উপস্থাপনা :
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর সৈনিক হিসেবে বাংলার ছাত্রসমাজও বিভিন্ন স্তরের মানুষের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল। শত শত ছাত্র বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলার স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছিল। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ছাত্রসমাজের আত্মত্যাগের কথা স্বর্ণাক্ষরে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
ছাত্রসমাজের অতীত ঐতিহ্য :
ছাত্ররা দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তারা যুগে যুগে দেশের সকল প্রকার প্রগতিশীল আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে। ইংরেজ আমলে সাম্রাজ্যবাদী শাসকের সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করতে তারাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে তারা নেতৃত্ব দিয়েছিল। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অন্যান্যদের সাথে ছাত্ররাও। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। তাই জাতি এই ছাত্রসমাজের কাছে যথার্থই ঋণী ।
আরো পড়ুন : প্রবন্ধ রচনা : ছাত্র সমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্য
স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি ও ছাত্রসমাজ :
১৯৪৭ সালে বেনিয়া ইংরেজদের শোষণ থেকে মুক্তি পেয়ে বাঙালি জাতি পুনরায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণে পতিত হয়। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুখের বুলি বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। তারই প্রতিবাদস্বরূপ হাজার হাজার ছাত্র অকুণ্ঠিত চিত্তে ঢাকার রাজপথে নেমে পড়ে। ফলে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি শাসকগোষ্ঠীর লেলিয়ে দেওয়া পুলিশের গুলিতে প্রাণ দেয় বরকত, সালাম, রফিক ও জব্বার । অস্ত্র ও রাইফেলের গুলির বিরুদ্ধে নিরস্ত্র ছাত্রসমাজ কেবল হৃদয়ের শক্তিকে আশ্রয় করে রুখে দাঁড়িয়েছিল। সেদিন গৌরবদীপ্ত আত্মোৎসর্গের নিদর্শন স্থাপন করে বাংলার ছাত্রসমাজ পৃথিবীর বুকে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সূচনা :
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই শোষিত বাঙালি জাতির মধ্যে স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন চলতে থাকে । ১৯৬৯ সালে ঘটে গণঅভ্যুত্থান । ফলে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এদেশে সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। সে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। কিন্তু ইয়াহিয়া সরকার রায় অনুসারে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বরং ৭১-এর ২৫শে মার্চের কালরাতে তার সেনাবাহিনীকে বাংলার নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর লেলিয়ে দেয়; এবং এভাবেই বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে এক রক্তাক্ত যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়।
একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ছাত্রসমাজ :
ইয়াহিয়া খান ও টিক্কা খানের হানাদার সৈন্যবাহিনী হত্যা, লুটতরাজ, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে এদেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তাই তখনকার বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে এদেশের শ্রমিক, কৃষক, জনতার পাশাপাশি ছাত্রসমাজও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধে শতকরা ৭০ ভাগই ছিল ছাত্র। প্রথমদিকে বাংলার দামাল ছাত্রসমাজ কোনো ট্রেনিং ছাড়াই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল।
আরো পড়ুন : রচনা: ছাত্র জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য- Class 6,7,8,9,10।PDF
ছাত্রদের আত্মত্যাগ :
দিন নেই, রাত নেই, সময় নেই- কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছে তাদের। এক পা, দু’পা করে শেষে হামাগুড়ি দিয়ে নিঃশব্দে অগ্রসর হতে হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত বুলেটবিদ্ধ করে ধরাশায়ী করেছে শত্রুকে । আবার কখনো মাথার উপর বৃষ্টি ঝরেছে। তাদের আহার নেই, নিদ্রা নেই, পরনে একখানি মাত্র লুঙ্গি। এ অবস্থায় কাধে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে উল্কার মতো ছুটতে হয়েছিল দানব হননের নেশায়। মাথার উপর তীব্র অগ্নিঝরা দাহন, কিন্তু শত্রুর জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কখনো বা আত্মদান করতে হয়েছে তাদের।
মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রদের গেরিলা যুদ্ধের সুযোগ নিতে হয়েছে। এভাবে যুদ্ধ করে শত্রুকে সহজে কব্জা করার কৌশল আয়ত্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা বেশ সাফল্য লাভ করেছিল। হয়তো ঝোপে- ঝাড়ে ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে অথবা কোনো পোড়াবাড়িতে স্থাপিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের শিবির। মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তরুণ ছাত্র। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একনিষ্ঠ যোদ্ধা। এভাবেই বাংলার ছাত্রসমাজ ধৈর্য, অধ্যবসায়, সাহস, ত্যাগ- তিতিক্ষা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে বাংলার স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করেছিল।
অভিনব কৌশল অবলম্বন :
জাগ্রত ছাত্রসমাজ এই বর্বর অত্যাচার নীরবে সহ্য করতে প্রস্তুত ছিল না। তারা গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে থাকে। বিপুলসংখ্যক ছাত্র মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করে এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে চলে যায়। সংগ্রামী ছাত্রসমাজ বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘবদ্ধ হয়ে পশ্চিমা সেনাবাহিনীর ওপর গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালাতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর ছাত্ররা বাইরে থেকে যেমন হামলা চালাতে থাকে তেমনি অসংখ্য মুক্তিসেনা দেশের বিভিন্ন অংশে হামলা চালিয়ে অনেক স্থান শত্রুমুক্ত করে। ফলে শত্রুবাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
উপসংহার :
সুদীর্ঘ নয় মাসের কঠোর সংগ্রামের পর ছাত্র ও তরুণদের অবর্ণনীয় ত্যাগের ফলে বাংলার আকাশে উদিত হয় স্বাধীনতার লাল টকটকে সূর্য। রচিত হয় এক নতুন ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে স্থান লাভ করে একটি নতুন দেশ। তার নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বা মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের গৌরবোজ্জ্বল অবদানের কথা বাঙালি জাতি আজীবন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।
আপনার পছন্দ হতে পারে এমন আরো