড’-এর সাথে ৯২১ কোটি টাকার একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।

আরও পড়ুন : প্রবন্ধ রচনা : প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক

কিন্তু বিভিন্ন কারণে চুক্তিটি ক্ষতিকর মনে হওয়ায় পরবর্তীতে সরকার আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং আইসিটি টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশকে গ্লোবাল ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ের সাথে সংযোগের জন্য ‘সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পটি গ্রহণ করে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম ইউরোপের ১৪টি দেশের মোট ১৬টি কোম্পানির সমন্বয়ে গঠিত কনসোর্টিয়ামে (SEA-ME- WE-4) যোগদান করতে ২০০২ সালে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে।

২০০২ সালের ১-৩ জুলাইয়ে দুবাইতে প্রথম এ ১৪টি দেশের SEA-ME-WE-4 মিটিং হয়। ৪ সেপ্টেম্বর ২০০২ তারিখে জাকার্তায় BTTB (Bangladesh Telegraph and Telephone Board) SEA-ME-WE-4 Memorandum of understanding (MOU)-তে স্বাক্ষর করে। সর্বশেষ ২৭শে মার্চ ২০০৪ তারিখে দুবাইতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে টিএন্ডটি বোর্ডের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম ‘নির্মাণ’ ও ‘রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তি’তে স্বাক্ষর করেন।

সাবমেরিন ক্যাবল-এর ক্ষমতা ও সম্ভাবনা :

বাংলাদেশ SEA-ME-WE-4 ক্যাবলের প্রাথমিকভাবে যে ক্ষমতা পাবে, তার পরিমাণ 10 Gigabits per second সহজভাবে বললে বলা যায়, এ ক্ষমতা ব্যবহার করে একসঙ্গে ১ লাখের বেশি লোক কথা বলতে পারবে। বর্তমানে বাংলাদেশের স্যাটেলাইটভিত্তিক চ্যানেলসংখ্যা মাত্র ৮০০০, যা থেকে সহজেই অনুমেয় সাবমেরিন ক্যাবলের ক্ষমতা কত ব্যাপক। এই ক্যাপাসিটি পর্যায়ক্রমে আরও বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে।

আরও পড়ুন : রচনা : মানব সভ্যতার বিকাশ ও বিজ্ঞান

এ মুহূর্তে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিটিটিবি যে সমস্ত সার্ভিস প্রদান করছে, তার মোট ক্ষমতা ৫৫০ Mbps ভি-স্যাটের মাধ্যমে বিভিন্ন আইএসপি এবং কর্পোরেট ব্যবহারকারীবৃন্দ যে গতি ব্যবহার করছে তার সম্মিলিত ক্ষমতা আনুমানিক ২৫০ Mbps। ‘অর্থাৎ এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সর্বমোট ব্যবহার ৮০০০ Mbps-এর মতো। এমতাবস্থায় সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে প্রাপ্ত মোট ১০,০০০ Mbps নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য বিশাল ক্যাপাসিটি এবং তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের মহান সুযোগ ।

সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে দেশের অভ্যন্তরীণ সংযোগ :

কক্সবাজার ল্যান্ডিং স্টেশনকে ঢাকা তথা সারা দেশের সাথে যুক্ত করার জন্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে নতুন অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া এ রুটের মাইক্রোওয়েভ সিস্টেম সম্প্রসারণ করা হয়েছে। পূর্ব থেকেই ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে অপটিক্যাল ফাইবার রয়েছে। এটিরও সম্প্রসারণ করা হয়েছে এবং সাবমেরিন ক্যাবল-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সার্ভিসের চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে ইন্টারনেট সার্ভিস চালু করা হয়েছে। বিদ্যমান গেটওয়ে এক্সচেঞ্জের সাথে সারা দেশের টেলিফোনে Exchange সমূহ বিভিন্ন ট্রান্সমিশন লিংকের মাধ্যমে যুক্ত হয়েছে।

তবে তা উন্নততর করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে বর্তমানে সারাদেশে অপটিক্যাল ফাইবার বসানো হচ্ছে। এসব অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে দেশের জেলা সদরের ডিজিটাল এক্সচেঞ্জসমূহকে আন্তর্জাতিক গেটওয়ে এক্সচেঞ্জের সাথে যুক্ত করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ডাটা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে। উপজেলাসমূহে ডিজিটাল এক্সচেঞ্জ স্থাপনের কাজও চলছে। সকল ডিজিটাল এক্সচেঞ্জে ইন্টারনেট সুবিধা বিস্তৃত হবে। এভাবে সাবমেরিন ক্যাবলের সুবিধা দেশের সর্বত্র পৌঁছে যাবে। বিভিন্ন প্রাইভেট অপারেটর ও আইএসপিগণকে এক্সচেঞ্জসমূহে এভিডিএন লোডে সংযোগ প্রদান করা হবে।

আরও পড়ুন : প্রবন্ধ রচনা: দূষিত পরিবেশ ও বিপন্ন পৃথিবী

ফলে এসব অপারেটরগণের গ্রাহকগণ সাবমেরিন ক্যাবলের সুবিধা লাভ করবেন। তাছাড়া কর্পোরেট গ্রাহক ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহ নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য আন্তর্জাতিক ডাটা লিজলাইন গ্রহণ করতে পারবেন। বিটিটিবি কর্তৃক সীমিত সম্পদের মধ্যে গেটওয়ে এক্সচেঞ্জ, আন্তসংযোগ সুবিধা, ইন্টারনেট এক্সচেঞ্জ, ডাটা নেটওয়ার্ক প্রভৃতি সম্প্রসারণের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এ অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ অব্যাহত থাকবে।

সুবিধাদি :

সাবমেরিন ক্যাবল থেকে বেশ কতকগুলো সুবিধা সৃষ্টি হবে। আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগের জন্য বর্তমানে ব্যবহৃত উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্রের তুলনায় সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে এর ভয়েস এবং ডাটা ট্রান্সফার অনেক দ্রুততর, সুলভ ও উন্নতমানের হবে। ইন্টারনেটের স্পীড অনেক বেড়ে যাবে। আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ সার্কিট সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। ব্রডব্যান্ড সার্ভিস যথা- কলসেন্টার, ই-লার্নিং, ভিডিও কনফারেন্সিং, টেলিমেডিসিন, Software রপ্তানি ইত্যাদি কমমূল্যে ও সহজে চালু করা সম্ভব হবে।

উপসংহার :

সাবমেরিন ক্যাবল আমাদের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনাময় সুযোগ এনে দিয়েছে। দেশে মোবাইল ফোনের প্রসার ঘটেছে, কিন্তু শুধু আন্তর্জাতিক ভয়েস দ্বারা সাবমেরিন ক্যাবলের বিশাল ক্যাপাসিটির পরিপূর্ণ ব্যবহার হবে না। এটা তখনই সম্ভব হবে যখন দেশের জনসাধারণ বিশেষ করে যুব সমাজ তথ্য প্রযুক্তিমনস্ক হবে, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট প্রসারিত হবে এবং উদ্যোক্তাগণ তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন ব্যবসা ও সার্ভিস গ্রহণ করবেন। যার জন্য অধিক ব্রডব্যান্ড প্রয়োজন। এটা সম্ভব হলে একদিকে নতুন নতুন কর্মসংস্থান হবে, অপরদিকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও সরকারি রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে। ফলে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।

Leave a Comment